রাজনৈতিক দৃশ্যপটে সম্পদ ও ক্ষমতার আসক্তি রোগ!
Share on:
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে নাটকীয় পরিবর্তন দেখা গেছে। একটি অভূতপূর্ব গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে এক ফ্যাসিস্ট ও চরম দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে। বিগত সরকার সিস্টেম্যাটিকভাবে বিভিন্ন মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে দিয়েছে এবং সেগুলোকে রাজনীতিকরণের মাধ্যমে ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছে, যখন এর ঘনিষ্ঠজন ও অলিগার্করা জাতীয় সম্পদ মগের মুল্লুকের মতো লুট করে বিপুল ধনসম্পদ জমিয়েছে।
নৈতিক মূল্যবোধের পতন, ক্ষমতা ও সম্পদের আসক্তি, এবং জাতীয় সম্পদ বিদেশে পাচারের ফলে জনগণের হতাশা ও দুর্ভাগ্য তলানিতে ঠেকেছিল। আচরণগত মনোবিজ্ঞান (বিহেভিওরাল সাইকোলজি) ও সিস্টেমস থিংকিং বিশেষ সহায়ক হতে পারে সেই বহুমুখী সংকটকে বুঝতে, যা শেষ পর্যন্ত এক মারাত্মক ফ্যাসিস্ট শাসনকে পতনের দিকে নিয়ে গেছে।
ক্ষমতা, ঠিক যেমন নেশাজাতীয় পদার্থ, নেতা ও প্রভাবশালীদের গ্রাস করতে পারে এবং তাদের নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বিকৃত ও আচ্ছন্ন, এমনকি অচল করতে পারে। আচরণগত মনোবিজ্ঞান দেখায় যে কীভাবে নেশা মস্তিষ্ককে পুনর্বিন্যাস করে, যা নেশাগ্রস্ত মানুষকে যেকোনো মূল্যে নিজেদের চাহিদা মেটাতে বাধ্য করে। একইভাবে ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিরাও ক্ষমতার ওপর আরো অতিমাত্রিকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েন এবং তা ধরে রাখতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। বাংলাদেশের দুর্নীতিগ্রস্ত সাবেক সরকারও সম্পদের আসক্তিতে ভুগছিল। ক্ষমতার প্রতি তাদের লাগামহীন আসক্তির পাশাপাশি অলিগার্করা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা সরকারি সম্পদ শোষণ করে অভূতপূর্ব মাত্রার বিপুল সম্পদ সংগ্রহ করেছে। এ সম্পদের আসক্তি লোভের এমন একটি অপসংস্কৃতি তৈরি করেছে, যেখানে শাসন বা ব্যবসায়িক সেবার পরিবর্তে অবৈধ ব্যক্তিগত সম্পদ বৃদ্ধির এক অদম্য নেশায় পর্যবসিত হয়।
সিস্টেমকেন্দ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে ক্ষমতা ও সম্পদের যুগপৎ আসক্তি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এক ধরনের দুষ্টচক্র বা রিইনফোর্সিং লুপ সৃষ্টি করেছে। ক্ষমতাসীনরা প্রভাবশালীদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করেছে, যা তাদের দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে পাহাড়সম সম্পদ অর্জনে সক্ষম করেছে। যত তারা ধনী হয়েছে, তাদের ক্ষমতা ততই শক্তিশালী হয়েছে এবং এর ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোর অবনতি ত্বরান্বিত হয়েছে। অলিগার্করা দুর্নীতি ও একচেটিয়ার মাধ্যমে নিজেদের আরো বিত্তশালী করেছে এবং বিদেশে বিশাল অংকের অর্থ পাচার করেছে। গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (২০২০) প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ প্রতি বছর ক্রমাগতভাবে কয়েক বিলিয়ন মার্কিন ডলার হারিয়েছে, যা উন্নয়ন ও টেকসই কর্মসংস্থানের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ থেকে দেশ ও জাতিকে বঞ্চিত করেছে।
এ সম্পদের আসক্তি এবং অর্থ পাচারের কারণে দেশটি মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। প্রভাবশালী ব্যক্তিরা জাতীয় সম্পদ শোষণ করতে থাকায় দেশের গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক এবং প্রাসঙ্গিক সম্পদগুলো নিঃশেষ করা হয়েছে। এটি কেবল মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তিকে ধনকুবের করেছে, তবে একই সঙ্গে দেশের স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার মতো জনসেবা খাতগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল ব্যাপকভাবে সংকুচিত করেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (২০২২) তথ্য অনুযায়ী, দেশের প্রায় ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ জনগণ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে এবং যদি দেশের সম্পদ দেশে বিনিয়োগ করা হতো, তাহলে এ সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেত।
সম্পদের প্রতি আসক্তি আরো গভীরভাবে সরকারের ক্ষমতাকে সুসংহত করেছে, ক্ষমতার বলয়ের নিকটজনরা ও দুর্নীতিপরায়ণ বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে তারা ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছিল, যেন তাদের কোনোভাবেই ক্ষমতা থেকে সরানো না যায়। প্রকৃতপক্ষে ওই সরকারকে সরানোর সব ধরনের সাংবিধানিক, নিয়মতান্ত্রিক ও স্বাভাবিক পথ রুদ্ধ করা হয়েছিল। মাফিয়া স্টাইলে সংঘবদ্ধ অপরাধ চক্রের মতো এ প্রভাবশালী নেটওয়ার্ক সরকারকে টিকিয়ে রেখেছিল, এমনকি ব্যাপক ও পুঞ্জীভূত জনরোষের মধ্যেও। বিচার ব্যবস্থা, নির্বাচনী প্রক্রিয়া এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো সব সরকারের কার্যকরী দলীয় নিয়ন্ত্রণে ছিল। দুর্নীতি একটি সিস্টেম হয়ে দাঁড়িয়েছিল, যা শাসনের অংশে পরিণত হয়েছিল এবং এর পেছনে ভারতের আধিপত্যবাদী প্রভাবও মৌলিকভাবে কার্যকর ছিল।
আচরণগত মনোবিজ্ঞান আরো দেখায় যে কীভাবে ক্ষমতা ও সম্পদের নেশা একে অন্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। মাদকের আসক্তির মতোই, রাজনৈতিক নেতারা ক্রমাগত অধিকতর ক্ষমতা ও সম্পদের অদম্য প্রয়োজন অনুভব করেছিল তাদের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার জন্য। এর ফলে নৈতিকতার গভীর অবনতি ঘটে, যেখানে জাতীয় বা জনস্বার্থ বিসর্জন দিয়ে অপরাধের কাঠামোতে ব্যক্তিগত স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। যখন জনমনে অসন্তোষ বেড়ে যায়, তখন সরকার আরো দমনমূলক হয়ে ওঠে এবং বিরোধীদের দমন করতে ও সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করতে রাষ্ট্রীয় সহিংসতা ব্যবহার
করে। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৬২তম অবস্থানে ছিল ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে, যা সরকারের সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের ন্যক্কারজনক প্রচেষ্টাকে প্রতিফলিত করে।
অলিগার্কদের সম্পদের আসক্তি দেশের অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করেছে এবং জনগণের আস্থা ধ্বংস করেছে। ধনী-দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য বেড়েছে, যেখানে দেশের শীর্ষ ১ শতাংশ সম্পদের উল্লেখযোগ্য অংশ নিয়ন্ত্রণ করে। সরকারের সঙ্গে বড় ব্যবসায়ীদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে এ বৈষম্য আরো গভীর হয়েছে, যেখানে অলিগার্করা রাজনৈতিক প্রচারণায় ও ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণে অর্থায়ন করেছে এবং বিনিময়ে অনৈতিক এমনকি অবৈধ ব্যবসায়িক সুবিধা পেয়েছে। ২০১৩ সালে রানা প্লাজায় ধস, যেখানে ১১ শতাধিক শ্রমিক নিহত হয়েছিলেন, দেখিয়েছিল যে কীভাবে লোভ ও দুর্নীতি শ্রম অধিকার ও নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি উপেক্ষা করেছে। এটি এমন এক ব্যবস্থার প্রতীক ছিল, যেখানে মুনাফা ও সম্পদ মানুষের জীবন, মৌলিক মর্যাদা ও অধিকারের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
সিস্টেমস থিংকিংয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, ক্ষমতা ও সম্পদ একে অন্যকে মজবুত করেছে, যা বাংলাদেশকে নৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এ দুষ্টচক্রটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতা দ্বারা সম্ভব হয়েছে, যা হয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল বা অকার্যকর করা হয়েছিল। বিচার বিভাগ রাজনৈতিক প্রতিশোধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল, আর সংবাদমাধ্যমকে সেন্সরশিপ ও ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে চুপ করিয়ে রাখা হয়েছিল। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অপরাধ চক্রের মতো কাজ করছিল, যেখানে জোরপূর্বক গুম, চাঁদাবাজি এবং সহিংসতা ব্যবহার করা হতো ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য। এসব অনিয়ম রোধ করতে যেসব প্রাতিষ্ঠানিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকার কথা ছিল সেগুলো পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হয়েছিল। ফলে দায়বদ্ধতা সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়ে যায়।
অবশেষে বাংলাদেশে তরুণ শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে যে গণজাগরণ শুরু হয়েছিল, তা এক ক্ষয়িষ্ণু ও বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার প্রতি জনগণের চরম ও জীবনবাজি করা প্রতিরোধে পরিণত হয়। ক্ষমতা ও সম্পদের নেশা এবং প্রাতিষ্ঠানিক অবক্ষয়ের সংমিশ্রণ একটি ক্রান্তিলগ্নে এসে দাঁড়ায় যেখানে সাধারণ মানুষ আর পুরনো ব্যবস্থাকে মেনে নিতে পারছিল না, রাজি ছিল না। এ আন্দোলন কেবল অর্থনৈতিক কষ্ট, বঞ্চনা আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া ছিল না; বরং এটি সেই দুর্নীতিগ্রস্ত সিস্টেমের বিরুদ্ধে একটি দুর্নিবার প্রতিক্রিয়া ছিল যা রাষ্ট্রকে ভেতর থেকে ধ্বংস করছিল। বাংলাদেশের তরুণ-যুব সমাজের নেতৃত্বে এ গণজাগরণ বিশ্ববাসীর জন্য দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণের সফলভাবে রুখে দাঁড়ানোর একটি নতুন অনুপ্রেরণাদায়ক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
এ সরকারের পতন সবার জন্য একটি মৌলিক ও বাস্তব শিক্ষা যে, কীভাবে লাগামহীন ক্ষমতা, লোভ ও আসক্তি একটি দেশের নৈতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভিত্তি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করতে পারে। সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো, এ ঘটনা বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর একটিতে যেখানে লোভী অভিজাতরা ধর্মীয় খোলস ও আচার-অনুষ্ঠানের আড়ালে লুকিয়ে ইসলামের নামে প্রতারণা করেছে আর মুসলিম জনগোষ্ঠীর সঙ্গেই করেছে এক হীন বিশ্বাসঘাতকতা। সীমাহীন সম্পদ সংগ্রহের উন্মাদনা সত্যিই একটি গুরুতর আসক্তি, যা আচরণগত ও মানসিক সমস্যা বা রোগের একটি ভয়াবহ রূপ। অন্যসব আসক্তি ও সংশ্লিষ্ট সমস্যার মতো এর জন্যও প্রাসঙ্গিক সমন্বিত হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। ভালো আইন ও নিয়মাবলির পাশাপাশি সেগুলোর কার্যকর প্রয়োগের মাধ্যমে ব্যক্তি ও সামষ্টিক পর্যায়ে আমাদের নৈতিক ঘাটতি পূরণ করতে হবে। যখন সমাজের উচ্চ স্তরের নেতৃত্বের মাধ্যমে সিস্টেমটি মূলে পচে গেছে, তখন দেশটিতে একটি বিস্তৃত ও সিস্টেমিক সংস্কারের প্রয়োজন, যেখানে নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন প্রজন্ম আমাদের জন্য আশার আলো হয়ে দাঁড়িয়েছে। একই সঙ্গে বিশেষজ্ঞদের এ আসক্তির দিক বা রোগ নিয়ে আরো গভীরভাবে গবেষণা ও বিশ্লেষণ করে প্রাসঙ্গিক সমাধান ও হস্তক্ষেপ নিয়ে আসা উচিত।