মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের শক্ত পদক্ষেপ জরুরি
Share on:
দুই বছর ধরেই দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিদ্যমান। উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে দেশের মধ্য ও নিম্ন আয়ের মানুষ অত্যন্ত কষ্টে জীবন যাপন করছে। গত এক বছরে দেশে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি আরো বেশি খারাপ অবস্থায় রয়েছে। সরকারের নানা পদক্ষেপেও মূল্যস্ফীতি কমেনি।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) কার্ডধারী সদস্যদের স্বল্প মূল্যে খাদ্য সরবরাহ করে সরকার। পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে ভোক্তা অধিকার অভিযান পরিচালনা করা হয়। কিন্তু সরকারের সমন্বিত পদক্ষেপ না থাকায় কার্যত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ হয়নি।
ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য চাল, ডাল, পেঁয়াজ, রসুন, শাকসবজি ও মাছ-মাংসের দাম মধ্য ও নিম্ন আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বার্ষিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশে দাঁড়ায়, যা ২০১১-১২ অর্থবছরের পর সর্বোচ্চ। সরকার ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে রাখার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। অবশ্য অর্থবছর শুরুর মাসে অর্থাৎ জুলাইয়ে তা কিছুটা কমে ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশে দাঁড়ায়, জুনে ছিল ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। গ্রাম ও শহরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরই ছিল। অন্যদিকে গত ১২ মাসের মধ্যে সাত মাসই খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরে ছিল। গত বছরের আগস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশে উঠেছিল, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সর্বোচ্চ।
খাদ্য মূল্যস্ফীতির তীব্রতা বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে। প্রথম আলোর প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খাদ্য মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি বিবেচনায় বাংলাদেশকে ‘লাল’ শ্রেণীতে রেখেছে বিশ্বব্যাংক। প্রতি ছয় মাস পর বিশ্বব্যাংক ১০-১২ মাসের খাদ্য মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে খাদ্যনিরাপত্তা বিষয়ক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সম্প্রতি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের খাদ্যনিরাপত্তার হালনাগাদ পরিস্থিতি তুলে ধরে তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। বাংলাদেশের পাশাপাশি আরো ১৪টি দেশ ‘লাল’ শ্রেণীতে আছে।
খাদ্য মূল্যস্ফীতি কোন দেশে কত বেশি, তা বোঝাতে বিভিন্ন দেশকে চার শ্রেণীতে বিভক্ত করেছে সংস্থাটি। যেসব দেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৩০ শতাংশ বা তার বেশি, সেসব দেশকে ‘বেগুনি’ শ্রেণীতে; ৫-৩০ শতাংশের মধ্যে যেসব দেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতি, তাদের ‘লাল’ শ্রেণীতে রাখা হয়েছে। এছাড়া ২-৫ শতাংশের মধ্যে মূল্যস্ফীতির দেশগুলোকে ‘হলুদ’ ও ২ শতাংশের কম মূল্যস্ফীতির দেশগুলোকে ‘সবুজ’ শ্রেণীতে রাখা হয়েছে। সব মিলিয়ে ১৭২টি দেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে সংস্থাটির প্রতিবেদনে।
অবশ্য রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বের অনেক দেশেও মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। এসব দেশের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বড় অর্থনীতির দেশগুলো উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমাতে পারলেও বাংলাদেশ এখনো পারেনি। এছাড়া বাংলাদেশের প্রতিবেশী শ্রীলংকা, নেপাল ও ভারত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। এর মধ্যে শ্রীলংকা অন্যতম। দেশটিতে মূল্যস্ফীতি ৬০ শতাংশে পৌঁছেছিল। কিন্তু বাজার সিন্ডিকেট ভাঙা ও সুশাসন নিশ্চিত করার কারণে সহনীয় পর্যায়ে মূল্যস্ফীতি নামিয়ে আনতে পেরেছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের জন্য শ্রীলংকা, ভারত ও নেপাল উদাহরণ হতে পারে।
দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলংকা ভয়াবহ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটে পড়ে ২০২২ সালে। সে সময় মূল্যস্ফীতি ঠেকে প্রায় ৬০ শতাংশে। রিজার্ভ সংকটে বন্ধ হয়ে যায় জ্বালানি তেলের মতো অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি। আমদানি দায় আর বিদেশী ঋণ পরিশোধের ব্যর্থতায় নিজেদের দেউলিয়াও ঘোষণা করে শ্রীলংকা সরকার। কিন্তু ইতিহাসের সবচেয়ে নাজুক সে পরিস্থিতি দ্রুতই কাটিয়ে উঠছে শ্রীলংকা। মূল্যস্ফীতির হার কমতে কমতে গত জুনে নেমে আসে ১ দশমিক ৭ শতাংশে। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, মে মাসে এ হার ছিল ১ শতাংশের নিচে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের মূল্যস্ফীতিও দুই বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে দাঁড়িয়েছে। ভারতের পরিসংখ্যান মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, মে মাসে দেশটির মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ। নেপালেও গত ৩১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে মূল্যস্ফীতি। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, মে মাসে নেপালের মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। এক বছর আগে এ হার ছিল ৭ দশমিক ৪১ শতাংশ।
দুই বছর ধরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরে থাকলেও সরকারের পক্ষ কোনো শক্ত পদক্ষেপ দৃশ্যমান হয়নি। কোটা সংস্কার আন্দোলনের কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতিকে আরো উসকে দেবে। কেননা কিছুদিন আগে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ থাকায় সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হয়েছে। গতকালও সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন হয়েছে। এতে আবারো সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
অর্থাৎ নতুন করে সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকট অর্থনৈতিক ঝুঁকি আরো বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের যে লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, তা কীভাবে পূরণ করা হবে তা নিয়ে তৈরি হয়েছে শঙ্কা। চলমান সংকটের কারণে দেশের আমদানি-রফতানিসহ বিভিন্ন খাতে প্রভাব পড়েছে। রিজার্ভ কমেছে। দেশের অর্থনীতি এমনিতেই নাজুক।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাংলাদেশ বরাবরই ব্যর্থ হচ্ছে। এর পেছনে অর্থনৈতিক কারণ ছাড়াও নানা বিষয় জড়িত। তা হলো অর্থ পাচার ও বাজার সিন্ডিকেট দমনে ব্যর্থতা। দেশে ডলার ও রিজার্ভ সংকট থাকলেও সরকার নিজস্ব ব্যয় কমাতে পারেনি। উল্টো টাকা ছাপানোর মতো পদক্ষেপের কারণে বাজারে অর্থ সরবরাহ বাড়ায় মূল্যস্ফীতি ব্যাপক আকার ধারণ করেছে।
চলমান সংকট মোকাবেলা করে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনাই সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। জিনিসপত্রের দাম বাড়লে কিংবা উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাব সাধারণ মানুষের ওপর সরাসরি পড়ে। কেননা ব্যয় বাড়লেও আয় বাড়ে না। ফলে সীমিত আয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয় মধ্য ও নিম্ন আয়ের মানুষের। তাই বাড়তি দাম নিয়ে সাধারণ মানুষ অস্বস্তিতে রয়েছে। মানুষের আয় বৃদ্ধির দিকে সরকারকে মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। সরবরাহ শৃঙ্খল ঠিক করে দ্রুততম সময়ে স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে সরকারের দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া দরকার। নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের যে সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে, তা ভাঙতে তৎপরতা প্রয়োজন। এটি না করে শুধু অভিযান পরিচালনা করে ব্যবসায়ীদের জরিমানা করলে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাবে না। বাজারে এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ীর তৎপরতা আমরা দীর্ঘদিন ধরেই লক্ষ করছি। এদের সিন্ডিকেট দমন না করে দাম নির্ধারণ করলে যে কোনো সুফল পাওয়া যায় না, নিকট অতীতেও সেটি ফুটে উঠেছে। তাই এখন বাজার নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। এজন্য যথাযথ প্রক্রিয়ায় ব্যবস্থা নিতে হবে। বাজারে খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি প্রয়োজনে আমদানিকারকের সংখ্যা আরো বাড়াতে হবে। বাজারে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ সৃষ্টিতে সরকারের পদক্ষেপ জরুরি। এছাড়া নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের জন্য টিসিবি আরো সক্ষম করে গড়ে তোলা দরকার। দেশে বাজার তদারকির যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে তাদের সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে।