যানবাহনে টোল নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের ভাবনা কী?
Share on:
সদ্য ক্ষমতাচ্যুত সরকার আট লেনের ঢাকা-চট্টগ্রাম বা ছয় লেনের ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক সংস্কারের সময় টোল আদায় করা যায় কিনা– ভাবছিল। জনগণ ধরে নিয়েছিল, সরকার যে কোনোদিন এ ব্যাপারে আদেশ জারি করবে। এরই মাঝে বিশাল পট পরিবর্তন ঘটে গেল এবং গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব নিল।
এই মাস দেড়েক আগেই একনেকের প্রতিটি সভায় হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন পেয়েছে। হয়তো তারা ভেবেছিল, জনকল্যাণে এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থের জোগানদাতা জনগণকেই হতে হবে। সরকার জনগণের পকেট থেকে অর্থ বের করে কোষাগারে নিয়ে যাওয়ার চিন্তা করেছে, সেখানে জনকল্যাণের কোনো ভাবনার জায়গা ছিল বলে মনে হয় না। দেশের ভিআইপিদের জন্য যেসব সড়ক নির্মাণ করা হয়েছিল, তা সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েও যানজটমুক্ত শহর এখনও অধরা। তবে রাজস্ব আদায় অনুমানের চেয়ে অনেক বেড়েছে।
অতীত জনগণকে শিখিয়েছে যে, বিত্তবানদের কাছ থেকে সরকার যদি এক টাকা নেয়, তাহলে তার সঙ্গে সাধারণের কাছ থেকে আরও ১০ টাকা বেশি আদায় করেই ছাড়ে। টোল আদায়ের পরিকল্পনার এটাও অন্যতম লক্ষ্য।
এদিকে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় সড়ককে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার ফলে বিকল্প ব্যবস্থাগুলো যোজন যোজন দূরে পড়ে আছে। নদীমাতৃক বাংলাদেশে পরিকল্পিতভাবে নদনদী নজরের বাইরে রেখেছে। ফলে নদীগুলো কেউ দখল করেছে, কেউ দূষণ করেছে কিংবা কেউ ব্যক্তিগত সম্পদে পরিণত করেছে। এতে নৌপথ তলানিতে এসে ঠেকেছে। আর রেল যোগাযোগের কথা তো দীর্ঘদিন নীতিনির্ধারকরা ভুলেই গিয়েছিলেন। এ কারণে রেল যোগাযোগ জনগণের জন্য সুলভ ও নিরাপদ হিসেবে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। সম্প্রতি রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে কথা হচ্ছিল, যদিও তার নির্মাণ ব্যয় আকাশছোঁয়া। আর সড়কপথ টোলে ভরপুর।
পৌরকর নির্ধারণে সরকারের কিছু নীতিমালা আছে। সেই নীতিমালার পুরোটা অনুসরণ করে পৌরকর নির্ধারণ করা হচ্ছে, তা বলা যাবে না। নীতিমালা একটা আছে। সে নীতিমালার কথা পৌরবাসীকে শুধু জানানোই হয়; সে অনুযায়ী কর নির্ধারণ করা হয় না। নানাবিধ কারণে পৌরসভা কর্তৃপক্ষ নীতিমালা এড়িয়ে চলে। ফলে সমতার ভিত্তিতে পৌরকর নির্ধারণ না হওয়ায় পৌরবাসীদের মধ্যে অসন্তুষ্টি বিরাজ করে। সম্প্রতি দেশের একটি পৌরসভায় পৌর কর্তৃপক্ষ নতুন করে কর নির্ধারণ করেছে। এতে একজন পৌরবাসীকে ৭ গুণ কর দিতে হচ্ছে। সময়ের হিসাব সময়ে না করার ফলে যদিও এ অবস্থার সৃষ্টি; তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়, এমন বৃদ্ধি কি গ্রহণযোগ্য হতে পারে? পৌরকর না দিলে যেমন পৌর সুবিধা ভোগ করার অধিকার রাখে না, ঠিক তেমনি অসম কর বৃদ্ধি নাগরিক অধিকার সুরক্ষা করে না। জনগণের আয় ও ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে সত্য; নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের আকাশছোঁয়া দরবৃদ্ধির পরও জনগণ বেঁচে আছে। তাই বলে একবারে ৭ গুণ কর বৃদ্ধি! বর্তমান সরকার এসব বিষয়ে দৃষ্টি দেবে বলে প্রত্যাশা রাখি।
দেশের এমন একটা জায়গা নেই যেখানকার সরবরাহকৃত পানি সরাসরি পানযোগ্য। সারাদেশে জনগণের জন্য যে পানি সরবরাহ করা হয়, তার রূপ-রস-গন্ধ দেখে সাধারণ মানুষের গলার নিচে নামে না বলেই বিশ্বাস। একান্ত বাধ্য হয়ে অনেকে ব্যক্তিগত বিকল্প ব্যবস্থা করলেও তা যৌথভাবে ব্যবহার হয়ে থাকে। এটাও দায়িত্বপ্রাপ্তদের পছন্দ নয়। কর্তৃপক্ষ যে কর আদায় করে, তার মধ্যে প্রথম দফায় ১০ শতাংশ হারে পানির জন্য কর গ্রহণ করে। দ্বিতীয় দফায় মাসিক হারে এবং তৃতীয় দফায় বিকল্প ব্যবস্থার জন্য কর নেয়। অথচ শুধু পানির জন্য তিন দফায় কর আদায় করার পরও তা পানযোগ্য রাখার কোনো দায়িত্ব কেউ নেয় না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, তারা বলতে চাইছে– আমরা বিদেশে স্ত্রী-সন্তানদের নিশ্চিত অভিজাত জীবনে রেখে বাংলাদেশে পড়ে আছি জনগণের ভালোবাসার প্রতিদান দেওয়ার জন্য। তাই জনকল্যাণে একই বিষয়ের ওপর তিনবার কেন, ১০ বার যদি কর গ্রহণের উদ্যোগ আমরা নিই তাহলেও জনগণের উচিত দ্বিধাহীন চিত্তে প্রদান করা। প্রকল্প হবে, মেগা প্রকল্প হবে; তবেই না জনগণ দেশের উন্নতি- অগ্রগতি দেখতে পাবে। নিজেদের উন্নত দেশের কাতারে দেখতে চাইলে সরকারের চাহিদামতো সাধারণ মানুষকে বিনা প্রতিবাদে কর দেওয়া দরকার; দিতেই হবে।
দেশের ব্যবসায় পরিস্থিতিও একই রকম। অস্থিতিশীল ও সিন্ডিকেটবাজি। ছোট ব্যবসায়ীরা জীবন সংগ্রাম করে কিছুটা লাভ, কিছুটা মূলধন খেয়ে বেঁচে আছে। এদের প্রতিষ্ঠান দেখলে, প্রতিদিনের চলাফেরা দেখলেই অনুমান করা যায় ভেতরের ফাঁপা অবস্থা। তারপরও সংশ্লিষ্ট সংস্থা এদের কাছ থেকে কর আদায় করতে মরিয়া হয়ে সর্বশক্তি নিয়োগ করে। অন্যদিকে, দেশের বড় ব্যবসায়ীদের প্রতি শুধু সংস্থা নয়, অনেকেরই অনুগ্রহের শেষ নেই। এখানে এসে কর ব্যবস্থাপনা থমকে দাঁড়ায়। এই অংশকে চ্যালেঞ্জের মুখে কেউই ফেলতে চায় না। কারণ কর আদায়কারী সবাই জানে, এদের সেকেন্ড হোম হলে আমারও হবে। এদের সন্তানরা বিদেশে পড়তে গেলে আমাদের সন্তানও পড়তে যাবে। এদের যদি অভিজাত জীবন নিশ্চিত হয়, তবে আমাদেরও হবে। তাই কর আদায়ের জন্য সাধারণ মানুষই একমাত্র ভরসা।
এই সাধারণ মানুষের ওপর মহাসড়কে টোল বসিয়েই পূর্ববর্তী কর্তৃপক্ষ সন্তুষ্ট থাকতে পারেনি। বরং তারা বারবার টোল, বিদ্যুৎ বিল বৃদ্ধির পরিকল্পনা করেছিল। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি লাগামহীন করার প্রক্রিয়া চলছিল। সরকারি সেবার মান প্রতিদিন কমেছে আর দাম বেড়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে প্রত্যাশা, তারা রাষ্ট্রের এসব অব্যবস্থাপনা ও জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া বোঝা কমিয়ে আনবে।
সরকারের উন্নয়ন-অগ্রগতি অব্যাহত রাখতে কর দিতে হবে– এটা যেমন সত্য, তেমনি আনুপাতিক কর ব্যবস্থা গড়ে তোলাও আবশ্যক। পরিবর্তনের বাংলাদেশে আজ মানুষের সামর্থ্য বিবেচনায় কর ব্যবস্থা গড়ে তোলা সময়ের দাবি। সরকার সাধারণ মানুষের প্রকৃত অবস্থা অনুধাবন করে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবে– এই প্রত্যাশা আমাদের।