মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: রবিবার ২৫, অগাস্ট ২০২৪

রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বেতন দিন, মানুষকে চাঁদাবাজি থেকে মুক্তি দিন

Share on:

কত লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে, রিজার্ভ কত কমলে, কত লাখ কোটি টাকা ঋণের বোঝা রেখে গেছে বিগত সরকার, মূল্যস্ফীতির প্রকৃত অঙ্কটা কত—এসব হিসাব-নিকাশ করা আমাদের তছনছ হয়ে যাওয়া, আরও ভালো করে বললে, লুট হয়ে যাওয়া অর্থনীতিকে ঠিক পথে আনার জন্য খুবই জরুরি বিষয়।


শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরে আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে ভেঙে পড়েছে, সেগুলো সংস্কার করে একটা ভিত্তির ওপরে দাঁড় করাতে নিশ্চিত করেই সময় লাগবে। তবে সাধারণ মানুষের কাছে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় নিরাপত্তা আর বাজার, মানে জিনিসপত্রের দাম।

বাজার নিয়ে উদ্বেগ বলি আর দুশ্চিন্তা বলি, সেটা এই মাত্রায় গিয়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে ৫ আগস্ট হাসিনা সরকার পতনের পরই মানুষ আশা করতে শুরু করেছিল, জিনিসপত্রের দাম কমে আসবে।

অনেকে তো ফেসবুকে নিজেদের মতো করে চাল, ডাল, তেল, চিনি, মাছ, মাংসের দামের তালিকা দিয়ে বলেছেন, এর বেশি কেউ দাম নিলে যেন সেনাবাহিনীকে জানানো হয়। আবার অনেকে জানাতে থাকেন, বাজারে ইলিশ মাছের দাম অনেকটাই কমে গেছে।

জিনিসপত্রের দাম একটা সহনীয় জায়গায় আনতে গেলে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়া, আমদানি বাড়ানো ও জ্বালানির দাম কমানোর মতো বিষয়গুলো জড়িত। বাজারে জিনিসপত্রের দাম, বিশেষ করে দেশে উৎপাদিত খাদ্যপণ্যের মূল্য বাড়ার পেছনে বহু বছর ধরে চলে আসা বহু স্তরের সিন্ডিকেট ও চাঁদাবাজি যে একটা বড় কারণ, সেটা এত দিন সবাই কমবেশি আলোচনা করে এসেছেন।

১৮ আগস্ট বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে বিভিন্ন বিভাগের সঙ্গে প্রথম বৈঠকের সময় অন্তর্বর্তী সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, দেশে পণ্য পরিবহনে চাঁদাবাজি হয়। এক ট্রাক ঢাকা পর্যন্ত আসতে সাত হাজার লাগে। রাজধানীর কারওয়ান বাজারেই একটা পণ্য চারবার হাতবদল হয়।

শাকসবজি, মাছ-মাংস থেকে শুরু করে অন্যান্য খাদ্যপণ্য কৃষক বা উৎপাদক থেকে শুরু করে ভোক্তার হাতে পৌঁছতে চাঁদাবাজি এখানেই থেমে নেই। ঢাকার পাড়া-মহল্লায় ভ্যানে করে কিংবা রাস্তার পাশে ফুটপাতে টুকরিতে করে কিংবা বাজারে তিন-চার বর্গফুটের জায়গা নিয়ে যাঁরা সেগুলো বিক্রি করেন, তাঁদের কাছ থেকে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ও পুলিশের চাঁদাবাজি যোগ করতে হবে।

বাংলাদেশ হকার্স ফেডারেশনের তথ্যই বলছে, শুধু ঢাকায় একেকজন হকারের কাছ থেকে দিনে গড়ে ৩০০ টাকা চাঁদা তোলা হয়। এর প্রভাব সরাসরি জিনিসপত্রের দামের ওপর পড়ছে। অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা তাঁর বক্তব্যে যে ইঙ্গিত দিয়েছেন, সেটা আরও ভয়ংকর। তিনি বলেছেন, ‘আমার কাছে অনেক প্রতিবেদন আসছে। চাতাল থেকে চাল কিনতে হব। এক গ্রুপ চাঁদা নিয়ে চলে গেছে। আরেক গ্রুপ এসে আবার চাঁদা দাবি করছে।’

কেননা, যে নেতার পেছনে যত অনুসারী, দলের ভেতরে তিনি তত বেশি ক্ষমতাশালী। রাজনৈতিক নেতাদের উচিত তাঁদের অনুসারীদের, তাঁদের নামে যাঁরা স্লোগান দেন, তাঁদের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করা। নিজেদের পকেট থেকে অনুসারীদের বেতন-ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা চালু করা। চাঁদাবাজির নামে সাধারণ মানুষের পকেট কেটে নেতাদের অতিধনী হওয়ার আর অনুসারীদের পকেট ভরার রাজনীতি থেকে মানুষের মুক্তি আসবে কি?

৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের উদ্‌যাপনের মুহূর্ত যখন চলছিল, চোখের সামনেই তখন দেখেছি, পুরোনোদের জায়গায় কীভাবে চর দখলের মতো নতুনেরা বাজার দখলে মেতে উঠেছে। নেতা, উপনেতা, পাতিনেতা কিছু সাঙ্গপাঙ্গ এনে বলে গেছেন, কার প্রভাবাধীন জায়গা কতটুকু। এর মানে হচ্ছে, সেই জায়গাতে কেউ দোকান নিয়ে বসলে তাঁদের চাঁদা দিতে হবে। সেই দখল নিশ্চিত রাখার জন্য মিছিল চলেছে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত। রাজনৈতিক স্লোগান বদলেছে, কিন্তু দখলের সংস্কৃতি বদলায়নি।

শুধু ঢাকা নয়, এ চিত্র দেশের প্রায় সবখানেই। পরিবহন সমিতির কার্যালয়, হাট, বাজার, ঘাট, জলমহাল, সেতুর টোল আদায়ের ঘর—আগের দলের বদলে নতুন দলের লোক এসেছেন। ভুক্তভোগীরা বলছেন, শুধু সামনের সারির মুখগুলো বদলে গেছে, পেছনের লোকেরা সেই আগের মুখ।

নৈরাজ্যটা এমনটাই যে সকালে একদল এসে বলছেন তাঁদের চাঁদা দিতে হবে; বিকেলে আরেক দল এসে বলছেন তাঁদের চাঁদা দিতে হবে। এ পরিস্থিতিতে ফুটপাতের দোকানিরা বলতে বাধ্য হচ্ছেন, ‘আপনারা নিজেদের মধ্যে আগে আলোচনা করে ঠিক করেন কাদের চাঁদা দিতে হবে।’

মার্কিন দার্শনিক ও ইতিহাসবিদ উইল ডুরান্ট তাঁর ‘সভ্যতার জন্ম’ বইয়ের ভূমিকায় মানুষ কেন রাষ্ট্রগঠন করল, তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন, মানুষ দেখল, অনেকগুলো দস্যু দলকে চাঁদা দেওয়ার চেয়ে একজনকে চাঁদা দেওয়াটাই সুবিধার।

তাঁর ব্যাখ্যার সূত্র ধরেই বলতে পারি রাষ্ট্রকে নাগরিকেরা ট্যাক্স, ভ্যাটসহ নানা ধরনের কর দেয়। তার বিনিময়ে রাষ্ট্র নাগরিকদের সুরক্ষা দেয়, সেবা দেয়। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের কিংবা পুলিশকে যদি নাগরিকের চাঁদা দিতে হয় (প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সব নাগরিককেই দিতে হচ্ছে। কারণ যে চাঁদা তাঁরা দোকানদারকে কাছ থেকে নেন সেটা শেষপর্যন্ত ভোক্তার ঘাড়েই চাপে) তাহলে বলতেই হয় আমাদের রাষ্ট্র–কাঠামো এখনো প্রাক্‌-রাষ্ট্র যুগে থেকে গেছে।

আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টির মতো বাংলাদেশের মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীরা রাজনীতিকে বিনিয়োগহীন ব্যবসায় পরিণত করেছে। কেন্দ্র থেকে শুরু করে ওয়ার্ড পর্যন্ত— এই দলগুলোর বিশাল কর্মী বাহিনী থাকে। তাঁদের বড় একটা অংশের পেশা হচ্ছে রাজনীতি। মানে টেন্ডারবাজি, তদবিরবাজি, দখলবাজি, চাঁদাবাজি, সিন্ডিকেটবাজি।

যে দল যখন ক্ষমতায় থাকে, তাদের লাখ লাখ নেতা-কর্মী এমন পরগাছা অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত থাকেন। আওয়ামী লীগ আমলে শতকোটিপতি কিংবা কোটিপতির বাম্পার উৎপাদনে বাংলাদেশ যে প্রথম স্থান অর্জন করেছিল, তার পেছনে একটা বড় কারণ ছিল রাষ্ট্রযন্ত্র ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার করে জনগণের সম্পদ অবাধ লুণ্ঠন।

ছাত্র-জনতার আন্দোলন ও অভ্যুত্থানে প্রায় সাড়ে ছয় শ মানুষ নিহত হয়েছেন। তাঁদের চার ভাগের প্রায় তিন ভাগই কিশোর ও তরুণ। তাঁদের বয়স ৩০-এর নিচে। এই আন্দোলনে হাজার হাজার কিশোর-তরুণ আহত হয়েছেন।

তাঁদের অনেকে চিরতরে দৃষ্টি হারিয়েছেন। অনেকে হারিয়েছেন তাঁদের হাত-পা। তাঁদের চিকিৎসা, তাঁদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা তো আছেই। এত এত শহীদের রক্তের দাগ, ক্ষত, শোক, কান্না শুকাতে না শুকাতেই শুরু হয়েছে ভাগ-বাঁটোয়ারা আর চাঁদাবাজির পুরোনো সেই চর্চা।

আজমপুরে উত্তরায় প্রতিবাদ করতে গুলি খেয়ে এক হাত হারানো কিশোর আতিকুলের কথা ধরা যাক। একটা বেসরকারি টেলিভিশনে অকুতোভয় এই কিশোর বলেছে, ‘আঙ্কেল, লাগলে আবার যামু। দরকার হইলে আবার হাত হারামু।’ জুলাই-আগস্টের জনবিদ্রোহ ও গণ-অভ্যুত্থান এই রকম হার না-মানা কিশোর-তরুণ-ছাত্র-জনতার নিঃস্বার্থ আত্মাহুতির মহাকাব্য।

এত এত তরুণ প্রাণের আত্মত্যাগ তৈরি করেছে নতুন এক বাংলাদেশের জন-আকাঙ্ক্ষা। যে দল, যে মত, যে ধর্ম, যে জাতিরই হোক; মানুষ আর পুরোনো বাংলাদেশে, পুরোনো রাজনীতিতে ফিরতে চান না। বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম তো নয়ই। ৫ আগস্টকে তাঁরা বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলে ঘোষণা করেছেন।

বেসামরিক-সামরিক স্বৈরাচার কিংবা তথাকথিত সংসদীয় গণতন্ত্র— যা-ই হোক না কেন, ৫৩ বছর ধরে আমরা একদলীয় কিংবা এক ব্যক্তির শাসন দেখে আসছি। আমাদের পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থা বেহাত হয়ে গিয়েছিল গুটিকয় রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আমলা, পুলিশ, সেনাবাহিনীর কর্মকর্তার হাতে। মানুষ আর সেই পুরোনো রাজনীতির ফাঁদে আটকে পড়তে চান না। অর্থাৎ একটা জনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে স্বাধীন, সার্বভৌম ও আত্মমর্যাদাপূর্ণ একটা জনগোষ্ঠী হয়ে ওঠার যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল, সেটাই মানুষ আবার ফেরত পেতে চান।

এই জন-আকাঙ্ক্ষা কি আমাদের মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো শুনতে পাচ্ছে? সারা দেশজুড়ে দেয়ালে দেয়ালে শিক্ষার্থীরা যে গ্রাফিতি এঁকেছেন, অন্তত সেগুলো তাঁরা দেখে আসুন। দেয়ালের ভাষা বুঝতে না পারলে তার কী করুণ পরিণতি হয়, শেখ হাসিনার সরকার তার বাস্তব দৃষ্টান্ত।

ছাত্র–জনতার গণঅভ্যুত্থান রাজনৈতিক দলগুলোকে ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থের পুরোনো সেই অনুশীলন থেকে বেরিয়ে আসার একটা সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। রাষ্ট্রে, সরকারে, সমাজে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে সবার আগে দলের ভেতরে, নেতৃত্বের কাঠামোয় গণতন্ত্র জরুরি। সেটা না হলে সহমত ভাইদের রাজনীতি থেকে মানুষের মুক্তির পথ নেই।

কেননা, যে নেতার পেছনে যত অনুসারী, দলের ভেতরে তিনি তত বেশি ক্ষমতাশালী। রাজনৈতিক নেতাদের উচিত তাঁদের অনুসারীদের, তাঁদের নামে যাঁরা স্লোগান দেন, তাঁদের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করা। নিজেদের পকেট থেকে অনুসারীদের বেতন-ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা চালু করা। চাঁদাবাজির নামে সাধারণ মানুষের পকেট কেটে নেতাদের অতিধনী হওয়ার আর অনুসারীদের পকেট ভরার রাজনীতি থেকে মানুষের মুক্তি আসবে কি?

প্রথম আলো