মণিপুরে সহিংসতা কি বন্ধ হবে না?
Share on:
কয়েক দিন আগে জাতিগত সংঘর্ষ নিয়ে মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংয়ের বিতর্কিত কয়েকটি অডিও টেপ ফাঁস হয়। এতে কাংপোকপি জেলায় নতুন করে সহিংসতা দেখা দেয়। ঘটনায় দু’জন নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়। গত ১ সেপ্টেম্বর সশস্ত্র এক গোষ্ঠী পশ্চিম ইম্ফল জেলার মেইতি সংখ্যাগরিষ্ঠ কাউতরুক গ্রামে ড্রোনের মাধ্যমে বোমা বর্ষণ করলে সংঘর্ষ বাধে।
কাউতরুক গ্রামের পঞ্চায়েত চেয়ারম্যান সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, রোববার দুপুর ২টার দিকে এক দল সশস্ত্র লোক বিনা উস্কানিতে গুলি চালায়। মেইতি পরিবেশবাদী কর্মী লিসিপ্রিয়া কাঙ্গুজাম বলেছেন, ‘আজ পশ্চিম ইম্ফলে ড্রোন থেকে বোমা হামলায় কুকিদের অল্পবয়সী এক মা তাঁর নাবালিকা মেয়ের সামনে নিহত হয়েছেন। আরও অনেকে আহত হয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে আপনি কী ব্যবস্থা নেবেন?
কুকি-জো নাগরিক সমাজের সংস্থাগুলো আক্রমণে কুকিদের জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছে। তারা দাবি করেছে, বিতর্কিত ‘বীরেন টেপ’ প্রকাশের পর অশান্তির প্রতিক্রিয়া হিসেবে সহিংসতার সূত্রপাত ঘটে। তারা এ ক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংয়ের ভূমিকা তুলে ধরেন।
গত বছর শুরু হওয়া জাতিগত সংঘর্ষে ২২১ জন প্রাণ হারিয়েছে। পাহাড়ি বাসিন্দা কুকি-জো সম্প্রদায় অসম সহিংসতার শিকার হচ্ছে। মেইতি জনগোষ্ঠী সেখানকার উপত্যকা ও রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে। সংবাদমাধ্যম ‘দ্য অয়ার’ সরকারি কেন্দ্রীয় তদন্ত কমিশনের কাছে অডিও টেপ জমা দিয়েছে। সম্প্রতি এগুলো সর্বসাধারণের হাতে এসেছে। এতে মনে হচ্ছে, বীরেন সিং ও তাঁর প্রশাসন সংঘর্ষে সরাসরি জড়িত ও দোষী, যা এখন দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে বিস্তার লাভ করে চলেছে।
এ সংঘাত মণিপুরকে জাতিগতভাবে বিভক্ত করেছে। এ ছাড়া সামরিকায়িত বাফার জোন মেইতি অধ্যুষিত ইম্ফল অঞ্চল এবং এর পাদদেশ কুকি-জো অধ্যুষিত পার্বত্যাঞ্চল যেমন চুরাচাঁদপুরও বিভক্ত হয়েছে। নাগাদের মিশ্র জনসংখ্যা এবং সেখানে বসবাসকারী অভিবাসী সম্প্রদায়ের কারণে উপত্যকা থেকে আরেকটি কুকি-জো সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল কাংপোকপি আলাদা করার কোনো বাফার জোন নেই। অঞ্চলটি অবশ্য উত্তেজনাপূর্ণ, তবে গ্রামীণ স্বেচ্ছাসেবক ও অন্যদের মধ্যে সিওটিইউ ও কুকি শিক্ষার্থীদের সংগঠন কেএসওর মতো ট্রাইবাল সংগঠনের সদস্যদের দ্বারা কঠোরভাবে সংরক্ষিত।
অভূতপূর্ব এ পরিস্থিতিতে বছর ধরে মেইতি অধ্যুষিত মণিপুর বিধানসভায় অধিবেশন চলছে। কুকি-জো আইনপ্রণেতাদের ১০ জন ইম্ফলে ব্যক্তিগতভাবে অধিবেশনে যোগ দিতে পারছেন না। ইম্ফল বা এর আশপাশে কোনো কুকি-জো লোক অবশিষ্ট নেই। একইভাবে ট্রাইবাল অঞ্চল থেকে মেইতি জনগোষ্ঠীকে বাস্তুচ্যুত করা হয়েছে। গত বছর থেকে রাজ্যজুড়ে সহিংসতা কমে এলেও গেল কয়েক মাসে এসব অঞ্চলে বন্দুকযুদ্ধের বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। এ খবরে সীমান্তের গ্রামগুলো অস্থির হয়ে পড়ে।
জাতিগত ও ভৌগোলিকভাবে বিভক্ত কুকি-জো দলগুলো পার্বত্য জেলাগুলোর জন্য আলাদা প্রশাসনের দাবি জানিয়েছে। কুকি ইনপি মণিপুরের সভাপতি আজং খংসাই চুরাচাঁদপুরে বলেছিলেন, ‘মিলন সম্ভব নয়। আমরা ইম্ফলের কোনো সরকারি বা বেসরকারি অফিস, অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান এমনকি হাসপাতালেও যেতে পারি না। এমনকি কুকি-জো সম্প্রদায়ের পুলিশ কর্মকর্তারাও তাদের জীবন বিপন্ন না করে ইম্ফল পরিদর্শন করতে পারেন না।’
চুরাচাঁদপুর, কাংপোকপি ও তেঙ্গুওপালের মতো উপজাতি সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাগুলো থেকে আসাম রাইফেলস (এসএআর) সৈন্য প্রত্যাহার করা হয়েছে। কুকি-জো সম্প্রদায়গুলো রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে বিক্ষোভ করছে। সংঘর্ষের পর এসএআর সেখানে অবস্থান করছিল, তবে বর্তমানে তাদের পরিবর্তে সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স (সিআরপিএফ) মোতায়েন করা হয়েছে। চুরাচাঁদপুরের ছাত্রনেতা গ্রেসি হাওকিপ বলেছেন, “আসাম রাইফেলস সরিয়ে দিলে এ অঞ্চলের কুকি-জো বাসিন্দারা ‘গুরুতর বিপদে’ পড়বে। মণিপুর পুলিশ বা কমান্ডোদের ওপর আমাদের কোনো আস্থা নেই, যারা শুধু মেইতিদের সেবা করে। গত বছর আমরা দেখেছি কীভাবে মণিপুর কমান্ডো ও রাষ্ট্রীয় বাহিনী কুকি গ্রামে হামলা ও ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগে সশস্ত্র মেইতিদের সাহায্য করেছিল।”
সংঘর্ষে মেইতি ও কুকি-জো উভয় সম্প্রদায়ের ৬০ হাজারের বেশি লোক ভিটেবাড়ি হারিয়েছে। তাদের অনেকেই উপত্যকা ও পার্বত্য উভয় এলাকায় ত্রাণশিবিরে রয়েছে। এ ছাড়া আরামবাই টেঙ্গোলের মতো গোষ্ঠীগুলোর ক্রমবর্ধমান শক্তিও মেইতিদের মধ্যে ক্ষোভ ও নিপীড়নের ভয়ের উদ্রেক করেছে। ফলে নীরবতার কারণে তারা শাস্তি থেকে রেহাই পেয়েছে।