মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: বুধবার ১৮, সেপ্টেম্বর ২০২৪

যুবাদের উন্নত কর্মসংস্থানে মজুরি সংস্কারের উদ্যোগ নিন

Share on:

আন্তর্জাতিক সমমজুরি দিবসের প্রাক্কালে বাংলাদেশের শ্রমবাজারের অবস্থা, বিশেষ করে নারী ও যুবাদের জন্য বিদ্যমান পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোকপাত করা গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে যুবসমাজ সাম্য, ন্যায্যতা ও শোভন কাজে অংশগ্রহণের সুযোগের দৃঢ় ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে ভবিষ্যৎ গঠন করতে চায়।


কিন্তু বাস্তব চিত্র অনেকটাই ভিন্ন। এখনও বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ এই মূল ভিত্তি থেকে অনেকটা দূরে। এখনও দেশের বহুসংখ্যক যুবা কর্মহীন, স্বল্প মজুরির কাজে নিযুক্ত এবং মজুরি বৈষম্যের শিকার। প্রতিনিয়ত তারা কাঠামোগত প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে লড়াই করে চলেছে, যা তাদের শিক্ষা, দক্ষতা এবং কর্মক্ষেত্রে উন্নতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের মধ্যবর্তী এই দূরত্ব অনেক ক্ষেত্রে যুবসমাজকে হতাশ ও নিরাশ করছে। দেশে প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ যুবা শ্রমবাজারে প্রবেশ করে। অনেকেই যোগ্যতার বিচারে সঠিক কাজ খুঁজে পায় না। যারা পায়, অনেককেই জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় মজুরির চেয়ে অনেক কমে কাজ শুরু করতে হয়। শ্রমবাজারে মজুরি বৈষম্য প্রকট। কৃষিক্ষেত্রে যেখানে নারীর অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য হারে বেশি, সেখানে সমকাজের জন্য নারী তার পুরুষ সহকর্মীর চেয়ে ৩১.৫ শতাংশ কম উপার্জন করে। মালিকপক্ষের মধ্যে অনেক সময় কর্মক্ষেত্র উপযোগী দক্ষ শ্রমিকের জোগান নিয়ে হতাশা পরিলক্ষিত হয়।

বাংলাদেশে মজুরি কাঠামো নির্ধারণ এখনও অনেক ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারী, অস্বচ্ছ ও অন্যায্য। যুবা শ্রমিক, বিশেষত যারা অনানুষ্ঠানিক কর্ম খাতে নিযুক্ত এবং শ্রমবাজারের ৮৫ শতাংশ, তারা বেশি বৈষম্যের শিকার। মজুরি বৈষম্যের সঙ্গে যুক্ত হয় মজুরিজনিত অনিরাপত্তা, অন্যান্য সুবিধার অনুপস্থিতি এবং কর্মক্ষেত্রে অগ্রসর হওয়ার সুযোগের অভাব। যুবাদের জন্য মজুরি ও কর্মক্ষেত্রে অগ্রসর হওয়ার এই অনিশ্চিত পরিস্থিতি উদ্বেগজনক।

জাতীয় সর্বনিম্ন বেতন কাঠামো মূল্যস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হওয়া পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটাচ্ছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা-আইএলওর বৈশ্বিক মজুরি প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে বার্ষিক মজুরি পতনের হার ৫.৯ শতাংশ, যা এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এর অর্থ, মজুরি স্বল্পহারে বাড়লেও তার ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। ফলে শ্রমিক, বিশেষ করে যুবাদের জীবনধারণ আরও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই সময়ে ব্যাপক ও প্রমাণভিত্তিক মজুরি নির্ধারণ ব্যবস্থা প্রয়োজন। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে মজুরি নির্ধারণে মজুরি ধারণা, ন্যায্যতা ও স্বচ্ছতা আনা সম্ভব, যা নিশ্চিত করবে শ্রমিকরা তাদের শ্রম অনুযায়ী এবং মূল্যস্ফীতি ও জীবন ধারণের ন্যূনতম ব্যয়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ মজুরি পাচ্ছে। মজুরি নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় জেন্ডারভিত্তিক ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী, প্রতিবন্ধীর প্রতি বিদ্যমান মজুরি বৈষম্য কমিয়ে এনে সবার জন্য ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা যাবে।

দারিদ্র‍্য বিমোচনেও এই প্রমাণভিত্তিক জাতীয় মজুরি নির্ধারণ ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তৈরি পোশাকশিল্প খাতে ন্যূনতম বেতন কাঠামো নির্ধারণে বাংলাদেশ প্রভূত উন্নতি করেছে, যা অন্য খাতেও ছড়িয়ে দিতে হবে। আন্তর্জাতিক শ্রম মান, বিশেষ করে সমমজুরিবিষয়ক আইএলও কনভেনশন ১০০-এর সঙ্গে সংগতিপূর্ণ জেন্ডার অন্তর্ভুক্তিমূলক মজুরি কাঠামো সব বৈষম্যের ঊর্ধ্বে সবার জন্য ন্যায্য মজুরি নিশ্চিতে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করবে। মজুরি স্বচ্ছতার প্রসার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।

মজুরি নির্ধারণ ছাড়াও বেশ কিছু বিষয় বাংলাদেশের শ্রমবাজারে যুবাদের অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণের পথে বাধা সৃষ্টি করছে। বাজারে দক্ষতা এবং যোগ্যতার চাহিদা ও জোগানের মধ্যকার পার্থক্য, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের নিম্নমান এবং ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং ধরনের জরুরি সহায়তার অভাব এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ। এসব বিষয়ে সমানভাবে আলোকপাত প্রয়োজন।

এ ছাড়া নিয়োগের অনানুষ্ঠানিকতা এবং শ্রমিকদের জন্য সামাজিক সুরক্ষার অভাব কাঠামোগত ও সুশাসনজনিত প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে, যা যুবাদের আরও দারিদ্র্যের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। যুব নারী, প্রবাসী শ্রমিক ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এসব প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হচ্ছে তীব্র হারে। সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিবন্ধকতা।

এসব প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েও বাংলাদেশের যুবসমাজ অর্থপূর্ণ সংস্কার আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ন্যায়ের পক্ষে তাদের দৃপ্ত অবস্থান থেকে এই যুবারা ইতোমধ্যে অধিক স্বচ্ছতা, ন্যায্য মজুরি কাঠামো এবং জেন্ডার সাম্যের জন্য লড়ে যাচ্ছে। যুব নেতৃত্বাধীন সংগঠনগুলো মজুরি বৈষম্য বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তুলতে এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক শ্রমবাজার নীতির পক্ষে জোর প্রচারণা চালাচ্ছে।

ন্যায্য ও স্বচ্ছ শ্রমশক্তি তৈরির লক্ষ্যে শ্রমবাজার প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা এবং সংলাপে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা জরুরি। শ্রমিক ও মালিকদের বিভিন্ন সংগঠনে তাদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে শ্রম ও মজুরি অধিকার নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মতামত প্রতিফলিত হবে।

আন্তর্জাতিক সমমজুরি দিবসে একটি শ্রমবাজার, যা সবার জন্য বিশেষত ভবিষ্যতের বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বকারী যুবসমাজের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি ও অধিকার রক্ষায় আমাদের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করছি। মজুরি বৈষম্য নিরসন এবং স্বচ্ছতার ব্যাপক প্রসারের মাধ্যমে আমরা গড়ে তুলতে চাই ন্যায়ের বাংলাদেশ, যেখানে প্রত্যেক যুব ও যুব নারী কর্মক্ষেত্রে তাদের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটাতে পারবে। আইএলওর পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, শ্রমিক ও মালিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়নে আমরা একযোগে কাজ করতে বদ্ধপরিকর।

দৈনিকসমকাল