রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ সংস্কার ও ছাত্রদের আয়োজন
Share on:
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ভাঙচুর ও মারধরের ঘটনার বিচার ও নিরাপত্তার দাবিতে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচিতে রোববার সকাল থেকে ১২ ঘণ্টা সব ধরনের সেবা বন্ধ রাখেন চিকিৎসকরা।
রাজধানীর বাইরের সরকারি হাসপাতালগুলোতেও একই পরিস্থিতি ছিল। রোববার রাতে চিকিৎসকরা শর্তসাপেক্ষে কর্মসূচি স্থগিত ঘোষণা করলেও বহির্বিভাগসহ অন্যান্য সেবা বন্ধের ঘোষণা অপরিবর্তিত রাখেন। প্রত্যেক চিকিৎসকই নিরাপত্তারক্ষী দাবি করছেন। অবহেলাজনিত কারণে এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর অভিযোগে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ঢুকে দায়িত্বরত চিকিৎসককে উত্তেজিত ছাত্রদের হামলা কিংবা হাসপাতালের অভ্যন্তরে প্রতিপক্ষকে রক্তাক্ত করার মতো নৃশংস যে দৃশ্যের অবতারণা ঢাকা মেডিকেলে দেখা গেল, তাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলার উপায় নেই।
এর আগের সপ্তাহে সচিবালয়ে আনসারদের উন্মত্ত আচরণ, দেশজুড়ে বিদ্যালয়-মহাবিদ্যালয়ে শিক্ষকদের ওপর শিক্ষার্থীদের হামলা ও পদত্যাগের হিড়িক থেকে প্রায়ই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে। চিকিৎসাধীন একজন ছাত্র মারা গেছে– চাইলেই এর প্রতিবাদে ছাত্রের বন্ধু-স্বজনরা চিকিৎসকের ওপর হামলে পড়তে পারেন? ন্যূনতম নৈতিকতা বা নিয়মকানুন অবশিষ্ট থাকবে না? প্রকৃত কোনো ছাত্রই এ ধরনের অনৈতিক আচরণে জড়াতে পারেন না। আইনশৃঙ্খলাবিরোধী প্রতিটি ঘটনা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে শক্ত হাতে মোকাবিলা করতে হবে। আজ সচিবালয়, কাল হাসপাতাল, পরশু অফিস-আদালতে ‘পাবলিক ন্যুইসেন্স’ সৃষ্টি করে সরকারের সামর্থ্য নিয়েই সংশয় তৈরির অপচেষ্টা দৃশ্যমান। সরকারের বয়স এক মাসেরও কম– বিড়াল প্রথম রাতেই মারতে হবে। আইনের ব্যত্যয় ঘটালে, তিনি যে বা যারাই হোন না কেন; তাদের বিচারের মুখোমুখি হতেই হবে।
ছাত্রদের নিজেদের মূল কাজ সম্পর্কে স্থিরতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কথায় কথায় উত্তেজিত হয়ে দলবেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়ার যে প্রবণতা, সেটা বাদ দিয়ে যার কাজ তাকে করার পরিসর দিতে হবে। নিজেদের প্রস্তুত করতে হবে পেশাদারি কাজের জন্য, তাই শ্রেণিকক্ষে মনোযোগী হতে হবে। যে অকুতোভয় ছাত্ররা বুকের তাজা রক্তে স্বৈরাচারী দুঃশাসককে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে, তারা নিশ্চয়ই নিজেকে আর নিজের চারপাশকে সহজেই গড়ে তুলতে পারে। নিজেকে শোভন-সুন্দরভাবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে উপযুক্ত প্রশ্ন করার কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য হামলা, চিৎকারের প্রয়োজন পড়ে না; প্রয়োজন যুক্তিসংগত আচরণ, তথ্য আর তত্ত্বের সমন্বয়, জ্ঞানচর্চার যথার্থ পরিবেশ।
আশার কথা, সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে অগ্রসর ছাত্রছাত্রীরা গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী রাষ্ট্র সংস্কারসহ দেশের সংবিধান, বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা ও মতামত বিনিময়ের আয়োজন করছে। ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অফুরন্ত সম্ভাবনার যে বাংলাদেশ আমাদের সমুখে– তাকে মানবিক, বৈষম্যহীন ও ন্যায়ভিত্তিক করে গড়ে তুলতেই ছাত্রদের এসব আয়োজন। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, মেধাবী ছাত্রদের অনবরত তর্ক ও যুক্তি-পাল্টা যুক্তিতে বহুমতের অসাম্প্রদায়িক সমৃদ্ধ বাংলাদেশ তৈরির পথ ক্রমশ
প্রশস্ত হচ্ছে।
২.
দেড় দশকের আওয়ামী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানের প্রধান শক্তি ছাত্রছাত্রীদের অকুতোভয় সাহস, বীরত্ব ও অপরিসীম আত্মত্যাগ। বলা বাহুল্য, এতে সাধারণ জনতার পাশাপাশি আওয়ামীবিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলোর অবশ্যই অংশগ্রহণ ছিল। অবশ্য পরপর তিনবার নিজেদের মতো করে এককভাবে আওয়ামী লীগ নির্বাচন করে যে ক্ষমতার কঠিন বলয় তৈরি করেছিল, তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারেনি প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। তাই বহুবার বহুভাবে কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম করেও চূড়ান্ত সাফল্যের মুখ তারা দেখেনি। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ৮ আগস্ট ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দল যেমন যৌক্তিকভাবেই জাতীয় নির্বাচন চাইছে, একইভাবে নিজেদের ভুলত্রুটি সম্পর্কেও তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন। যে রাষ্ট্র সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা সবাই উপলব্ধি করছেন; সেই রাষ্ট্র যারা পরিচালনা করবেন, সেই রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কারও গুরুত্বের সঙ্গে সম্পন্ন করতে হবে। রাজনৈতিক দলে স্বৈরশাসন, ব্যক্তিবলয়, পরিবার প্রথা ও ব্যক্তিপূজা চলতেই থাকবে; অর্থাৎ রাজনৈতিক দল চলবে রাজতন্ত্রের আদলে; আর রাষ্ট্রে আপনি চাইবেন অবারিত গণতন্ত্র, মুক্ত বাক্স্বাধীনতা– সম্ভবত একেই বলে ‘সোনার পাথরবাটি’!
৩.
১৯৮১ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর ছন্নছাড়া বিএনপির হাল ধরেন খালেদা জিয়া। ১৯৮৩ সালে তিনি ভাইস চেয়ারম্যান ও ১৯৮৪ সালে চেয়ারপারসন হয়ে পরবর্তী চার দশক দলের প্রধান নেতার আসনে ছিলেন। আশির দশকে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তিনি ‘আপসহীন নেত্রী’ পরিচিতি পান। ১৯৯০-এর গণআন্দোলনে স্বৈরাচারী এরশাদের পতন হয়। নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করে ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় আসে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি।
তিন জোটের যে রূপরেখা অনুসরণে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে মানুষ প্রাণপণে লড়ে যায়, আন্দোলন-উত্তর সরকার গঠনের পর বিএনপি সেই রূপরেখা ভুলে যায়। যে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের লক্ষ্যে এত দীর্ঘ আন্দালন ও প্রাণক্ষয়; ক্ষমতায় যাওয়ার পর সেই নিরপেক্ষ সরকার সম্পর্কে খালেদা জিয়া বলেন, ‘কেবল পাগল ও শিশুরাই নিরপেক্ষ!’ সেই শুরু, তারপর যখনই বিএনপি বা আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকেছে, প্রত্যেকে ক্ষমতা ধরে রাখতে নানা কৌশলে নির্বাচন ব্যবস্থাকে কুক্ষিগত করেছে! তারই অনিবার্য ফল হিসেবে ২০০৭ সালে মইনউদ্দীন-ফখরুদ্দীনের সেনা-সমর্থিত ওয়ান ইলেভেনের সরকার জাতির কাঁধে দুই বছরের জন্য সওয়ার হয়!
এরপর আবারও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে এবং আবারও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তার কথা শুধু অস্বীকারই করে না, নানা ধরনের প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে একের পর এক পাতানো নির্বাচনের ব্যবস্থা করে। ভোট দিতে না পারায় মানুষ যেমন একদিকে নিজেদের প্রতারিত ভাবতে থাকে; অন্যদিকে জবাবদিহিশূন্য পরিস্থিতিতে আওয়ামী নেতারা দিন দিন দম্ভ ও অহংকারের সকল সীমা ছাড়িয়ে যেতে থাকেন। সমাজে জেঁকে বসে দুর্নীতি, অনিয়ম ও দুঃশাসনের যাবতীয় কালাকানুন।
২০০১ থেকে ২০০৬ বিএনপির শাসনামলের শেষ দু-তিন বছরেও দুর্নীতি, অনিয়ম ও দুঃশাসনের একের পর এক নজির আমরা দেখেছি। আওয়ামী আমলের ‘আয়না ঘরে’র মতো বিএনপির ‘হাওয়া ঘরে’র নানা কুকীর্তি মানুষের মুখে মুখে ফিরেছে। আওয়ামী লীগ শাসনামল যেমন এককভাবে শেখ হাসিনাকে ঘিরে ঘূর্ণায়মান হয়েছে, তেমনি বিএনপির সবকিছুই খালেদা জিয়ার নির্দেশমতোই চলেছে। দুই দফাতেই প্রধান দুই নেতার পারিবারিক বলয় ক্ষমতাচর্চার কেন্দ্রে আবর্তিত হয়েছে। আর সংবাদমাধ্যম, ব্যবসা-প্রশাসন? সবই শেখ হাসিনা অথবা খালেদা জিয়ার প্রশংসায় অষ্টপ্রহর নিবেদিত; কোনো কোনো সংবাদপত্র সাদাকে সাদা অথবা কালোকে কালো বললে সেগুলোকে সরকারি বিজ্ঞাপন বঞ্চনাসহ বিভিন্নভাবে নাজেহাল হতে হয়েছে।
বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দুই দল মিলে দেশকে দুর্নীতিতে পরপর পাঁচবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন করে জাতিকে লজ্জায় ডুবিয়েছে। তারপরও তারা দুর্নীতির জন্য নিজ নিজ দলের কোনো নেতার বিরুদ্ধে ন্যূনতম শাস্তির উদ্যোগ নেয়নি। এ দেশে এমপি হওয়া মানে সোনার হরিণের খোঁজ পাওয়া, একেকজন এমপির পাঁচ বছরে সম্পদের পরিমাণ যে হারে বাড়ে তাতে মনে হয়, দেশে রাজনীতির চেয়ে লাভজনক কোনো পেশা আর নেই। জাতীয় পর্যায়ের নেতাদের পাশাপাশি শহর থেকে গ্রাম পর্যায়ে বিএনপি ও আওয়ামী রাজনীতিবিদদের প্রবণতা একই। দখল ও দুর্নীতিই তাদের প্রধান লক্ষ্য। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছ থেকে আগামী নির্বাচনের রোডম্যাপ আদায়ে বিএনপি এখন শশব্যস্ত। এর পাশাপাশি নিজের ঘরের ভেতরের সংস্কারের দিকে বিএনপিকে পূর্ণ মনোযোগ দিতে হবে। দলে একনায়কতন্ত্র রেখে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা অসম্ভবকল্পনা। জামায়াত, জাতীয় পার্টিসহ বাম দলগুলো ক্ষমতার বড় ভাগীদার নয়; তাদের দুর্নীতির সুযোগ তাই কম। তারপরও দলের ভেতর গণতন্ত্রের চর্চাহীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাদের নৈতিক দৃঢ়তার অভাব জাতিকে বিভিন্ন সময় দুর্দশায় ফেলেছে।