মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: রবিবার ৮, সেপ্টেম্বর ২০২৪

ভারতে হাসিনার অবস্থান, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে টানাপোড়েনের শঙ্কা!

Share on:

আমরা অর্থাৎ সমগ্র জাতি অত্যন্ত ক্রুশিয়াল সময় পার করছি। এই সময় যেমন পলিটিশিয়ান ও বুদ্ধিজীবীদেরকে অত্যন্ত মেপে কথা বলতে হবে, তেমনি আমরা যারা কলাম লিখি তাদেরকেও খুব হিসেব করে লিখতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান ড. ইউনূস সম্পর্কে জনগণের কৌতূহল অপরিসীম। তিনি একজন অর্থনীতিবিদ। তিনি প্রথমে একজন অধ্যাপক ছিলেন। এরপর মানুষ তাকে চেনে প্রথমে গ্রামীন ব্যাংকের মাধ্যমে। তারপর গ্রামীন টেলিফোনের মাধ্যমে।


আন্তর্জাতিকভাবে তার আরেকটি চিন্তাধারা ব্যাপকভাবে গৃহীত হয় এবং বিশ্বব্যাপী তিনি সমাদৃত হন। সেটি হলো তার সামাজিক ব্যবসার কনসেপ্ট। কিন্তু ড. ইউনূসের রাজনৈতিক চিন্তাধারা কী সেটা সম্পর্কে সাধারণ মানুষ বলতে গেলে কিছুই জানেন না। আর শুধু সাধারণ মানুষ বলবো কেন, যাদেরকে বুদ্ধিজীবী বলা হয় তারাও খুব কমই জানেন। আমরা শুধু এতদিন এটুকু জানতাম যে, তিনি উদারনৈতিক গণতন্ত্রে বিশ^াস করেন। এর বাইরে আমরা কিছু জানতামও না, জানার প্রয়োজনও ছিল না। কারণ ড. ইউনূস অশীতিপর হওয়ার পরেও রাজনীতির ত্রি-সীমানায় পা মাড়াননি।

এমন একজন নির্ঝঞ্ঝাট মানুষকে রাজনীতিতে টেনে আনলো কে? এ ব্যাপারে কারো যদি কোনো কৃতিত্ব থাকে তাহলে তিনি হলেন খোদ শেখ হাসিনা। ইউনূসের সাথে তো হাসিনার কোনো বিরোধ ছিল না। মনে হচ্ছে যে নোবেল প্রাইজ পাওয়াই ড. ইউনূসের কাল হয়েছিল। তাই ড. ইউনূসের ভাষা ধার করে বলতে হয়, “উনি (শেখ হাসিনা) তো আমায় নাম ধরে সম্বোধন করেন না। বলেন, সুদখোর, রক্তচোষক, গরীব মানুষের প্রতারক ইত্যাদি।” পরের ঘটনা সকলেই জানেন। তাকে গ্রামীন ব্যাংক থেকে সরানো হয়, টাকা পাচারের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়, গরীব মানুষের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়। সবশেষে সদরঘাট সন্নিহিত নিম্ন আদালতের লোহার গারদের মধ্যে দাঁড় করানো হয়। এতকিছুর পরেও তিনি শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে একটি কথাও উচ্চারণ করেননি। তিনি তার পক্ষে যা কিছুই বলেছেন সবকিছুই বলেছেন ইতিবাচক। নেতিবাচক কোনো কথা তার মুখ দিয়ে উচ্চারিত হয়নি।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানের দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি ১ মাস হলো। তার সবচেয়ে বড় গুন হলো এই যে, তিনি অত্যন্ত কম কথা বলেন। এই এক মাসে তিনি চার বারও সাংবাদিক সম্মেলন করেননি। কিন্তু যখন তিনি সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেছেন তখন তিনি বলেছেন অত্যন্ত কম। কিন্তু যেটুকু বলেছেন সেটুকু অত্যন্ত মাপা এবং বুদ্ধিদীপ্ত। মানুষ জানতে চায়, গণতন্ত্র ছাড়া অন্যান্য ইস্যুতে তার চিন্তাধারা কী? বাংলাদেশের রাজনীতি খুব সোজা সরল রাজনীতি নয়। এখানে রয়েছে ধর্ম এবং সেক্যুলারিজমের মতো ইস্যু। এখানে রয়েছে ভারতের প্রভুত্বের ইস্যু। এখানে রয়েছে মুসলিম জাহানের ইস্যু। এখানে রয়েছে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের ইস্যু। এসব ব্যাপারে তিনি মোটেই মুখ খুলছেন না। কিন্তু গত ৫ সেপ্টেম্বর ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম পিটিআইয়ের কাছে তিনি যে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন সেই সাক্ষাৎকারটি, আমি বলবো, একটি মাস্টারপিস। আসুন দেখা যাক সেখানে তিনি কী বলেছেন।

সকলেই জানেন যে ড. ইউনূস বাংলাদেশের হাল ধরাতে সারা দুনিয়া খুশি। একমাত্র ব্যতিক্রম ভারত। বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১ মাস হলো দুনিয়ার কোথাও ঠাঁই পাচ্ছেন না। আমেরিকা, ইংল্যান্ড, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া তো নয়ই, এমনকি আরব আমিরাতও তাকে ঠাঁই দিতে রাজি নয়। বিবিসি, আলজাজিরা, এমনকি ভারতীয় প্রখ্যাত গণমাধ্যমসমূহও লিখছে এবং বলছে যে, শেখ হাসিনাকে নিয়ে মস্তবড় বিপদে পড়েছে ভারত। হাসিনা হয়েছেন ভারতের গলার কাঁটা। না পারছেন গিলতে, না পারছেন ওগলাতে। ভারতের এই ঝামেলার মধ্যেও হাসিনা এরমধ্যে ভারত থেকে বর্তমান সরকার বিরোধী কথা বলছেন। এই পটভূমিতে গত ৫ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার ভারতের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা পিটিআই তার ইন্টারভিউ নিয়েছে। সেই ইন্টারভিউয়ের বরাত দিয়ে দি হিন্দু যা লিখেছে তা নিম্নরূপ।

॥ দুই ॥

পিটিআইয়ের বরাত দিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ‘দ্য হিন্দু’ জানিয়েছে, ‘ড. ইউনূস বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার নৃশংসতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং ন্যায়বিচারের প্রয়োজনেই শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে।’ এসময় তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘তাকে ফিরিয়ে আনতেই হবে। তা না হলে বাংলাদেশের মানুষ শান্তিতে থাকবে না। তিনি যে ধরনের নৃশংসতা করেছেন, তাকে এখানে (দেশে) এনে সবার সামনে বিচার করতে হবে।’

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনার সময় ড. ইউনূস ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্কের আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করেন। তবে তিনি জোর দিয়ে বলেন, দিল্লীকে এই বয়ানটি ত্যাগ করতে হবে যে, শুধু শেখ হাসিনার নেতৃত্বই দেশের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে। ড. ইউনূস বলেন, বাংলাদেশ যখন ভারতের সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ককে মূল্য দেয়; দিল্লীকে তখন অবশ্যই ‘আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য সব রাজনৈতিক দল ইসলামপন্থি এবং শেখ হাসিনা ছাড়া দেশ আফগানিস্তানে পরিণত হবে’ এমন ধারণার বাইরে যেতে হবে।

ভারতে বসে দেশের বিষয়ে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক মন্তব্য করাকে একটি ‘অবন্ধুসুলভ আচরণ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন ড. ইউনূস। তিনি জোর দিয়ে বলেন, বাংলাদেশ থেকে তার প্রত্যর্পণের অনুরোধ না করা পর্যন্ত উভয় দেশকে অস্বস্তিতে না ফেলতে তাকে অবশ্যই রাজনৈতিক ইস্যুতে চুপ থাকতে হবে। ড. ইউনূসের বক্তব্য, ‘ভারতে তার অবস্থানের বিষয়টিতে কেউ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। তিনি ভারতে আছেন এবং মাঝে মাঝেই দেশের বিষয়ে কথা বলছেন যা সমস্যা সৃষ্টিকারী। যদি তিনি চুপ থাকতেন আমরা হয়তো ভুলে যেতাম। মানুষ এটিও ভুলে গেছে যে, তিনি তার নিজের জগতে থাকতেন। তবে ভারত বসে তিনি যে সব কথা বলছেন, তা কেউই পছন্দ করছে না।’

বাংলাদেশ ভারতকে তার অবস্থান জানিয়ে দিয়েছে কিনা জানতে চাইলে ড. ইউনূস বলেন, মৌখিকভাবে এবং বেশ দৃঢ়ভাবে জানানো হয়েছে যে, শেখ হাসিনার চুপ থাকা উচিত। তিনি বলেছেন, ‘এটি আমাদের প্রতি একটি অবন্ধুত্বসুলভ আচরণ। তাকে সেখানে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে এবং সেখান থেকেই তিনি প্রচারণা চালাচ্ছেন। উনি যে স্বাভাবিক নিয়মেই সেখানে গেছেন তা কিন্তু নয়। জনগণের অভ্যুত্থান এবং জনরোষের কারণে তিনি দেশ ছেড়েছেন।’

॥ তিন ॥

আমি কিছুক্ষণ আগেই বলেছি যে, ড. ইউনূস কথা বলেন কম, কিন্তু যেটুকু বলেন সেটি সংক্ষিপ্ত ও বুদ্ধিদীপ্ত। আমরা দ্য হিন্দুর রিপোর্টের একটি বড় অংশ উদ্ধৃত করলাম। এখান থেকে ভারত সম্পর্কে ড. ইউনূসের চিন্তাধারা বুদ্ধিমান মানুষদের কাছে স্পষ্ট প্রতিভাত হয়। এখানে দেশের নিরপেক্ষ ও ঠান্ডা মাথার মানুষদের চিন্তাধারার সাথে তার চিন্তাধারা মিলে যায়। এটি বহুবার বলা হয়েছে যে, ভারত আমাদের বিশাল প্রতিবেশী এবং তার সাথে আমাদের তিন দিক দিয়ে রয়েছে অভিন্ন সীমান্ত। ভারতের সাথে আমরা বন্ধুসুলভ সম্পর্ক চাই। চাই সৎ প্রতিবেশীসুলভ বন্ধুত্ব। ভারতকে আমাদের যেমন প্রয়োজন তেমনি ভারতেরও আমাদেরকে প্রয়োজন। ব্যবসা বাণিজ্য, লেখা পড়া, চিকিৎসাসহ দুই অভিন্ন প্রতিবেশীর মধ্যে যেসব সম্পর্ক থাকা উচিত সেগুলো অবশ্যই থাকবে। কিন্তু তাই বলে ভারত বাংলাদেশের সাথে প্রভুসুলভ আচরণ করবে এটি একমাত্র আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কোনো বাংলাদেশী মেনে নিতে পারেন না। ভারত সম্পর্কে ড. ইউনূসের এ্যাটিচ্যুড কী, সেটি আর আঁটি ভেঙ্গে শাঁস দেওয়ার প্রয়োজন নেই।

॥ চার ॥

শেখ হাসিনার বিচারের প্রশ্ন যখন উঠলো তখন বিচার নিয়ে আরো কিছু কথা বলা দরকার। একটি প্রশ্ন প্রায়শই উত্থিত হয় যে, এই সরকার কতদিন থাকবে? আমরা সেই প্রশ্ন তুলছি না। তবে আমরা মনে করি যে, সংস্কার বলুন আর যাই বলুন, সর্বাগ্রে এই সরকারকে তিনটি ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে হবে। এগুলো পাবে এই সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।

প্রথমত ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় বিডিআর ম্যাসাকার। সকলেই জানেন, ম্যাসাকারে মাত্র দুই দিনে সেনাবাহিনীর ১ জন মেজর জেনারেলসহ মোট ৫৭ জন চৌকশ অফিসারকে হত্যা করা হয়েছে। ঐ মেজর জেনারেলের পুত্রসহ নিহত আরো কয়েকজন অফিসারের ছেলে মেয়ে হাসিনার পতনের পর এক সংবাদ সম্মেলন করেছেন। ঐ সংবাদ সম্মেলনে তারা এবং মেজর হাফিজ সহ আরো অনেক রাজনৈতিক নেতা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন যে, এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত রয়েছেন শেখ হাসিনা, তার ফুপাতো ভাই শেখ সেলিম, তার ফুপাতো ভাতিজা ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, আওয়ামী লীগ নেতা সদ্য সাবেক মন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক প্রমুখ। এই মর্মে আরো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে যে, এই রক্ত হিম করা হত্যাকাণ্ডের পেছনে রয়েছে ভারতের ইশারা।

দ্বিতীয়ত ২০১৩ সালের ৫ ও ৬ মে শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের হাজার হাজার সদস্যের সমাবেশে পাকিস্তান আর্মির স্টাইলে রাতের অন্ধকারে শেখ হাসিনার পুলিশ বাহিনীর ভয়াল ক্র্যাকডাউন। ‘অধিকার’ নামক মানবাধিকার সংস্থা এই ক্র্যাকডাউনে ৬১ জন মুসল্লির নামধাম ও ঠিকানা প্রকাশ করেছে। এরা শাপলা চত্বর ক্র্যাকডাউনে নিহত হয়েছেন। অধিকারের মতে এই সংখ্যা আরো বেশি হবে। এই শাপলা চত্বরের বর্বর হত্যাকণ্ডের তদন্ত এবং বিচার এই সরকারকেই করতে হবে। কারণ এই সরকার অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য।

তৃতীয়ত গত আগস্ট বিপ্লবে (১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট) প্রতিটি নিহত এবং প্রতিটি আহতের পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করতে এবং বিচার করতে হবে। এখন যেসব খবর পাওয়া যাচ্ছে তাতে এসব তথ্য বেরিয়ে আসছে যে পুলিশ, র‌্যাব এবং আর্মিকে গুলী চালিয়ে ছাত্র জনতার বিপ্লবকে দমন করার জন্য সরাসরি নির্দেশ দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। তার নির্দেশ বিশ^স্ততার সাথে কার্যকর করেছেন সদ্য সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং পুলিশ নামের কলঙ্ক পুলিশ লীগের কতিপয় সিনিয়র অফিসার। স্বাস্থ্য উপদেষ্টার বক্তব্য অনুযায়ী ইতোমধ্যেই ১ হাজারেরও বেশি ব্যক্তির মৃত্যু রেকর্ড করা হয়েছে। তার মতে এই সংখ্যা আরো বাড়তে পারে।

এই তিনটি গণহত্যার সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং নির্মোহ তদন্ত ও বিচার করলে কেঁচো খুড়তে সাপ বেরিয়ে আসবে। এই গণহত্যার সাথে আরো তদন্ত ও বিচার করতে হবে আয়নাঘর কাহিনীর। আয়নাঘরের ইতিবৃত্ত বের করতে গেলে খুলে যাবে প্যান্ডোরার বাক্স। যারা বিপ্লবের অগ্রনায়ক সেই তরুণ নেতারা তাদের তরুণ সম্প্রদায়কে বলেন জেন-জেড। এই জেন-জেডরা আওয়ামী এবং ভারতীয় চক্রান্ত সম্পর্কে অনেক কিছুই জানে না। আলোচ্য তিনটি গণহত্যার বিচার তাদেরকে আওয়ামী ভারতীয় কুচক্রীদের সাথে ভাল করে পরিচয় করিয়ে দেবে।

দৈনিক সংগ্রাম