মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: বুধবার ১৮, সেপ্টেম্বর ২০২৪

‘মিয়ানমারে না, ভাসানচরে না, আমাদেরকে তৃতীয় দেশে পাঠিয়ে দিন!

Share on:

‘‘এই প্রথম বাংলাদেশে একটা সরকার এল, যারা আমাদের পুনর্বাসনের ব্যাপারে এত পরিষ্কারভাবে কথা বলল।’ ১০ সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এক তরুণ রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে কথোপকথনের সময় এভাবেই তাঁর অনুভূতি ব্যক্ত করেন।


বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান ড. মহাম্মদ ইউনূসের সাম্প্রতিক মন্তব্যে যেন দীর্ঘ অপেক্ষার অন্ধকারে হঠাৎ আলোর ঝলক দেখতে পেয়েছেন রোহিঙ্গারা।

রোহিঙ্গা বিষয়ে গবেষকেরা লক্ষ করে থাকবেন, পূর্বপুরুষের দেশ মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার চেয়ে তৃতীয় কোনো দেশে পুনর্বাসিত হওয়া অনেক রোহিঙ্গার কাছে এখন প্রথম পছন্দ। তাদের ভাষায়, ‘মিয়ানমারে না, ভাসানচরে না, আমাদেরকে তৃতীয় দেশে পাঠিয়ে দিন।’

দুই বছর যাবৎ জাতিসংঘের শরণার্থী কমিশন ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার উদ্যোগে অনেকটা গোপনে (বাংলাদেশ সরকারের সম্মতিতে) ক্ষুদ্র পরিসরে রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে আমেরিকায় পুনর্বাসনের কাজ চলছিল। নিঃসন্দেহে এই প্রক্রিয়া এখন বেগবান হওয়ার পথ তৈরি হয়েছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে তৃতীয় দেশে পুনর্বাসনের সদিচ্ছা প্রকাশ করলেই কি ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার পুনর্বাসনে তৃতীয় দেশ ত্বরিত ব্যবস্থা নেবে?

এই পুনর্বাসনের বিনিময়ে বাংলাদেশের কাছে রোহিঙ্গা গ্রহণকারী দেশের কী কী প্রত্যাশা থাকবে? তাদের সব প্রত্যাশা কি দেশের জাতীয় স্বার্থের জন্য অনুকূল হবে? আমেরিকায় যাওয়ার জন্য স্থানীয় জনগণের মধ্যে কারও কারও রোহিঙ্গা হিসেবে নাম লেখানোর তৎপরতা দেখা যাবে না তো?

‘নো পলিসি ইজ আ পলিসি’র মতো স্বার্থবাদী চিন্তা থেকে বের হয়ে জাতীয় শরণার্থী নীতি প্রণয়ন করতে হবে। যত দিন রোহিঙ্গা পুনর্বাসন সম্ভব না হচ্ছে, তাদেরকে শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। এর জন্য ১৯৫১ সালের কনভেনশনে স্বাক্ষর করার কোনো প্রয়োজন নেই। রোহিঙ্গাদের স্থানীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়ার সুযোগ দিয়ে দাতা সংস্থার ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে।

এ প্রশ্নগুলো বিবেচনায় এনেই হয়তো তৃতীয় দেশে রোহিঙ্গা পুনর্বাসনকে বেগবান করা হবে। কিন্তু ২০১৭ সালে বা তার আগের বছরগুলোতে রোহিঙ্গা প্রবেশ ঠেকানো যায়নি। ২০২৪ সালেও এর পুনরাবৃত্তি ঘটছে। ভূকাঠামোগত এবং মানবিক কারণে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে সব সময়ই ব্যর্থ।

পুনর্বাসনই কি রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের পথ? তাহলে বিষয়টি অনেকটা এ রকম দাঁড়াবে যে মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা বাংলাদেশকে করিডর হিসেবে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রে যাবে। কারণ, একদিকে পুনর্বাসন হবে, অন্যদিকে নতুন করে রোহিঙ্গা আসবে, বিশেষ করে এখন যারা সীমান্তের ওপারে অপেক্ষা করছে।

গত দুই দশকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক দুর্বলতা ছিল লক্ষণীয়। তাই পুরোনো এবং নতুন—কোনো রোহিঙ্গাকেই ফেরত পাঠানোর উদ্যোগে বাংলাদেশ সফল হতে পারেনি। সেই সঙ্গে রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনায় সহায়তার জন্য বিপুলসংখ্যক আন্তর্জাতিক সংস্থাকে আমন্ত্রণ ও অনুমোদন করা হয়েছে। পর্যটন নগরী কক্সবাজার এখন তাদের কার্যক্রমের সাইনবোর্ড ও বিজ্ঞাপনে সয়লাব।

উখিয়া-টেকনাফের মতো অনুন্নত উপজেলায় বিদ্যুৎ বিভ্রাটে জনজীবন বিপর্যস্ত। কিন্তু রোহিঙ্গাদের সেবায় নিয়োজিতদের সেবার জন্য নর্থএন্ডের কফিশপে সার্বক্ষণিক জেনারেটরের বন্দোবস্ত হয়েছে। রিফিউজি ট্যুরিজমের সুবিধা–সংবলিত কক্সবাজারে চাকরি তাই অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মীদের কাছে বেশ আকর্ষণীয়। আর ক্যাম্পের ভেতরে-বাইরে রোহিঙ্গাদের তথা বাংলাদেশের নিরাপত্তাদানে নিয়োজিত ব্যক্তিদের রোহিঙ্গাদের কাছে থেকে চাঁদা আদায় থেকে শুরু করে মাদক চোরাচালানে শরিক হওয়ার ঘটনা নিয়মিতভাবে ঘটার ক্ষেত্র ক্রমে অবারিত হয়েছে।

দুই দশকের এই প্রেক্ষাপটে আসলে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে কোনো কার্যকর, ইতিবাচক ও বাস্তবসম্মত উদ্যোগ সরকারিভাবে বাংলাদেশে নেওয়া হয়নি। বরং সরকারপ্রধানদের মুখে শোনা গেছে অবাস্তব কথা, যেমন ‘বাংলাদেশ আর একজন রোহিঙ্গাকেও ঢুকতে দেবে না’, কিংবা ‘যারা রোহিঙ্গাদেরকে বাংলাদেশে আশ্রয় দিতে বলে, তারা নিয়ে যাক রোহিঙ্গাদের’। এমন বয়ানের পাশাপাশি প্রকাশ হতো আরও কতজন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকল, তার পরিসংখ্যান।

এ–জাতীয় বাক্য ব্যয়ে সময় গিয়েছে, রোহিঙ্গা সমস্যা হয়েছে প্রকটতর। বর্তমান পররাষ্ট্র উপদেষ্টা নিজেও রোহিঙ্গা বিষয়ে কলাম লিখতেন অন্তর্বর্তী সরকার আসার আগে। আফসোস, সম্প্রতি তিনিও একই সুরে কথা বলছেন। একই সঙ্গে পুনরাবৃত্তি হচ্ছে ঘুষ দিয়ে বাংলাদেশ সীমান্তের ভেতর রোহিঙ্গাদের ঢুকে পড়া। ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত ঘটনাগুলো এভাবেই ঘটেছে এবং এখনো এভাবেই ঘটছে।

অবধারিতভাবে প্রশ্ন আসে, রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে কিছু একটা করার সময় কি এখনো হয়নি? নাকি যাঁরা দায়িত্বে আছেন, তাঁরা এখনো সমস্যার গভীরতা বুঝতে পারছেন না? মাত্র কয়েক মাস আগেও আরাকান আর্মি বাংলাদেশ সীমান্তের নিকটবর্তী ছিল। নির্ভরশীল ছিল বাংলাদেশ থেকে যাওয়া পণ্যের ওপর। তাদের সঙ্গে আলোচনার সুযোগটি আগের শাসক হারিয়েছে।

এখন আরাকান আর্মি আরও অগ্রসর হয়েছে, নির্ভর করছে মিজোরাম ও আশপাশের এলাকা থেকে আসা পণ্যের ওপর। এখন তাদের কাছে বাংলাদেশ গৌণ। বাংলাদেশের কাছে এখন জান্তা সরকার ও আরাকান আর্মি উভয়ই সমান। চীনের সঙ্গেও বাংলাদেশের ফলপ্রসূ আলোচনা ও কোনো কার্যকর সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানা যায় না, যা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে ভূমিকা রাখতে পারত।

এমন পরিস্থিতিতে তৃতীয় দেশে পুনর্বাসনের বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধানের বক্তব্য রোহিঙ্গাদের মধ্যে আশাজাগানিয়া হবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দেশের স্বার্থ অক্ষুণ্ন রেখে যুক্তরাষ্ট্রে রোহিঙ্গা পুনর্বাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও যে প্রশ্নটি অমীমাংসিত রয়ে যায়, তা হলো গণহত্যার জবাব। শুধু যুক্তরাষ্ট্রে কেন, যেকোনো দেশে রোহিঙ্গা পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালিত হলে মিয়ানমারের কাছে যে ভুল বার্তা যাবে, তা হলো গণহত্যা বলে কিছু ঘটেনি, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি বলেই বাংলাদেশ নিজ দায়িত্বে তাদেরকে পুনর্বাসন করছে ইত্যাদি।

সরকারের রোহিঙ্গা পুনর্বাসনসংক্রান্ত ঘোষণায় রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশিদের খুশি হওয়ার কারণ থাকলেও এ বিষয়টি মিয়ানমারের করা জঘন্য অপরাধের দায়মুক্তিতে কেমন প্রভাব ফেলবে, সেটি ভাবতে হবে বৈকি। আবার চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সমঝোতাপূর্বক মিয়ানমারে তার প্রভাব কাজে লাগানোর মাধ্যমে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারকে রাজি করানো গেলে (যদিও এখন পর্যন্ত এটি অতি কাল্পনিক ব্যাপার) যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কে সেটির প্রভাব পড়বে।

প্রকৃত সত্য হচ্ছে, বাংলাদেশকে তার ভূপ্রাকৃতিক কৌশলগত অবস্থান ও অতীতের কূটনৈতিক গাফিলতির কারণে যুক্তরাষ্ট্র বা চীন—যেকোনো একটি পক্ষ নিতে হবে। ফলে কোনো এক পক্ষের বিরাগভাজন হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু সেই বিরাগ নিরসন করতে গিয়ে গণহত্যার অপরাধে অপরাধী মিয়ানমার যেন ভুল বার্তা না পায় এবং গণহত্যার যথাযথ বিচার হয়, সেটি নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশকেই কাজ করতে হবে। সেই সঙ্গে আরও কিছু কাজ শুরু করতে হবে।

যেমন ‘নো পলিসি ইজ আ পলিসি’র মতো স্বার্থবাদী চিন্তা থেকে বের হয়ে জাতীয় শরণার্থী নীতি প্রণয়ন করতে হবে। যত দিন রোহিঙ্গা পুনর্বাসন সম্ভব না হচ্ছে, তাদেরকে শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। এর জন্যে ১৯৫১ সালের কনভেনশনে স্বাক্ষর করার কোনো প্রয়োজন নেই। রোহিঙ্গাদের স্থানীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়ার সুযোগ দিয়ে দাতা সংস্থার ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাদেরকে শরণার্থী পরিচয়ে দিতে হবে লেখাপড়ার সুযোগ। তাহলে মিথ্যা পরিচয়পত্র ও জন্মনিবন্ধন করিয়ে বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার তাদের আর প্রয়োজন থাকবে না।

প্রথম আলো