সম্পাদকীয় প্রকাশনার সময়: বুধবার ১৮, সেপ্টেম্বর ২০২৪

মাজার–খানকায় হামলা বন্ধে সরকারকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে

Share on:

গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বেশ কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে। অন্তর্বর্তী সরকার আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা ও দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে।


বিভক্তির বদলে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ক্ষমতার পালাবদলের সময় পুলিশ ও জনপ্রশাসনে যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল, তা স্বাভাবিক অবস্থায় আসতে শুরু করেছে।

এসব ইতিবাচক পরিস্থিতির পাশাপাশি সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে মাজার, খানকা বা পীরের আস্তানা ও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের যে ঘটনা ঘটেছে, তা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। একশ্রেণির মানুষ কোথাও কোথাও মাজার-খানকা গুঁড়িয়ে দিয়েছে। আবার কোথাও গানবাজনা না করার বিষয়ে মাজার কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে জোরপূর্বক অঙ্গীকার আদায় করে নিচ্ছে।

আমরা মনে করি, কোনো অজুহাতেই কোনো ধর্মীয় স্থাপনায় হামলার সুযোগ নেই। এ ধরনের কর্মকাণ্ড নিজ নিজ ধর্মীয় বিশ্বাসচর্চার যে সুযোগ নাগরিকদের রয়েছে, তার পরিপন্থী। যাঁরা এসব কাজ করছেন, তঁারা আইন ভাঙছেন। সংশ্লিষ্টদের অনেকের অভিযোগ, এসব মাজার-খানকায় মাদক সেবনসহ নানা অসামাজিক ঘটনা ঘটে। আমরা বলতে চাই, আইনবিরোধী কিছু কোথাও ঘটলে, সেটা দেখার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। আইন নিজের হাতে তুলে না নিয়ে থানা-পুলিশকে অবহিত করাই হচ্ছে এই সমস্যার প্রতিকারের পথ।

বাংলাদেশের এসব ঘটনায় কেবল দেশের মানুষ নয়, প্রবাসীরাও উদ্বেগ জানিয়েছেন। মাজার ও মন্দির সুরক্ষার আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টাকে ১০০ প্রবাসী খোলা চিঠি লিখেছেন।

এর পাশাপাশি সম্প্রতি কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে তরুণীদের লাঠি দিয়ে বেধড়ক মারধর, কান ধরে ওঠবস করানোর যে ঘটনা ঘটেছে, তা খুবই লজ্জাজনক। সমুদ্রসৈকত, যেখানে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের বিপুল সমাগম থাকে, সেখানে এ রকম নারী নিগ্রহের ঘটনা দেশের ভাবমূর্তির জন্য ক্ষতিকর। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দুই তরুণীকে হেনস্তা করার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দুর্ভাগ্যজনকভাবে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। পরে এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার পর পুলিশ মোহাম্মদ ফারুকুল ইসলাম নামের অভিযুক্ত যুবককে আটক করে।

বাংলাদেশে মাজার-খানকা ও নারীর পোশাক নিয়ে অপপ্রচার ও বিদ্বেষ ছড়ানোর ঘটনা নতুন নয়। একশ্রেণির পুরুষ সব সময়ই নারীকে নানাভাবে হেনস্তা করে। আর এ ক্ষেত্রে সব সময় ধর্মকে ব্যবহার করে। সাম্প্রতিক স্বৈরাচারবিরোধী গণ-অভ্যুত্থানে নারী শিক্ষার্থীসহ নারীদের অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখ করার মতো। গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী পরিস্থিতিতে যদি নারীরা নিগ্রহের শিকার হন, তবে তা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে ধর্মীয় উপাসনালয় ও সাংস্কৃতিক স্থাপনাগুলো রক্ষায় পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের জারি করা এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলছি, আমরা সম্প্রীতির দেশ হিসেবে থাকব এবং ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক সহিষ্ণুতা ও সম্প্রীতি বিঘ্নিত করার যেকোনো প্রচেষ্টা নির্দ্বিধায় কঠোরভাবে দমন করা হবে।’

গত সপ্তাহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত সমাবেশে মাজার ও ধর্মীয় স্থাপনায় হামলার প্রতিবাদ ও ধর্মীয় বহুত্ববাদী চেতনা সমুন্নত রাখার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। ৪৬ জন বিশিষ্ট নাগরিক যৌথ বিবৃতিতেও মাজারসহ ধর্মীয় স্থাপনার নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

গণতান্ত্রিক সমাজ মানেই ভিন্নমত ও বিশ্বাসের মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা। কোনো বিষয়ে আপত্তি থাকলে আইনানুগভাবে প্রতিকার চাইতে হবে। কোনোভাবে আইন নিজের হাতে তুলে নিতে দেওয়া যাবে না। আমরা আশা করব, প্রতিটি মাজার-খানকা ও অন্যান্য ধর্মীয় স্থানের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকার অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে।

প্রথম আলো