মাঙ্কিপক্স ভাইরাস নিয়ে বাংলাদেশ কতটা আতঙ্কিত!
Share on:
গত ১৪ আগস্ট বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশ্বব্যাপী জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে মাঙ্কিপক্স প্রতিরোধে। এবারের ভাইরাসটিও পশুবাহিত বা জুনোটিক। এর বিস্তার শুরু হয়েছে আফ্রিকায়, মূলত গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গোতে। ভাইরাসটি ছড়াচ্ছে। কঙ্গোতে প্রায় ১৭ হাজার কেস শনাক্ত হয়েছে; ছড়িয়েছে উগান্ডা, বুরুন্ডি, রুয়ান্ডা ও কেনিয়ায়।
১৫ আগস্ট সুইডেনেও এক রোগীর মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। অর্থাৎ ভাইরাসটি মহাদেশীয় সীমানা পেরিয়েছে। গত সপ্তাহে ভারতের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জরুরি ভিত্তিতে আলোচনায় বসেছে। ৩১ আগস্ট পাকিস্তানে উচ্চ পর্যায়ের মিটিং ডাকা হয়েছে। এখন পর্যন্ত দেশটিতে চারটি কেস শনাক্ত করা গেছে। কভিড-১৯ এর বিশ্বব্যাপী তাণ্ডবের পর ভাইরাসের বিস্তার নিয়ে প্রথমেই আতঙ্কের উদ্রেক হয়। তবে গুটিবসন্তের ভাইরাস পরিবারের সদস্য এই মাঙ্কিপক্স নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার জায়গায় সতর্কতা অবলম্বন দরকার। এ ভাইরাস বাতাসে ছড়ায় না। এর সংক্রমণের পথ অনেকটা এইডসের ভাইরাসের মতো।
মাঙ্কিপক্সের উপসর্গ অনেকটাই গুটিবসন্তের মতো। ভাইরাসটি ১৯৫৮ সালে প্রথম সিঙ্গাপুর থেকে ডেনমার্কে রপ্তানি করা একটি বানরের দেহে শনাক্ত করা হয়। এ কারণেই ভাইরাসকে মাঙ্কিপক্স নামে অভিহিত করা হয়। আদতে ভাইরাসটির মূল বাহক গাম্বিয়ার থলিযুক্ত ইঁদুর। ইঁদুর থেকে বানরে এবং বানর থেকে মানুষে এই ভাইরাস সংক্রমিত হয়েছে। বিজ্ঞানীরা নিশ্চিতভাবে জেনেছেন, মানবদেহে প্রথম এই ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে নাইজেরিয়ায়। তবে তা শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। পরে ১৯৭০ সালে প্রথম কনফার্মড কেস পাওয়া যায় কঙ্গোতে। এ ভাইরাসের দুটি মূল স্ট্রেইন রয়েছে– ক্লেড-১ ও ক্লেড-২। ক্লেড-২ ততটা ছোঁয়াচে নয়; প্রাণঘাতীও নয়। ২০২২ সালে আফ্রিকায় এই স্ট্রেইন ছড়ানো শুরু করে এবং পরে ১১৫টি দেশে এর উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। সে বছর ভারত ও শ্রীলঙ্কায় এসে পৌঁছলেও ভাইরাসটি বাংলাদেশে শনাক্ত হয়নি।
এ বছর বিপজ্জনক স্ট্রেইন ক্লেড-১ কঙ্গোতে মে মাসের শেষদিকে ছড়ানো শুরু করে। মৃতের সংখ্যা ২৩ আগস্টের হিসাবমতে ৫৪১। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এতে উদ্বিগ্ন। উদ্বেগের কয়েকটি কারণ আছে। একে তো এই স্ট্রেইন বেশি সংক্রামক। দ্বিতীয়ত, এতে মৃতের হার কভিড-১৯ এর চেয়ে কমপক্ষে দ্বিগুণ। তবে আশার কথা, এ ভাইরাস এখনও বাতাসে ছড়াচ্ছে না। এর সংক্রমণের জন্য ঘনিষ্ঠ শারীরিক যোগাযোগ, আক্রান্ত রোগীর কাপড় কিংবা ব্যবহার্যের সঙ্গে সংযোগ বা রোগীর জন্য ব্যবহৃত সিরিঞ্জ পুনর্বার ব্যবহারই দায়ী।
ক্লেড-২ স্ট্রেইনের ভাইরাসের ক্ষেত্রে গুটিবসন্তের টিকা প্রায় ৮৫ শতাংশ কার্যকর ছিল। অর্থাৎ আমাদের হাতে একটি টিকা অন্তত রয়েছে, যার কিছু কার্যকারিতা আছে। কভিড-১৯ এর মতো বিশ্ববাসীকে শূন্য থেকে প্রতিরোধ শুরু করতে হচ্ছে না।
বাংলাদেশের সামাজিক কাঠামো মাঙ্কিপক্স বিস্তারে ইন্ধন জোগানোর মতো নয়; যদিও এইডস ছড়ানো সম্পূর্ণ প্রতিরোধ সম্ভব হয়নি। সুতরাং মাঙ্কিপক্সের ঝুঁকি একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিশেষ দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায় বাংলাদেশের সঙ্গে আফ্রিকা মহাদেশের বাণিজ্যিক সুসম্পর্ক। বাংলাদেশ দক্ষিণ আফ্রিকাতে ২০২২ সালে ১৩৩ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি রপ্তানি করেছে মূলত গার্মেন্টস, ওষুধ এবং কৃষিজাত সামগ্রী। একই বছর দেশটি থেকে ১৮৫ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি মূল্যের তুলা আমদানি করেছি আমরা। এ ছাড়া কেনিয়া, মিসর ও মরক্কোর সঙ্গেও বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সুসম্পর্ক রয়েছে। আফ্রিকার দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের মিথস্ক্রিয়া আরও নানাভাবে বাড়ছে। কঙ্গোতে মাঙ্কিপক্সের মূল সংক্রমণ ঘটলেও দক্ষিণ আফ্রিকা ও কেনিয়ায় এ রোগ ছড়াচ্ছে বলে জানা গেছে। আর রোগটির মূল বাহক ইঁদুর যে গাম্বিয়ার স্থানীয়, এ কথা আমরা আগেই জেনেছি। বাংলাদেশের ঝুঁকি তাই রয়েই যাচ্ছে।
এই মুহূর্তে আফ্রিকায় যাতায়াতের ব্যাপারে সতর্কতা রাখতে হবে। ভ্রমণের সময় কোথায় থাকা হচ্ছে, কোন ব্যক্তির সঙ্গে মেলামেশা হচ্ছে, অসুস্থ হলে কোন হাসপাতালে চিকিৎসা হচ্ছে– এসব বিষয়ে সাবধানতা জরুরি। আফ্রিকা ভ্রমণ শেষে দেশে ফিরলে যদি বসন্তের মতো কোনো গোটা শরীরে দানা বাঁধে বা জ্বর আসে, তবে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া দরকার।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গুটিবসন্তের টিকা জোগাড় করে রাখতে পারে। ১৯৮০ সালের পর রোগটি পৃথিবী থেকে নির্মূল হয়েছে। তাই আমরা এ রোগ নিয়ে বিচলিত নই। তবে মাঙ্কিপক্স যেহেতু একই পরিবারের ভাইরাস থেকে হয়, তাই এ টিকার জোগাড়যন্ত্র করে রাখা বুদ্ধিমানের কাজ হবে। আক্রান্তদের জন্য ওষুধ রয়েছে কয়েকটি। অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ ‘টেকোভিরিম্যাট’ বা ‘টিপক্স’ বিভিন্ন দেশ মাঙ্কিপক্সে আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য জোগাড় করছে। এ ছাড়া এইডসের জন্য ব্যবহৃত ‘সিডোফোভির’ বা ‘ভিসটাইড’ ওষুধ ব্যবহার করা যেতে পারে, যা ভাইরাস লোড কমাতে সহায়তা করবে।
মাঙ্কিপক্সের এমন হঠাৎ মহামারিতে রূপান্তরিত হওয়ার প্রবণতা আশঙ্কাজনক ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দেয়। বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত করেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বন্য পশুপাখির আবাসস্থল হারিয়ে যেতে বসেছে। বনানী থেকে অনেক পশুই আশ্রয় নিচ্ছে লোকালয়ে। বনের প্রাণীর সঙ্গে গৃহপালিত পশুদের মিথস্ক্রিয়া বাড়ছে। কভিড-১৯ বা মাঙ্কিপক্সের অণুজীব বন্য পশু থেকে গৃহপালিত পশুতে আর তাদের থেকে মানুষে ছড়াচ্ছে। জুনোটিক ভাইরাসের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলেছে ক্রমাগত।
জনস্বাস্থ্যের ভবিষ্যৎ যেহেতু এইমুখী, তাই আগামীতে আমাদের নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে সতর্ক থাকতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা, ভাইরাস ছড়ানোর ইঙ্গিত পেলেই সার্ভেলেন্স স্কিম হাতে নেওয়া এবং জনসচেতনতার দিকে মনোযোগী হতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনে আমাদের নেতিবাচক ভূমিকা নগণ্য হলেও এর পরোক্ষ প্রভাব এই জুনোটিক অণুজীব বিস্তার থেকে প্রতিরক্ষার পদক্ষেপ আমাদেরই নিতে হবে।