মূলধারার রাজনীতি চর্চার সুযোগ এখনই, ছাত্র–তরুণদের যা করণীয়
Share on:
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশে নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের রাজনীতি যে পথে চলেছে, সেখান থেকেও উত্তরণের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শুধু স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতনই ঘটেনি, রাজনীতি–সচেতন একটি তরুণ প্রজন্মের উন্মেষ ঘটেছে। যে মূলধারার রাজনীতি নিয়ে তারা এত দিন বিমুখ ছিল, সেই রাজনীতিতে এখন তাদের অংশগ্রহণ অনিবার্য হয়ে পড়েছে। নয়তো এ রাষ্ট্র আবারও পুরোনো রাজনীতির পথে হাঁটা শুরু করবে। তরুণদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ নিয়ে ইতিমধ্যে অনেক আলোচনা হচ্ছে।
তবে ছাত্র যুবাদের যাঁরা দীর্ঘ মেয়াদে সফল রাজনৈতিক নেতা হিসেবে ক্যারিয়ার গড়তে চান বা জনতার নেতা হতে চান, তাঁদের কিছু বলতে চাই। আপনারা কৃষিকাজ শিখুন, রান্নাবান্না শিখুন, সাঁতার শিখুন, ড্রাইভিং শিখুন, সাইক্লিং, কাপড় ধোয়া, ঘর মোছা, রাস্তা পরিষ্কার, বনায়ন ইত্যাদি কাজ শিখুন। ব্যাগ হাতে মুদি কিংবা কাঁচাবাজারে যান নিয়মিত। আপনার নিজের বেসিক ‘লাইফ স্কিল’ নেই, এমন পরিস্থিতিতে নেতা হতে চাইলে সেটা বুমেরাং হবে। আপনি নিজের কাজে অন্যের ওপর নির্ভর করলে, কোনো বিষয়েই দক্ষ হবেন না। পরনির্ভরতা দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা তৈরি করে না।
অফিসে কাজের জন্য বেসিক ও মধ্যপর্যায়ে সফটওয়্যার টুলে দক্ষ হন। প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট শিখুন, প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট সার্টিফিকেশন কোর্স করুন। নিজ নিজ পঠিত বিষয়ে পেশাগত অভিজ্ঞতা নিন। শিল্প খাতের সমস্যা নিয়ে নীতিভিত্তিক রিসার্চ করুন, অ্যাসাইনমেন্ট পর্যালোচনা করুন। এতে আপনি কী পারেন, সেটা বেরোবে। আপনি নেতা হলে এসব অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে কর্মীদের যোগ্যতা মাপুন। আনুগত্য কিংবা রাস্তার পারফরম্যান্স যোগ্যতার একমাত্র মাপকাঠি নয়।
রাজনীতির পাশাপাশি শিক্ষাগত যোগ্যতা বাড়ান। গ্র্যাজুয়েশন, পোস্টগ্র্যাজুয়েশন করুন। দিনের একটা ছোট অংশ হলেও পড়ার অভ্যাস করুন। স্টাডি সার্কেল করুন, পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতা, অর্থনীতি/বাণিজ্য পাতা, ইকোনমিস্ট বা সমমানের ফিচার পড়ুন। পেশাগত দক্ষতাহীন লোক ভালো নেতা হতে পারে না, নীতি গ্রহণে ভূমিকা রাখতে পারে না। তাই কিছুদিন হলেও চাকরি করুন বা উদ্যোক্তা হোন।
আপনি বিস্তর তত্ত্ব জানতে পারেন, কিন্তু আপনাকে দেশের সমস্যার সমাধানে টেকনোক্রেটিক সমাধান জানা লাগবে। তত্ত্ব জানাটাই যথেষ্ট নয়, প্রয়োগও জানতে হবে। প্রতিটি সমস্যার সমাধানসূত্র জানতে হবে, দুটি সমস্যার মধ্যকার সূক্ষ্ম ও স্থূল পার্থক্য জানতে হবে। ছাত্রের বিশ্লেষণ সক্ষমতা এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ভিত্তিক নীতি গবেষণা লাগবে।
রাজনীতির মাধ্যমে দেশের মানুষের দৈনন্দিন সমস্যার সমাধান করা লাগবে, দেশের ‘যাবতীয় সম্পদ ব্যবস্থাপনা’র স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সম্ভাবনাকে আনপ্লাগ করা লাগবে, বিভিন্ন স্থানীয়, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তাঝুঁকি সমাধান করা লাগবে। খাদ্যনিরাপত্তা, জ্বালানিনিরাপত্তা নিশ্চিত করা লাগবে। বিদ্যমান সেবাদানপদ্ধতি এবং প্রশাসনের কাজের আধুনিক ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন লাগবে। এর জন্য জ্ঞানভিত্তিক রাজনীতি লাগবে, পলিসি স্টাডি লাগবে। বিভিন্ন ভাষা জানতে হবে।
আমলারা তদবির করে, ঠিকাদার সমঝোতা করে যেসব প্রকল্প দাঁড় করায়, সেই প্রকল্পের সমস্যা সমাধান আপনার কাজ নয়। বরং নেতার কাজ সংস্কারকে এগিয়ে নিতে চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখা। বিদ্যমান প্রকল্প ও কাজের মূল্যায়ন করে বাজে কাজ, বেদরকারি প্রকল্প থামানো, সরকারের খরচ কমানো।
রাজনৈতিক ইশতেহারে জনতাকে অঙ্গীকার করা মিশন বাস্তবায়নে কৌশলগত মিশন তৈরি করা, দূরদর্শী কৌশল করা, অর্থবহ পরিবর্তনের জন্য কাজ করা এবং আমলাদের দিয়ে কাজ আদায় করে নেওয়া। এটা তখনই পারবেন, যখন আপনি নিজে মেরিটোক্রেটিক হবেন, টেকনোক্রেটিক সমাধান জানবেন। অদক্ষ নেতা সরকারের পদ পেলে তার পরিণতি কি জানেন? আমলার পাঁকে পড়ে কুপোকাত হওয়া! তাই সাবধান করি।
মনে রাখবেন, নেতা-কর্মীদের নিয়ে কমিটি করা, ফোনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলা, নির্দেশ দেওয়া কিংবা মিছিল মিটিংয়ে হাজির হওয়া—এসব দিয়ে নীতিনির্ধারক বা স্টেটসম্যান হওয়া যায় না। শুধু পিপল ম্যানেজমেন্টকে রাজনীতি বলে না। অবশ্যই ছাত্রদের ব্যক্তিগত জীবনেও নীতি ও নৈতিকতার চর্চা করতে হবে। নিজেদের উৎপাদনশীল রাখতে কাজের সঙ্গে নিজের জীবনের ভারসাম্য রক্ষা বা ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালান্স করতে হবে।
আপনি বিদ্যমান রাজনৈতিক দলের কাছে ‘নতুন রাজনীতি’ চান, কিন্তু নিজেই যদি পুরোনো রাজনীতির মধ্যে থেকে পুরোনো রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার চর্চা করেন, তা হলে দেশের টেকসই উন্নয়নে তা কার্যকর ভূমিকা রাখবে না।
রাজনীতি কঠিন কাজ, ভুলের মাধ্যমে (‘ট্রায়াল অ্যান্ড এরর’) রাজনীতিতে শেখা যায়। তবে ১৮ কোটি মানুষের দেশে ভুলের মাশুল কমাতে প্রাক্-প্রস্তুতি ও ব্যাপক সক্ষমতায় গুরুত্ব দেওয়া চাই। এটাই ‘নতুন রাজনীতি’র ভিত্তি।
আমি চাই, নিজেদের মধ্যে বিবাদ মীমাংসা করে গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং গণ অধিকার পরিষদের বিভিন্ন পক্ষগুলো, পাবলিক-প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় মিলে যৌথভাবে রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করুক। এতে ছাত্রদের ঐক্যের সূত্র রচিত হবে। ছাত্ররা ক্যাম্পাসে দলীয় রাজনীতি করবে না, দলীয় কার্যালয়ে গিয়ে নীতিভিত্তিক রাজনীতি করবে।
রাজনৈতিক দল গড়া দীর্ঘ সময় ও শ্রমসাধ্য কাজ। এখানে সংবাদমাধ্যম, বুদ্ধিজীবী ও নাগরিক সমাজের সঙ্গে যুক্ততা লাগবে। পেশাজীবীদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে হবে। রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মসূচি পাশাপাশি চালাবে। আমি চাই, ছাত্ররা সংস্কার ও কর্মসূচির বিপরীতে উন্মুক্তভাবে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের কাছ থেকে দান ও অনুদান নিক এবং অর্থ খরচের জবাবদিহি করুক। তারা চাঁদাবাজি না করুক, বরং চাঁদাবাজি ঠেকাক। একটা রাজনৈতিক দলের নীতি গবেষণার জন্য জরিপ ও গবেষণাকাজে মাসে কোটি টাকার বরাদ্দ দরকার। এটা সংগ্রহের স্বচ্ছ ব্যবস্থা নিয়ে বণিক সমিতির সঙ্গে আলাপ ওঠানো যেতে পারে।
বাংলাদেশে গঠনের আগেই নতুন দলগুলো ভেঙে যায়, এটা থামাতে বড় দল থেকে অভিজ্ঞতা নেওয়া যায়। ব্যক্তিকেন্দ্রিক দল পরিচালনা, কর্মসূচি না থাকা, দায়িত্ব বণ্টন না করায় নেতা-কর্মীরা দল ছাড়েন। বাজারে আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগী ব্যবসায়ীদের বিপুল পরিমাণ কালোটাকা রয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিবেশী দেশের আধিপত্য ফিরিয়ে আনতে এবং আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনের প্রকল্প হিসেবে ছাত্রদের ঐক্য বিনষ্টে কালোটাকা ছড়ানো হতে পারে। দলীয় বিশৃঙ্খলা, টাকার লোভ, কালোটাকার হাতছানি ও নেতা-কর্মীদের কেনাবেচার কারণে নতুন দল ভেঙে যায়।
টানা ১৫ বছর চেষ্টা করেও ফ্যাসিবাদী সরকারব্যবস্থাকে বিএনপিকে ভাঙতে পারেনি। কিংস পার্টি গড়তে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার শত শত কোটি টাকার বিনিয়োগ বিফলে গেছে। বড় দল হিসেবে বিএনপির টিকে থাকার অভিজ্ঞতা ছাত্রদের ‘লার্নিং কার্ভ ইম্প্রুভ’ করবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের ‘নতুন রাজনীতি’ কী, নতুন দলের ইশতেহার, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণে নীতি কর্মপরিকল্পনা লাগবে। কর্মসংস্থান কৌশল, আর্থিক ও ব্যাংকিং সংস্কার; নদী রক্ষা, পানি, পরিবেশ, খাদ্য ও কৃষিনিরাপত্তার কৌশলপত্র তৈরি করা লাগবে। ডিজিটাল রূপান্তরের পথনকশা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মাস্টারপ্ল্যান, আইটি নিরাপত্তা, জলবায়ু পরিবর্তনে নতুন নীতি কর্মপরিকল্পনা লাগবে। ছাত্ররা এসব বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সঙ্গে মিলে করবে, দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা বিশেষজ্ঞদের নিয়ে মন্ত্রণালয় ও ডোমেইনভিত্তিক রিসোর্স পুল বানাতে হবে।
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন কমিশন, রেগুলেটরি প্রতিষ্ঠান গঠন ও সংস্কারের রূপরেখা এবং রোডম্যাপ লাগবে। বিদেশনীতি, প্রতিরক্ষানীতি তৈরি করতে হবে। স্বৈরাচারের পক্ষে সম্মতি উৎপাদন করেনি, এমন সংবাদমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের সঙ্গে যুক্ততার পরিকল্পনাও লাগবে। ছাত্ররা ‘আইডেনটিটি পলিটিকস’ বা আত্মপরিচয়ের রাজনীতি করবে নাকি ‘পলিসি-বেজড পলিটিকস’ বা নীতিভিত্তিক রাজনীতি করবে—তা ঠিক করতে হবে। কেন তারা অন্যদের চেয়ে ভিন্ন, ‘নিউ পলিটিকস’ অর্থাৎ ‘নতুন রাজনীতি’র সংজ্ঞায়ন লাগবে। মানুষকে কী দিতে চায়, কীভাবে দিতে চায়, এই পদ্ধতি কেন অন্যদের চেয়ে ভিন্ন—এসব উত্তর দিতে হবে। অন্যথায় নতুন দলের যৌক্তিকতা নেই।
বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বন্ধ, ভয়ের সংস্কৃতি বিস্তারে হাজার হাজার বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, খুনসহ মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং সর্বোপরি ছাত্র-জনতা গণহত্যার দায়ে আওয়ামী লীগ ভয়াবহ পরিণতি এবং গণবিচারের মুখোমুখি। আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য গণবিলুপ্তির পর দেশে নতুন রাজনীতির দরকার পড়েছে। (সম্ভাব্য বলছি কারণ, বর্তমান সরকার ও পরের সরকার ব্যর্থ হলে, ব্যাপক কর্মসংস্থান করতে না পারলে, অর্থনৈতিক সংকট সমাধানে ব্যর্থ হলে, সমাজে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা না করতে পারলে আওয়ামী লীগ ফিরে আসবে, জীবন পাবে)।
আওয়ামী লীগের অবর্তমানে শূন্যতা পূরণে, নির্বাচনী রাজনীতিতে একচেটিয়াত্বের বিপদ থেকে রক্ষা পেতে ছাত্রদের সম্মিলিত পদক্ষেপে নতুন রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন আছে। এখানে ক্ষমতাপ্রত্যাশী পুরোনোদের যেমন চারিত্রিক শুদ্ধি, গণতান্ত্রিক এবং নৈতিক রূপান্তর দরকার, তেমনি গণতান্ত্রিক বিকাশে সম্ভাব্য বিরোধী দল হিসেবে গড়ে তুলতে নতুনদের উৎসাহিত করাও দরকার।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে আমি বিএনপি নেতৃত্বকে অনুরোধ করব, বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের সম্মিলিত নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের চেষ্টাকে সার্বিকভাবে সমর্থন করুন। বাংলাদেশে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের আধিপত্য এবং স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন ঠেকাতে গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তিগুলোর রাজনৈতিক দল গঠন কার্যকরী পদক্ষেপ বিবেচিত হলে, ছাত্রদের উচিত উদ্যোগটা নেওয়া এবং বিএনপির উচিত সেটাকে স্বাগত জানানো।