মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: সোমবার ১৬, সেপ্টেম্বর ২০২৪

রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রচর্চার বিকল্প নেই

Share on:

বাংলাদেশ এখন যেখানে দাঁড়িয়ে, সেখান থেকে আশায় বুক বাঁধার মতো অনেক কিছুই আছে। সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থান জাতিকে নতুনভাবে জাগিয়ে তুলেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের হাত ধরে আসা গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম সফলতা হচ্ছে, এ আন্দোলন দেশের রাজনীতিবিমুখ সব নাগরিককে প্রবলভাবে রাজনীতি সচেতন নাগরিকে পরিণত করেছে।


দীর্ঘ স্বৈরশাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট জাতির পুনর্জাগরণ, বিশেষ করে এ দেশের তরুণ সমাজের মানসপটে ঘটে যাওয়া বিপ্লব ভবিষ্যতের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ পুনর্নির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে, এমনটাই প্রত্যাশিত।

তবে যে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন আমরা দেখি, সেই স্বপ্নের সারথি রাজনৈতিক দলগুলো আসলে কতটা গণতান্ত্রিক? গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া কতটুকু অনুসরণ করা হয় সেসব দলের ভেতরে? সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া ও নেতৃত্ব নির্বাচনে?

রাজনৈতিক দলগুলোর অন্দরমহলে উঁকি দিলে মোটাদাগে হতাশাজনক চিত্রই চোখে পড়ে। বঙ্গীয় ভূখণ্ড বহু আগেই রাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা দূরে ফেলে এলেও বাংলাদেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে এখনও পরিবারতন্ত্রের চর্চা বিদ্যমান। দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে এমনকি তৃণমূলের ওয়ার্ড পর্যায়েও বংশানুক্রমিক ধারার জয়জয়কার। শীর্ষ নেতৃত্বে তো ‘রাজরক্তের’ বাইরে যাওয়ার নজির একেবারেই বিরল! এসব রাজাধিরাজ শীর্ষ নেতৃত্ব কদাচিৎ গণতান্ত্রিক পথে দল পরিচালনা করেন। বরং দলের মধ্যে প্রচলিত স্বৈর সংস্কৃতিই প্রতিফলিত হয় যখন তারা দেশের শাসনভার হাতে পান।

বাংলাদেশে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল, যারা অতীতে সরকার গঠন করেছিল, প্রতিটি দলে একই চিত্র বিদ্যমান। একক ব্যক্তি ও পরিবারের হাতে দলের সর্বময় ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখা; বছরের পর বছর কাউন্সিল না করা; কাউন্সিল করলেও ভোটের পরিবর্তে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের ইচ্ছানুসারে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে পছন্দের লোক বসানো; সিদ্ধান্ত গ্রহণে দলের তৃণমূল ও সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যদের মতামত দেওয়ার সুযোগ সীমিত করা; শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে মতবিরোধ দেখা দিলেই বহিষ্কার– লিখতে গেলে অভিযোগের তালিকা কেবল দীর্ঘতরই হবে। সবচেয়ে বড় সমস্যা প্রতিটি দলেই নেতৃত্ব দানকারী ‘একক ব্যক্তি ও পরিবারকে’ এমন পূজনীয় অবস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে নির্ভয়ে কথা বলারন দুঃসাহস দলের কোনো নেতাকর্মীর নেই। রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রচলিত আইন, যেমন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও), নির্বাচন কমিশনের রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন আইনের ধারার নিয়মিত অবমূল্যায়ন করে গেছে দলগুলো। এমনকি নিজ নিজ দলের গঠনতন্ত্র মেনে চলার ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক দলগুলোর অনীহা প্রকট। দলের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ঘাটতিই এর প্রধান কারণ। আইন ও নিয়ম মেনে কোনো দলই পরিচালিত হয় না। কিছু দলের বিরুদ্ধে তো টাকা দিয়ে পদবি বেচাকেনার অভিযোগও রয়েছে।

প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের বাইরে অন্য দলগুলোর অবস্থাও অভিন্ন। ছোট, বড়, মাঝারি–অধিকাংশ দলই ব্যক্তি ও পরিবারকেন্দ্রিক। দলের নীতিনির্ধারণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে এক ব্যক্তির শাসন বিদ্যমান। জনগণের সঙ্গেও এসব দলের যোগাযোগ সীমিত। বিগত কয়েক দশকে জোটের রাজনীতি মুখ্য হয়ে ওঠায় অনেক দলই রাজনীতিতে টিকে আছে সত্যি, কিন্তু একই কারণে অনেক দল স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে আদর্শগত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তাদের জোটসঙ্গী বড় দলের মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে।

বাংলাদেশের সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের ১১ অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে বলা আছে– ‘প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।’ জনপ্রতিনিধিরাই গণতন্ত্রের প্রাণ। কাজেই জনপ্রতিনিধি যেন সত্যিকার অর্থেই জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে এবং সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ পদ্ধতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়– সেটা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের পাশাপাশি সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলেরও সাংবিধানিক দায়িত্ব। এ ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি, অর্থ ও বাহুবলের বাইরে গিয়ে নিজ দলের প্রার্থী নির্দিষ্ট এলাকার সাধারণ মানুষের কাছে কতটা গ্রহণযোগ্য– দলের তৃণমূলের কর্মীরাই বা তাঁকে কতটুকু সমর্থন করে, তাও রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্ধারণ করতে হবে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যেখানে রাজনীতিতে বংশপরম্পরার বিস্তর প্রভাব বিদ্যমান, সেখানে সত্যিকার যোগ্য ও সৎ জনপ্রতিনিধি নির্ধারণ এবং নির্বাচন বেশ জটিল প্রক্রিয়া। দলীয় প্রার্থী নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো নিজ নিজ আসনের সাধারণ মানুষের মতামত নেবে– এমনটা আশা করা দুরূহ। কিন্তু নিজ দলের সাধারণ কর্মীদের ভোটের মাধ্যমেও যদি প্রার্থী নির্বাচন করা হয়; অন্তত দলের মধ্যকার গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের সাধারণ জনগণের সামনে উপস্থাপন করার সুযোগ সৃষ্টি হবে।

প্রায় সব রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্রেই কাউন্সিলের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচনের কথা বলা আছে। জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনের প্রার্থী মনোনয়নেও একই বিধান কাম্য। অথচ প্রায়োগিক বিচারে এসব শুধুই আলঙ্কারিক। দলের নেতৃত্ব বা প্রার্থী মনোনয়ন– সর্বক্ষেত্রে দলের শীর্ষকর্তাদের প্রেসক্রিপশনেই নির্ধারিত হয় কোন এলাকায় কারা পাবেন দলীয় প্রতীক। অধিকাংশ দলই যখন অভিন্ন পদ্ধতিতে প্রার্থী নির্ধারণ করে তখন জনসাধারণের সামনে ভোট দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত বিকল্প থাকে না। ফলে এমন ত্রুটিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত ‘জনপ্রতিনিধিরা’ জনগণের সত্যিকার আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে ব্যর্থ হন।

এ তো গেল রাষ্ট্রের নির্বাচন প্রক্রিয়া যদি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ হয় তখনকার চিত্র। কিন্তু সেখানেই যদি গলদ থাকে (যেমনটা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ছিল), তাহলে তো গণতন্ত্রের তল্পিবাহক জনপ্রতিনিধিরা সত্যিকার অর্থে জনগণের প্রতিনিধিই থাকেন না! ফেলে আসা গণতন্ত্রের কৃষ্ণপক্ষে বড় এক দলের টিকিট পাওয়া মানেই ছিল কার্যত নির্বাচিত হয়ে যাওয়া, জনগণের ভোট সেখানে গৌণ! পৃথিবীজুড়েই গণতন্ত্রের উত্থান-পতন রয়েছে। প্রযুক্তির নানামুখী পরিবর্তনে গণতন্ত্রও প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। প্রযুক্তি গণতান্ত্রিক শাসনকে যেমন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে, আবার জনবান্ধবও করে তুলছে। অথচ বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখনও সেই মৌলিক অবস্থা অর্থাৎ জনগণের ‘ভোটের অধিকার’ নিশ্চিত করতেই হিমশিম খাচ্ছে!

আগস্ট অভ্যুত্থানের ফলে শুরু হওয়া সংস্কারকালে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সামনেও সুযোগ এসেছে নিজ নিজ দলের কার্যপ্রণালি পুনর্মূল্যায়ন ও সংস্কারের। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ভেতরকার গণতন্ত্র নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলে দেশের শাসন ব্যবস্থায় সেই একই ব্যর্থতা বারবার প্রতিফলিত হবে। দেশের এই ক্রান্তিকালে রাজনৈতিক দলগুলো সচেতন হবে; সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াবে এবং দলের সর্বস্তরে প্রকৃত গণতন্ত্রের চর্চা শুরু করবে, এটিই প্রত্যাশা।

দৈনিক সমকাল