মগের মুল্লুক থেকে মবের মুল্লুক, অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জনদাবি
Share on:
অরাজক পরিস্থিতি বোঝাতে বাংলায় বেশ জনপ্রিয় প্রবাদ ‘মগের মুল্লুক’। পঞ্চদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলায় ইন্দো-চীন নিবাসী মগ জাতির মধ্য থেকে ভয়ানক এক দস্যুদল এসে অরাজকতা সৃষ্টি করত। সেই সময় নিয়ে অধ্যাপক আহমদ শরীফ লিখেছেন– ‘মগ জলদস্যুরা জলপথে বাঙলাদেশের ভুলুয়া, সন্দ্বীপ, সংগ্রামগড়, বিক্রমপুর, সোনারগাঁ, বাকলা, যশোর, ভূষণা ও হুগলী লুণ্ঠন করত। তারা হিন্দু-মুসলিম, নারী-পুরুষ ও বড়-ছোট নির্বিশেষে ধরে নিয়ে যেত।
হাতের তালু ফুঁড়ে বেত চালিয়ে গরু-ছাগলের মতো বেঁধে নৌকার পাটাতনে ঠাঁই দিত। মুরগীকে যেভাবে দানা ছিটিয়ে দেওয়া হয়, তাদেরও তেমনি চাউল ছুড়ে দেওয়া হত খাবার জন্যে। এ অবহেলা ও পীড়নের পরেও যারা বেঁচে থাকত তাদেরকে ভাগ করে নিত মগে-পর্তুগীজে।’
বাংলার ভাষা ও ইতিহাসে ‘মগ’ শব্দটি অনেক প্রাচীন হলেও ‘মব’ শব্দটি খুব বেশি পুরোনো নয়। হঠাৎ অনেক মানুষ কোনো জনাকীর্ণ স্থানে স্বল্প সময়ে অপ্রচলিত কর্মকাণ্ড করে ফের জনারণ্যে মিলিয়ে গেলে তাদের ‘মব’ বলা যেতে পারে। বিনোদন দেওয়া কিংবা বিশেষ কোনো বার্তা শৈল্পিকভাবে তুলে ধরতে এ আয়োজনকে বলে ‘ফ্ল্যাশ মব’। আবার স্বতঃস্ফূর্তভাবেও এক দল মানুষ কোনো ঘটন বা অঘটন ঘটিয়ে চলে যেতে পারে। সেটাই হচ্ছে ধ্রুপদি ‘মব’। যেমন গণঅভ্যুত্থানের তোড়ে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটার পর দলে দলে মানুষ গণভবন, সংসদ ভবন, ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে গিয়ে নানা কর্মকাণ্ড ঘটিয়েছে।
গত ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীর দেশ ত্যাগের পর বাংলাদেশে যে পরিস্থিতি, সেটাকে ‘মবের মুল্লুক’ বলা যেতে পারে। কারণ, স্বৈরাচারী শাসন পতনের পর থেকে নানাবিধ সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা সামনে হাজির হচ্ছে অনেকটা ফ্ল্যাশ মবের মতো। শুরুতে বিদ্রোহ-বিক্ষোভ আর প্রতিবিপ্লবের বার্তা নিয়ে হাজির হতে দেখা যায় অনেককে। তারপর বেড়ে যায় ডাকাতের উপদ্রব, আনসারদের সচিবালয় ঘেরাও, বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মীদের গণছুটি, চিকিৎসকদের কর্মবিরতি, রাজপথে রিকশা মিছিল। বেতন-ভাতাবঞ্চনার দাবি নিয়ে পোশাক শ্রমিকদের একটি অংশসহ বিভিন্ন গোষ্ঠী রাজপথে নামতে থাকে। সবাই হয়তো ভেবেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জনদাবি জানিয়ে যদি কিছুটা সুফল পাওয়া যায়, দোষ কী!
গণঅভ্যুত্থান বা বিপ্লব-পরবর্তীকালে যে কোনো দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হওয়াই স্বাভাবিক। আমরা যদি স্টিফেন হিলের ‘ইন ডিফেন্স অব আওয়ার হিউম্যানিটি: রিয়েল লাইফ অ্যাজ আ ইউনাইটেড নেশনস অ্যাম্বাসাডর ইন আ ট্রাপবলড ওয়ার্ল্ড’ বইটা পড়তে যাই, সেখানে গণঅভ্যুত্থান তথা বিপ্লবের পর কিছু ঘটনাকে অবশ্যম্ভাবী হিসেবে তুলে ধরতে দেখি।
ফরাসি বিপ্লব, রুশ বিপ্লব ও ইরান বিপ্লবের উদাহরণ সামনে রেখে স্টিফেন হিল বিপ্লব-পরবর্তীকালের ঘটনাপ্রবাহ হিসেবে স্বাভাবিক মনে করেন, রাজনৈতিক ও সামাজিক রূপান্তর, অর্থনৈতিক পরিণতি, সহিংসতা ও অস্থিরতা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ রূপান্তর ঘটবেই। বেশির ভাগ দেশে রাজনৈতিক ও সামাজিক রূপান্তর হিসেবে নিত্যনতুন অবকাঠামো গড়ে উঠতে দেখা যায়; সামাজিক স্তরবিন্যাসে গুরুত্বপূর্ণ রদবদল ঘটে এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণ দৃশ্যমানরূপে বেড়ে যায়। অভ্যুত্থানের পর বেশির ভাগ দেশে আর্থিক বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। বিভিন্ন ধরনের কোম্পানিকে রাষ্ট্রীয়করণ করা হয়। বৈদেশিক বিনিয়োগ ও আয়-ব্যয়ের ক্ষেত্রেও দেখা যায় বিভিন্ন রূপান্তর ও পরিবর্তন। তবে বিপ্লব কিংবা অভ্যুত্থানের পর বেশির ভাগ দেশেই সহিংসতা ও অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়া এক রকম অনিবার্য পরিণতি।
জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে তাই এখনই হতাশ হওয়ার কিছু নেই। বর্ষাকালে যেমন হঠাৎ ধেয়ে আসা ঝুম বৃষ্টিতে ভেজার ভয়ে সবাই বাধ্য হয়ে অনেকক্ষণ কোনো না কোনো শেডের নিচে আটকে থাকেন। বৃষ্টি ছাড়লে একসঙ্গে রাস্তায় নামেন। এই সময় যানজটের পাশাপাশি নানা বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। তখন কেউ কি বলেন– ‘শেডের নিচে আটকে থাকাই ভালো ছিল’?
বাংলাদেশের বাস্তবতায় জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান বৃষ্টি ছাড়ার পরের মুহূর্ত। এই অভ্যুত্থান অনেক ছাত্র-জনতার তাজা রক্তে স্নানের মধ্য দিয়ে স্বৈরতান্ত্রিকতা থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করেছে। ঘনঘোর ফ্যাসিবাদী বর্ষার পর হঠাৎ আকাশ থেকে উঁকি দেওয়া সূর্যের মতো ঘটেছে ছাত্র-জনতার বিপ্লবী অভ্যুত্থান। বৃষ্টি ছেড়ে যাওয়ার পরের সামান্য বিশৃঙ্খলার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারলে যেমন জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হয়। আর সেটা মানিয়ে না নিয়ে কেউ যদি ঘরে বসে থাকে সেটা ভিন্ন কথা।
সেকালের ‘মগের মুল্লুক’ থেকে আজকের ‘মবের মুল্লুক’ রাজনৈতিক ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় নিতান্তই কিছু ঘটনাপ্রবাহ মাত্র। বাস্তবে ভোটের অধিকার হরণ, গুম, খুন, অপহরণ, অবিচারে নিশ্চুপ থাকা মানুষও এখন বাকস্বাধীনতার সুবিধা পুরোপুরি উপভোগ করছেন। কেউ কেউ বাকস্বাধীনতার সুযোগে এটাও বলতে পারছেন, ‘আগেই ভালো ছিলাম’। কেউ কেউ সামান্য সমস্যাকে তিল থেকে তাল করে তুলছেন সামাজিক মাধ্যমে।
তবে এসব বিতর্কও আমাদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সুনিশ্চিতকরণের দিক থেকে ইতিবাচক। আর পারস্পরিক বিতর্ক যদি আমরা মেনে নিতে পারি, তাহলে সহজেই সমৃদ্ধ, পরমতসহিষ্ণু, উদারনৈতিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা ও বাস্তবায়ন সহজ হয়ে যাবে।