মূল্যস্ফীতির শঙ্কা বাড়ল
Share on:
কয়েক দিন ধরে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে রাস্তাঘাটে অবরোধ ও সংঘাত; এটাকে দমনে কারফিউ, ইন্টারনেট স্থগিতকরণ ও হতাহতের ঘটনায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে এক ধরনের স্থবিরতা আর অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে। সংঘাত ঘিরে অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিয়ে যদিও নির্মোহ গবেষণা এখনও হয়নি; তথাপি বলা চলে, দৈনিক প্রায় ১.২ বিলিয়ন ডলার কর্মকাণ্ডের অর্থনীতিতে সম্ভাব্য ক্ষতির পরিমাণ অনেক।
আমরা দেখেছি, দুই বছরের বেশি সময় ধরেই উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে অতিষ্ঠ মানুষ। বিশেষত প্রতিদিন বাজারে গিয়ে এই চাপ কঠিনভাবে টের পাচ্ছে নিম্নবিত্ত জনগোষ্ঠী। সরকারের বিবিধ উদ্যোগও মূল্যস্ফীতি কমাতে পারছে না। চাল, ডাল, পেঁয়াজ, রসুন, চিনি, শাকসবজি, মাছ, মাংস; কোনো কিছুই সীমিত আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার নাগালে থাকছে না। এ অবস্থায় সপ্তাহব্যাপী স্থবিরতা উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও অর্থনীতিতে নতুন করে সংকট তৈরি করবে, তাতে সন্দেহ নেই।
কয়েক দিনের সহিংস ঘটনায় দেশের নিত্যপণ্যের সরবরাহ শৃঙ্খল প্রায় ভেঙে পড়েছিল। রাজধানীর বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়তে থাকে। কারফিউ দিয়ে সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্যোগ নেয়। তিন দিন ধরে মাত্র রাজধানীর সঙ্গে সারাদেশের পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা সচল হতে শুরু করেছে। ফলে রাজধানীর বাজারে পণ্য সরবরাহ বেড়ে দাম কিছুটা কমতে শুরু করলেও আগের অবস্থায় ফেরেনি।
পত্রিকান্তরে জানা গেছে, গত দুই সপ্তাহের ব্যবধানে বাজারে বিভিন্ন প্রকার চালের দাম কেজিতে ২ থেকে ৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। খুচরা পর্যায়ে এক কেজি মোটা চাল (পাইজাম) বিক্রি হয় ৫৪ টাকায়। এই চালের দাম দুই সপ্তাহ আগে ছিল ৫০-৫১ টাকা। সংঘাতের কারণে সৃষ্ট অনিশ্চয়তায় গত শুক্রবার থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত সেখানে কোনো চালের ট্রাক আসেনি। তবে পাইকারি পর্যায়ে চালের মজুত থাকায় সেখানে দাম স্থিতিশীল।
চাল ছাড়াও অন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী যেমন চিনি, পেঁয়াজ, ব্রয়লার মুরগি, মুরগির ডিমের দাম কিছুটা বেড়েছে। গত মঙ্গলবার ঢাকার বাজারে প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হয়েছে ১৩৫-১৪০ টাকায়। মাত্র দুই দিন আগে চিনির দর কেজিতে ৫-১০ টাকা কম ছিল। বাজারে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে এখন ১১০-১২০ টাকা কেজি। পত্রিকাগুলো বলছে, ভারত থেকে আমদানি বাড়লেও পেঁয়াজের দাম কমার কোনো সুখবর নেই।
প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি এখন ১৯০ টাকা, যা দুই সপ্তাহ আগে ছিল ১৭০ টাকা। ফার্মের মুরগির বাদামি ডিমের দামও ডজনে ১০-২০ টাকা বেড়ে এখন ১৫০-১৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মাছের বাজারেও প্রভাব পড়েছে। গত কয়েক দিনে সরবরাহ কম থাকায় মাছের দাম বাড়তি। নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ রুই, তেলাপিয়া, পাঙাশ ও চিংড়ি মাছ বেশি খায়। এসব মাছের দাম স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় কেজিতে ২০-৪০ টাকা বাড়তি।
বলা বাহুল্য, এই পরিস্থিতির জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না। একদিকে সবকিছু বন্ধ থাকায় নিম্ন আয়ের মানুষের কাজ নেই। অন্যদিকে বাজারে জিনিসপত্রের বাড়তি দাম। দিনমজুর শ্রেণির মানুষের দু-তিন দিনের সঞ্চয়ও থাকে না।
ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় অন্য অনেক সমস্যার পাশাপাশি গত কয়েক দিন টিসিবি কার্ডধারী এক কোটি পরিবার ভর্তুকি মূল্যে নিত্যপণ্য পাচ্ছে না। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) থেকে দেশের এক কোটি পরিবারের মধ্যে ভর্তুকি মূল্যে চাল, ডাল, ভোজ্যতেলসহ কয়েকটি নিত্যপণ্য সরবরাহ করা হয়। নির্দিষ্ট অ্যাপের মাধ্যমে পরিবেশকরা পুরো কার্যক্রম পরিচালনা করেন। কিন্তু ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় অ্যাপ সচল করা সম্ভব হয়নি। তিন-চার দিন ধরে সুবিধাভোগীদের কাছে এসব পণ্য সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। যে কারণে বাজার থেকে বেশি দামে পণ্য কিনেছেন টিসিবির কার্ডধারী অনেক ভোক্তা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সদ্য বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের গড় মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ, যা অর্থবছরওয়ারি হিসাবে অন্তত এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ। পুরো বছরে কোনো মাসেই সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের নিচে নামেনি। অন্যদিকে জাতীয় মজুরি হার বেড়েছে সাড়ে ৭ শতাংশের মতো।
এক বছর ধরেই খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি বেশি খারাপ অবস্থায় ছিল। গত ১২ মাসের মধ্যে সাত মাসই খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরে ছিল। গত বছরের আগস্ট মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশে উঠেছিল, যা অর্থবছরের সর্বোচ্চ। গত অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি নির্ধারিত ৬ শতাংশে রাখার লক্ষ্য থাকলেও এর ধারেকাছেও যেতে পারেনি।
দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি আছে– এটা তো অস্বীকার করা যাবে না। বাড়তি দাম নিয়ে সাধারণ মানুষ অস্বস্তিতে রয়েছে। ফলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বা আয় বৃদ্ধির দিকে সরকারকে মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। গত কয়েক দিনে স্থবির হওয়া সরবরাহ শৃঙ্খল ঠিক করে দ্রুততম সময়ে স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
সন্দেহ নেই, গত কয়েক দিনের সহিংস ঘটনায় অর্থনীতির জন্য বড় ক্ষতি হয়ে গেল। মানুষের মধ্যে এক ধরনের শঙ্কা, অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়েছে। এখনও ব্যবসা-বাণিজ্য, পণ্যের চলাচল ঠিক করা যাচ্ছে না। নিরাপত্তা জোরদার করে এখন পণ্যের সরবরাহ শৃঙ্খল ঠিক করতে হবে। গরিব পরিবারের জন্য বিশেষ সহায়তা ব্যবস্থা চালু করাও জরুরি।
আগেই বলেছি, দুই বছর ধরে চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না সরকার। মুদ্রানীতির সঙ্গে রাজস্বনীতি ও বাজার ব্যবস্থাপনারও সমন্বয়হীনতা আছে। অপরাপর দেশের মতো আমাদের এখানেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এসব বিষয়ে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। বাজার ব্যবস্থাপনায়ও আনতে হবে অভিনবত্ব। হুমকি-ধমকির নজরদারিতে অতীতে কাজ হয়নি, আর হবেও না। সেই সঙ্গে যে কোনো সংঘাত বা মতভিন্নতা এড়িয়ে যাওয়া কিংবা মোকাবিলায় হতে হবে আরও সহিষ্ণু ও পরিণামদর্শী।
মামুন রশীদ: অর্থনীতি বিশ্লেষক