মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: শনিবার ২৭, জুলাই ২০২৪

মিছিলের এত মানুষ, মাঠে নেই না কেন?

Share on:

কোটা সংস্কার নিয়ে ছাত্র আন্দোলনটি যেভাবে সব রকম প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে সফল হলো, তা নিঃসন্দেহে যে কোনো রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকের কাছেই দারুণ তাৎপর্যপূর্ণ এক বিষয়। এ দেশে আজ পর্যন্ত সংঘটিত সব সফল ছাত্র আন্দোলনেই নেতৃত্ব দিয়েছেন রাজনৈতিক ছাত্র নেতৃত্ব।


কেউ কেউ ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন বলে থাকেন। তবে এটা এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, ওই আন্দোলনের নেতা প্রায় সবাই ছিলেন কমিউনিস্ট বা জাতীয়তাবাদী ধারার রাজনৈতিক দলের সদস্য।

২০১৮ সালে একই কোটা সংস্কার নিয়ে যে আন্দোলন হয়, তার নেতৃত্ব আপাতদৃষ্টে অরাজনৈতিক হলেও তাদের যে একটা সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক অভিলাষ ছিল, তা এখন কারও অজানা নয়। এবারের আন্দোলন দেখিয়ে দিয়েছে, অন্তত শিক্ষার্থীদের দাবি আদায়ে প্রতিষ্ঠিত ছাত্র সংগঠন জরুরি নয়। সে হিসাবে নির্দিষ্ট মতাদর্শভিত্তিক যে ছাত্র রাজনীতি এক সময় এ দেশে রমরমা ছিল, তারও দিন হয়তো গত হয়েছে।

এ পর্যবেক্ষণ নিয়ে হয়তো বিতর্ক হতে পারে, তবে এই বিতর্ক এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। আমার উদ্দেশ্য এবারের আন্দোলনের আরেকটা অভূতপূর্ব ঘটনার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা, যা বিশেষত বর্তমান তো বটেই, ভবিষ্যতের শাসক দলের জন্যও বেশ শিক্ষণীয়। ঘটনাটা হলো, সম্ভবত এই প্রথম ক্ষমতাসীনদের দলীয় শক্তি একটা ছাত্র আন্দোলনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ তো নয়ই; যুবলীগ বা সরকারদলীয় অন্য কোনো সংগঠনই আন্দোলনকারীদের সামনে তিষ্ঠাতে পারেনি।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের রাজনীতির বহু নেতিবাচক প্রবণতার অন্যতম হলো, যে কোনো আন্দোলন দমনে ক্ষমতাসীনদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি দলীয় শক্তির অপব্যবহার। মূলত স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ে সামরিক শাসকদের হাত ধরে এর শুরু হলেও দুর্ভাগ্যবশত স্বাধীনতা-পরবর্তীকালেও এর অবসান হয়নি। এবং এ ক্ষেত্রে সামরিক শাসন তো দূরস্থান, গণতান্ত্রিক আমলেও কোনো ব্যতিক্রম দেখা যায়নি। কি আওয়ামী লীগ কি বিএনপি; যখন যে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় এসেছে, তখন সে-ই জনগণের জানমালের হেফাজত ও উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার কথা বলে যে কোনো জনবিক্ষোভ দমাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি দলীয় পেটোয়া বাহিনী নামিয়েছে। এই যে আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর ইতোমধ্যে টানা তিন মেয়াদ পূর্ণ করেছে, এর পুরো সময়টাতেই যে কোনো প্রতিবাদ-বিক্ষোভকে ‘ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করা’র এমন শাসকদলীয় অপসংস্কৃতি দেখা গেছে।

গত দু’তিন বছর তো যখনই ক্ষমতাসীনদের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি যেখানেই সমাবেশ করতে গেছে, তার পাশেই হয় আওয়ামী লীগ নয় তো তার কোনো সহযোগী বা ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন কথিত ‘শান্তি সমাবেশ’ করেছে। যখন প্রশ্ন উঠেছে, রাজপথে শান্তি রক্ষার কাজ পুলিশ বা অন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর, সেখানে আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগ-যুবলীগের কাজ কী? তখনই উত্তর এসেছে– বিএনপি-জামায়াতের সরকারবিরোধী ‘ষড়যন্ত্র’ মোকাবিলায় তারা ‘অতন্দ্র প্রহরী’ হিসেবে রাজপথে আছে। এমনকি এ ধরনের পাল্টাপাল্টি সমাবেশের কারণে কয়েকবার উভয় পক্ষের মধ্যে প্রাণঘাতী সংঘাতের পরও তারা ওইসব, পর্যবেক্ষকদের ভাষায়, উস্কানিমূলক তৎপরতা বন্ধ করেনি।

কিন্তু ১৫ জুলাই ছাত্রলীগের নেতাকর্মী বিশেষত আন্দোলনটির প্রাণকেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর ন্যক্কারজনক হামলা চালিয়ে ৬ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে তাদের প্রতিরোধের মুখে ক্যাম্পাস ছাড়তে বাধ্য হয়। আরও বিস্ময়কর হলো, সরকার সমর্থিত ছাত্র সংগঠনের আপাত সুরক্ষিত দুর্গ পতনের একই চিত্র অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও দেখা গেছে খুব অল্প সময়ের মধ্যে।

এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে জহুরুল হক হল পাকিস্তান আমলেও ছাত্রলীগের দুর্ভেদ্য ঘাঁটি বলে পরিচিত ছিল, তাও এবার তার হাতছাড়া হয়েছে। এমনকি ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর দেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও বিপুল ঐতিহ্যের ধারক সংগঠনটির ওপর যে দীর্ঘ স্টিমরোলার চলেছে, তখনও হলটিতে তারাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ।

শুধু ছাত্রলীগ কেন? যে যুবলীগ নেতারা গত সংসদ নির্বাচনের আগে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক সমাবেশে বলেছিলেন, বিএনপি-জামায়াতকে রুখতে যুবলীগই যথেষ্ট; তাদের কারও টিকি খুঁজে পাওয়া যায়নি বিশেষ করে ১৮ জুলাই শিক্ষার্থীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি শুরু হওয়ার পর।

ছাত্রলীগ-যুবলীগ ছাড়াও ক্ষমতাসীনদের অসংখ্য সংগঠন আছে– স্বেচ্ছাসেবক লীগ, শ্রমিক লীগ, প্রজন্ম লীগ, বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগ, ওলামা লীগ, মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগ, মুক্তিযোদ্ধা সন্তান লীগ ইত্যাদি বাহারি নামের। সংবাদমাধ্যম দেখলে মনে হয়, এরা যেন সাংগঠনিক শক্তিতে উপচে পড়ছে; মাঝে মাঝেই এরা নিজেদের মধ্যে বা পরস্পর এমনকি সশস্ত্র সংঘাতেও লিপ্ত হয় টেন্ডার, ইজারা ইত্যাদির ভাগবাটোয়ারা নিয়ে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকই তো বহুবার বলেছেন, এত এত লীগের ভিড়ে অফিসে ঢোকাও মাঝে মাঝে তাঁর পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। এই বিশাল শক্তি প্রায় ঢাল-তলোয়ারবিহীন শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে একেবারে হাওয়া হয়ে গেল!

আমি বলছি না, এসব সংগঠনের নেতাকর্মীর আন্দোলনকারীদের মুখোমুখি অবস্থান গ্রহণ করা উচিত ছিল। আমি এ কথাও বলছি না, কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে দেশজুড়ে যে ব্যাপক সহিংসতা, নাশকতা ঘটল; ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীর দায়িত্ব ছিল তার বিরুদ্ধে মাঠে থাকা। এটা হলে বরং পরিস্থিতি হয়তো আরও জটিল হতো। কিন্তু একটি রাজনৈতিক সরকার এবং জনগণের মধ্যে সেতুবন্ধ হিসেবে প্রথমত দলীয় নেতাকর্মীই কাজ করে; জনগণের মধ্যে সরকারের কোনো ব্যর্থতা নিয়ে ক্ষোভ প্রশমনেও তাদের চেষ্টা থাকার কথা বেশি। তৃণমূলের সঙ্গে একটি দলের সম্পর্ক যত নিবিড় হয়, গভীর শিকড়ওয়ালা বৃক্ষের মতো সে দল শত ঝড়-ঝঞ্ঝাতেও কাবু হয় না। কিন্তু সে কাজটি করতে পারেনি আওয়ামী লীগের সাইনবোর্ডধারী বিশালসংখ্যক লোক।

শুধু ছাত্রলীগের কথাই ধরা যাক। দেড় দশক ধরে দেশের প্রায় সব ক্যাম্পাস তাদের দখলে। হলগুলোতে তাদের অনুমতির বাইরে কারও অবস্থান আসলেই অসম্ভব। এবারের আন্দোলনের শুরুর দিকে ছাত্রলীগ নেতৃত্ব এমনও দাবি করেছেন, আন্দোলনকারীদের মধ্যে তাদের বহু নেতাকর্মী ও সমর্থক আছেন। কিন্তু ঘটনাপ্রবাহ প্রমাণ করে, আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ নেতাদের কোনো পর্যায়েই কোনো সংযোগসূত্র ছিল না। তবে কি ছাত্রলীগের আপাতবিশাল দেহটা ছিল বাস্তবে গোদ রোগাক্রান্ত পায়ের মতো?

যদি বলা হয়, বছরের পর বছর ক্ষমতাসীনদের একই অস্ত্রের এহেন অপব্যবহার অস্ত্রটিকে ভোঁতা করে দিয়েছে, তাহলে হয়তো ভুল হয় না। তবে যেভাবে সরকারি দলের প্রায় পুরো সাংগঠনিক কাঠামো ঝড়ের মুখে প্রায় উধাও হয়ে গেল, তাতে মনে হয়, সমস্যার শিকড় আরও গভীরে। এমনিতেই ক্ষমতায় থাকলে যে কোনো দলে সুবিধাবাদীদের ভিড় হয় বেশি। তবে আওয়ামী লীগে তা সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে। দলীয় আদর্শের স্পর্শহীন এবং টেন্ডার-নিয়োগ-পদ বাণিজ্যে মত্ত এসব সুযোগসন্ধানীর ভিড় এতটাই বাড়ে যে, আওয়ামী লীগের দীর্ঘ সময়ের ত্যাগী সদস্যরা কোণঠাসা হয়ে পড়েন।

বুধবারের সমকাল বলেছে, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বও সমস্যাটার উৎস খুঁজছেন। প্রশ্ন হলো, তা খুঁজে পেলে কার্যকর সমাধানের পথে কি তারা হাঁটবেন? একমাত্র সময়ই তা বলবে।

সাইফুর রহমান তপন: সহকারী সম্পাদক, সমকাল

দৈনিক সমকাল