মণিপুরে সশস্ত্র কুকিদের উত্থান ও দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতি
Share on:
মণিপুরে সশস্ত্র কুকিদের হঠাৎ উত্থান ভারতীয় এস্টাবলিশমেন্টে নাড়া দিয়েছে, কিন্তু সংবাদমাধ্যমের কিছু অংশ এই সহিংস অবস্থা ঠেকাতে পেশি শক্তি প্রয়োগের দাবি জানাচ্ছে। এতে গুরুতর পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে।
আরাকান আর্মি বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং রোহিঙ্গা সংকটের গতিপথ প্রভাবিত করার ক্ষমতাসহ বঙ্গোপসাগরের আঞ্চলিক নিরাপত্তা নির্ধারণে অন্যতম খেলোয়াড় হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। এখন পর্যন্ত জাতিগত সশস্ত্র সংগঠন ও পিপল’স ডিফেন্স ফোর্সের মতো পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ট বিদ্রোহী দলগুলো আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সশস্ত্র দলগুলো এখনও অঞ্চলগুলোর স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া থেকে বিরত থেকেছে। এ অবস্থানকে আপাতত কৌশলগত সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখাই সংগত। অনিবার্যভাবে স্বদেশের সীমানা নির্ধারণ করতে গিয়ে তারা উত্তপ্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হবে, যা আন্তঃজাতিগত ভাঙনের যথেষ্ট কারণ হবে। সামগ্রিকভাবে একাধিক সশস্ত্র গোষ্ঠী বিভিন্ন অঞ্চলে ক্ষমতালাভের জন্য লড়াই করছে। এতে মিয়ানমার খণ্ডিত সার্বভৌমত্বের একটি জায়গায় পরিণত হয়েছে।
চীনবিদ্বেষী ভারতীয় ভাষ্যকাররা ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে ভারত ও চীনের মধ্যে নিরাপত্তা স্বার্থের দ্বন্দ্বের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন (কিছু বিশ্লেষক বাংলাদেশের সাম্প্রতিক শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তনে চীনের হালকা উস্কানি রয়েছে বলে ধারণা করছেন)। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর পক্ষে চীনা উস্কানির কোনো বাস্তবভিত্তিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
মিয়ানমার বিষয়ে চীন একাধিক গোষ্ঠীর সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। যেমন–বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক স্বার্থের বিশাল শরিকানা, মিয়ানমারের আইন কার্যকর নয়, এমন সীমান্তগুলোতে অপরাধী সিন্ডিকেটের নিরাপত্তাজনিত উৎকণ্ঠা। চীনের প্রাথমিক উদ্বেগ হলো, সেনাবাহিনী খণ্ড-বিখণ্ড হলে মিয়ানমার সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়ে যেতে পারে।
এ কারণে চীন অনেক সশস্ত্র গোষ্ঠীর–বিশেষত ইউনাইটেড ওয়া স্টেট আর্মি ও থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স–সঙ্গে কার্যকর সম্পর্ক রক্ষা করে। মজার বিষয়, চীন ইউনাইটেড ওয়া স্টেট আর্মিকে সীমান্ত নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার কারণ হিসেবে দেখে। এমনকি দেশটি তাদের চীনা বাজার থেকে বাণিজ্যিক ড্রোন সংগ্রহ করা এবং মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে তা ব্যবহারের অনুমতি দেয়। ধারণা করা যায়, ইউডব্লিউএসএ দলের মাধ্যমে চীনা অস্ত্র অন্যান্য বিদ্রোহী জাতিগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছাচ্ছে।
এর মানে এই নয়, চীন মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহ করছে না। চলতি মাসে প্রকাশিত জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত দুই বছরে চীন মিয়ানমারকে জঙ্গি বিমান, ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি, নৌ সরঞ্জাম ও অন্যান্য দ্বৈত ব্যবহারযোগ্য সামরিক সরঞ্জামের জোগান দিয়েছে।
যৌক্তিকভাবে বলা যায়, মিয়ানমারের স্থিতিশীলতার জন্য নেপিদোর কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যুক্ত হতে চীন, ভারত ও আসিয়ানের মধ্যে স্বার্থের সমঝোতা রয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে শুধু চীনই জোরেশোরে সক্রিয়। আসিয়ানের সঙ্গে ভারতের নির্দিষ্ট সময় পরপর যোগাযোগ হলেও নিশ্চিতভাবে সেটা চীনের সঙ্গে ঘটছে না। ভারত সরাসরি মিয়ানমার সামরিক নেতৃত্বের সঙ্গে যুক্ত থাকার বিষয়টির ওপরই গুরুত্ব দেয়।
এই পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থার পালাবদল সম্ভবত খেলার মোড় ঘোরানোর মতো একটি ঘটনা। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হাসিনার হস্তক্ষেপহীন নীতি পরিত্যাগ করতে পারেন ঢাকার নতুন শাসকরা। পশ্চিমা স্বার্থের ককপিট হিসেবে অত্যন্ত কৌশলগত বঙ্গোপসাগরের উপকূলরেখা বরাবর রাখাইনে একটি প্রোটো-রাষ্ট্র তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে।
মিয়ানমারের অন্যতম শক্তিশালী সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি এ
ধারণার বিরোধী। রাখাইনের উত্তরে তারা ইতোমধ্যে একটি জটিল ত্রিমুখী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। আরাকান আর্মির লক্ষ্য হলো, রাখাইনের জনসংখ্যার ৬৫ শতাংশ বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর জন্য একটি স্বায়ত্তশাসিত ছিটমহল তৈরি করা।
আরাকান আর্মি বর্তমানে কেন্দ্র ও উত্তরে ৯টি শহরের সামগ্রিক নিয়ন্ত্রণে আছে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ সীমান্তের বেশির ভাগ অংশ এর অন্তর্ভুক্ত। এটি শিগগিরই রাজ্যের রাজধানী সিত্তেসহ দক্ষিণে অবস্থিত সামরিক বাহিনীর আঞ্চলিক কমান্ড সদরদপ্তর হস্তগত করতে পারে। রাখাইন জনগণের মধ্যে আরাকান আর্মি অত্যন্ত জনপ্রিয়। মুসলিম রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বৌদ্ধ রাখাইনে একটি নৃশংস যুদ্ধের আশঙ্কা রয়েছে। এতে বহিরাগত শক্তি নিশ্চিতভাবে জড়িত থাকবে।