রাঘববোয়াল সালমান এফ রহমানের পরিণতি থেকে শিক্ষা নেয়া উচিৎ
Share on:
ক্ষমতাচ্যুত সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তি, শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ সহযোগী সালমান এফ রহমান যেভাবে দাড়ি কেটে, চুলে রং দিয়ে, লুঙ্গি পরে ছদ্মবেশে নদীপথে পালিয়ে যাচ্ছিলেন, সেটা কয়েক সপ্তাহ আগেও অভাবনীয় ছিল।
গত ১৩ আগস্ট তাঁর ধরা পড়ার যেসব ছবি সামাজিক মাধ্যম ও সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে, সেটা খুবই করুণ। দেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাতের সবচেয়ে বড় রাঘববোয়াল সালমান এফ রহমানের এই করুণ ছদ্মবেশ জনসাধারণের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই হাসির হুল্লোড় ফেলে দিয়েছে।
সালমান এফ রহমানকে ধবধবে সাদা দাড়ি, সাদা চুলওয়ালা ও সাদা পাঞ্জাবি পরা অবস্থায় প্রায় সব সময় দেখা যেত বলে জনগণের বিরাট অংশ তাঁকে কৌতুক করে ‘দরবেশ’ নামেই ডাকত। ঋণখেলাপিসহ নানা দুর্নীতির বিপরীতে তাঁর ওই বেশভূষা একেবারেই বিপরীত বার্তা পৌঁছে দিত সবার কাছে। সালমান রহমানের এমন স্বভাব পাঁচ দশক ধরেই। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি বিনিয়োগ ও শিল্প উপদেষ্টার পদটি বাগানোর বহু বছর আগে থেকেই।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকায় ১৫ আগস্ট প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, গত ৫২ বছরে সালমান রহমান ব্যাংকিং খাতের সাতটি ব্যাংক থেকে ৩৬ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। শুধু জনতা ব্যাংক থেকেই তাঁর কোম্পানি ঋণ নিয়েছে ২৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। তাঁর মালিকানার আইএফআইসি ব্যাংক থেকেই নাকি অবৈধভাবে ঋণ নিয়েছেন ১১ হাজার কোটি টাকার বেশি। এই বিপুল ঋণের অতি ক্ষুদ্র অংশই ব্যাংকে ফেরত এসেছে বা ভবিষ্যতে আসবে। এর মানে, সালমান গ্রেপ্তার হয়ে মামলা-মোকদ্দমার আসামি হওয়া সত্ত্বেও খেলাপি ঋণ হিসেবে এই হাজার হাজার কোটি টাকা চিরতরে আত্মসাৎ হয়ে যাবে বিদেশে পাচার হয়ে।
১৯৭২ সালে তাঁর বড় ভাই সোহেল এফ রহমানের সঙ্গে পার্টনারশিপে সালমান গড়ে তুলেছিল বাংলাদেশ এক্সপোর্ট ইমপোর্ট কোম্পানি বা ‘বেক্সিমকো’। সালমান ও সোহেল রহমান ছিলেন পাকিস্তান আমলের রাজনীতিবিদ ফজলুর রহমানের পুত্র। তিনি ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর লিয়াকত আলি খানের মন্ত্রিসভায় শিক্ষামন্ত্রী হয়েছিলেন তাঁর বাঙালিবিরোধী রাজনৈতিক অবস্থানের জন্য। ১৯৪৮-৫২ সালে যখন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার তোড়জোড় চলেছিল, তখন ফজলুর রহমান উর্দুর পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। ১৯৪৮ সালে প্রথম ভাষা আন্দোলনের জনপ্রিয়তায় ভয় পেয়ে যখন তদানীন্তন সরকার বাংলাকেও অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হবে বলে জনগণের সঙ্গে প্রতারণার খেলা শুরু করেছিল, তখন ফজলুর রহমান হঠাৎ প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে উর্দুর মতো বাংলাও আরবি হরফে ডান থেকে বামে লেখার ব্যবস্থা করলে উর্দুভাষীরা সহজে বাংলা শিখে নিতে পারবে। অত্যন্ত ঘৃণাভরে তাঁর ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল পূর্ব বাংলার আন্দোলনকারী জনগণ।
শিক্ষামন্ত্রী থাকার সুবাদে ফজলুর রহমান পূর্ব বাংলা থেকে বিদেশে পাট রপ্তানির একটা লাইসেন্স বাগিয়ে নিয়েছিলেন; যার সঙ্গে পরে যুক্ত হয়েছিল একটি ‘জুট বেইলিং মিল’। ষাটের দশকে পাট রপ্তানি ব্যবসা ও আমদানি ব্যবসার মাধ্যমে প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক হয়েছিলেন তাঁর পুত্ররা। ধানমন্ডিতে একটি প্রাসাদোপম বাড়িও নির্মাণ করেছিলেন ফজলুর রহমান; যার সুবাদে শেখ কামালের বাল্যবন্ধু ও খেলার টিমমেট হয়ে উঠেছিলেন সালমান এফ রহমান। ষাটের দশকে যখন ফজলুর রহমানের মৃত্যু হয় তখন তাঁর শেষ ইচ্ছানুযায়ী তাঁকে তদানীন্তন পাকিস্তানের রাজধানী করাচিতে দাফন করা হয়।
শেখ কামালের সঙ্গে বন্ধুত্বের সূত্রেই স্বাধীনতার পর তাঁর প্রতিষ্ঠিত ক্লাব ‘আবাহনী ক্রীড়া চক্রের’ সবচেয়ে বড় ফাইন্যান্সিয়ারের ভূমিকা গ্রহণ করেন সালমান এফ রহমান। ৫২ বছর ধরে আবাহনী ক্লাবের মাধ্যমে দেশের ক্রীড়া জগৎকে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছেন সালমান। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনে সালাউদ্দিনের ক্ষমতারও মূল ভিত্তি সালমান।
মজার ব্যাপার, বেক্সিমকোর বেশির ভাগ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে লোকসানি প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখানো হয় বছরের পর বছর। তা সত্ত্বেও বেক্সিমকোর কোনো প্রতিষ্ঠানেরই ব্যাংকঋণ পেতে কখনোই বেগ পেতে হয়নি চার দশক ধরে। ১৯৮৩ সালে স্বৈরাচারী এরশাদ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর সালমানের সঙ্গে তাঁর দহরম-মহরম জনগণের আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে। তাঁকে একটি প্রাইভেট ব্যাংকের লাইসেন্স দেন এরশাদ। নব্বই দশকে রাজনীতিতে আসেন সালমান। ‘সমৃদ্ধ বাংলাদেশ আন্দোলন’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন এবং ১৯৯৬ সালের জুনের নির্বাচনে অংশ নেন। জামানত হারানোর পর আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ১৯৯৬ ও ২০১০ সালের শেয়ার মার্কেট ধসের পেছনেও সালমানের ভূমিকা সর্বজনবিদিত। কিন্তু এ সম্পর্কিত তদন্ত রিপোর্টে সেই ভূমিকা প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও শাস্তি পাননি ক্ষমতাসীন মহলের আশীর্বাদে।
২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করলেও সালমান তাঁর চাচা নাজমুল হুদার কাছে হেরে যান। ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনে সালমান সংসদ সদস্য হয়ে ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন। ২০১৮ সালে ‘রাতের ভোট’ নির্বাচনের কিছুদিন আগে তিনি হাসিনার অত্যন্ত প্রিয়ভাজন হয়ে ওঠেন। ওই জালিয়াতিপূর্ণ নির্বাচনের পর হাসিনা সালমানকে মন্ত্রীর মর্যাদায় তাঁর বেসরকারি বিনিয়োগ ও শিল্প উপদেষ্টা বানান। বলতে গেলে ২০১৯-২৪ পর্যায়ে হাসিনার সরকারের অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণে সালমানই ছিলেন দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। ২০১৯ সালে আ হ ম মুস্তফা কামাল অর্থমন্ত্রী হলেও যাবতীয় অর্থনৈতিক ও ব্যবসা-সংক্রান্ত সরকারি নীতি শেখ হাসিনা গ্রহণ করতেন সালমান রহমানের পরামর্শমতো। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর থেকে শুরু করে সব রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বোর্ডের পরিচালক নিয়োগে সালমানের সিদ্ধান্তই ছিল প্রধান নিয়ামক।
ব্যবসায়ী সমাজের নেতৃত্বদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে অন্তর্ভুক্ত হতে হলেও ব্যবসায়ীদের অতি অবশ্যই সালমানের আস্থা অর্জন করতে হতো। শেষের দু-তিন বছর অর্থমন্ত্রী কামালের নিষ্ক্রিয়তা দেশের আলোচনার মূল খোরাক জোগালেও ওয়াকিবহাল মহলের জানা ছিল যে আদতে দেশের অর্থনীতি পরিচালনা করছেন সালমান। অর্থনীতিও ২০২১ সালের পর ক্রমশ বিপর্যয়ের গিরিখাতে ধাবিত হতে থাকে; কিন্তু ব্যাংকঋণ লুণ্ঠন থেকে দূরে সরানো যায়নি সালমানকে। গত পাঁচ বছর দেশের যাবতীয় লোভনীয় নতুন ব্যবসায় সবার আগে চোখ পড়ত সালমানের।
২০১৯ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পর একাদিক্রমে ছয়টি অদ্ভুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্যাংকের ঋণখেলাপিদের অভূতপূর্ব সুবিধা প্রদানের যে কাণ্ড শেখ হাসিনার সরকার সৃষ্টি করেছিল, তার প্রতিটিই সালমানের নির্দেশে বাস্তবায়ন করেছিলেন অর্থমন্ত্রী কামাল। এসব সিদ্ধান্তের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল ২ শতাংশ খেলাপি ঋণ ব্যাংকে জমা দিলে দশ বছর পর্যন্ত আর ওই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ঋণখেলাপির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। এ সুবিধা ব্যবহার করে দ্রুত দেশের সব রাঘববোয়াল ঋণখেলাপি নিজেদের ঋণখেলাপির তালিকা থেকে বের করে নিয়েছেন। পত্রিকা-কলাম ও টকশোগুলোতে আমি এই নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ জানিয়ে এসেছি।
২০২০ সালে একুশে টেলিভিশনের একটি টকশোতে আমি সালমানকে দেশের সবচেয়ে বড় ঋণখেলাপি অভিহিত করায় ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি আমার বিরুদ্ধে ২০২০ সালের ২০ মার্চ একটি ‘উকিল নোটিশ’ পাঠিয়েছিলেন। সেখানে বলা হয়েছিল, এক সপ্তাহের মধ্যে পত্রপত্রিকায় স্টেটমেন্ট দিয়ে ক্ষমা চাইতে হবে, নইলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আমিও ওই ২ শতাংশ খেলাপি ঋণ ফেরত দেওয়ার অন্যায় সুবিধার কথা উল্লেখ করে উকিল নোটিশের জবাবে তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছিলাম যে তাঁর আর ঋণখেলাপির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কারণ নেই। গত চার বছরে এ ব্যাপারে আর কোনো পদক্ষেপ তিনি গ্রহণ করেননি।
হায়, সেই প্রতাপশালী সালমানের এমন পরিণতি! অন্যরা কি সেখান থেকে শিক্ষা নেবেন?