ভারতে বুলডোজার নীতি, আড়ালে মুসলিম নিধন
Share on:
রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রতিহিংসা ভারতে পুরো উদ্যমে ফিরে এসেছে। মধ্যপ্রদেশে এ মাসের প্রথম দিকে বিরোধী কংগ্রেস দলের সদস্য একজন মুসলিম স্থানীয় নেতা দেখলেন যে তাঁর বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কী অভিযোগে?
বাড়িটা নাকি অবৈধভাবে তৈরি করা হয়েছে। এর পরই জেলাপর্যায়ের একজন কর্মকর্তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সন্তোষ প্রকাশ করলেন যে পুলিশের ওপর কিছুদিন আগে করা এক আক্রমণের ন্যায্য পাওনা মেটানো হয়েছে। এর মধ্যেই পাশের রাজ্য উত্তর প্রদেশে বুলডোজার দিয়ে একটি শপিং কমপ্লেক্স মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হলো। এর মালিক বিরোধদলীয় একজন মুসলিম কর্মী। কিছুদিন আগে তাঁকে ধর্ষণের দায়ে আটক করা হয়েছিল।
এই ‘বুলডোজার নীতি’ নতুন কিছু নয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভারতে শুধু সন্দেহভাজন হওয়ার অপরাধে মানুষের বাড়িঘর প্রায়ই খুব আয়োজন করে ভেঙে ফেলা হয়। আর এই ভুক্তভোগীদের অধিকাংশই মুসলিম।
সব ক্ষেত্রে অজুহাত মোটামুটি একই। এগুলো অননুমোদিত নির্মাণ। ক্ষমতাসীন বিজেপি নিয়ন্ত্রিত রাজ্য সরকারগুলো মুসলমানদের প্রতি নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন আর পার্টির হিন্দু আধিপত্যবাদী ভোটারদের ঘাঁটিকে খেপিয়ে তোলার জন্য একটি আদর্শ হাতিয়ার খুঁজে পেয়েছে।
প্রতিহিংসা ছাড়াও বুলডোজারকে ইতিমধ্যে প্রান্তিক করে দেওয়া এক সম্প্রদায়কে নিয়ন্ত্রণ আর তাদের মন ভেঙে দেওয়ার কাজে লাগানো যায়। ‘নাগরিক উন্নয়নের’ জন্য যেসব জায়গা চিহ্নিত করা হয়েছে সেগুলো যে মুসলিম অধ্যুষিত, এটা বোধ হয় নিতান্ত কাকতালীয় নয়। এর ফলে গত দুই বছরে ১ লাখ ৫০ হাজার বাড়ি ধুলোয় মিশেছে, প্রায় ৭ লাখ ৫০ হাজার মানুষ হয়েছে গৃহহীন।
ভারত নিজেকে ‘বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্র’ বলে দাবি করে। অথচ সেখানে এ ধরনের নির্লজ্জ অন্যায়কে এমন স্বাভাবিক করা হয়েছে যে বিজেপির নির্বাচনী সমাবেশে এখন বুলডোজার দেখা যায়। ২০১৯ সালে মোদি আবার নির্বাচিত হয়ে আসার পর থেকে, ‘বুলডোজারের রাজনীতি’ হিন্দু আধিপত্যবাদ আর পেশিশক্তি দিয়ে শাসনের প্রিয় পদ্ধতি হয়ে উঠেছে।
কিন্তু এপ্রিল-জুনে ভারতের সাধারণ নির্বাচনে কি এ ধরনের নির্লজ্জ পাপাচারের অবসান ঘটেনি? প্রথমবারের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোর পর, একজন ‘নম্র’ মোদি আবির্ভূত হননি? হলোই বা সরকার গঠনের জন্য নতুন মিত্রদের জায়গা দেওয়ার প্রয়োজন। ভোটাররা কি ভারতকে কর্তৃত্ববাদী শাসনের ‘প্রান্ত থেকে’ টেনে এনে ‘ভারতের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ পুনরুদ্ধার করেনি?’
নির্বাচন-পরবর্তী এসব গরম-গরম মিষ্টিকথা এখন বুলডোজার দিয়ে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে। মোদি হিন্দু চরমপন্থী শক্তির ওপর লাগাম দেননি। অধিকার দমন, ভিন্নমত প্রত্যাহার এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো দখল করার জন্য বিজেপির চেষ্টাকে তিনি ছাড় দিয়েই যাচ্ছেন।
সংখ্যালঘুদের গণপিটুনি এবং অন্যান্য ধরনের জনসহিংসতা আরও তীব্র হয়েছে। মুসলিম দোকানমালিকদের পুলিশ বলে দিচ্ছে তাঁরা যেন দোকানের ওপর নিজেদের নাম লিখে রাখেন, যাতে হিন্দু ক্রেতারা দূরে থাকতে পারেন।
শুধু এসব নয়, ভারতের মুসলমানদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর দমনমূলক নতুন আইন তৈরি করা হচ্ছে। হিন্দু মেয়ের সঙ্গে প্রেম করলে মুসলিম পুরুষদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের কথা বলা হচ্ছে। এ হচ্ছে হিন্দু আধিপত্যবাদী কথিত ‘লাভ জিহাদ’ নিয়ন্ত্রণের সম্ভাব্য উপায়।
সরকারের সমালোচনাকারী বুদ্ধিজীবীদের ওপর আক্রমণ হচ্ছে তীব্রতর। বামপন্থী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নামে কঠোর আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে। চলে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে বিরক্তিকর বিদেশি সাংবাদিকদের। আবার আমলাদের এখন বিজেপির মূল সংগঠন, ডানপন্থী হিন্দু আধিপত্যবাদী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘে যোগদানের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, যা ভারতের প্রতিষ্ঠাতা নীতি ‘সমান নাগরিকত্বের’ পরিপন্থী।
নির্বাচনে শায়েস্তা হওয়া তো দূরের কথা, বিজেপি নেতাদের বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য আজকাল আরও ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পরপরই একজন ক্যাবিনেট মন্ত্রী ঘোষণা করেছেন যে দেশে মুসলমানদের বসবাসের অনুমতি দেওয়াই ভারতের সবচেয়ে বড় ভুল। সেই নেতা এখন মুসলিম ব্যবসা বর্জন করার জন্য মাঠপর্যায়ে প্রচারণায় সমর্থন দিচ্ছেন।
একইভাবে পূর্বাঞ্চলীয় এক রাজ্যের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী সম্প্রতি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম মালিককে বন্যার জন্য দায়ী করে ‘ফ্লাড জিহাদ’ চালানোর দায়ে অভিযুক্ত করেছেন। ‘ল্যান্ড জিহাদ’ বন্ধ করতে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে জমি বিক্রি সীমিত করার জন্য আইনের ওকালতি করছেন তিনি।
ভারতে কিছুই বদলায়নি । বদল বলে যা মনে হচ্ছে, তা আসলে গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবনের এক বিভ্রমমাত্র। হ্যাঁ, বিরোধী দলের নিজেদের ওপর আস্থা ফিরেছে, সরকার বিভিন্ন আইন আর উদ্যোগ পুনর্মূল্যায়ন করতে রাজি হয়েছে। বিতর্কিত এক সম্প্রচার বিল সম্প্রতি আটকে দেওয়া হয়েছ। শাসকের সমালোচকেরা এসবে উদ্দীপ্ত হয়ে ঘোষণা করছেন যে মোদিকে দুর্বল করা গেছে। তবে এসব আসলে নিতান্ত কৌশলগত পিছু হটে যাওয়া।
সর্বোপরি যেসব হাতিয়ার কাজে লাগিয়ে স্বৈরাচারী নির্বাচনে জিতে গেছে, মোদি সেসব হাতিয়ার এখনো ভালোমতোই ধরে রেখেছেন। বলে রাখা দরকার, এই নির্বাচন সুষ্ঠু কোনোমতেই ছিল না।
ব্যাপকভাবে কারচুপি না হলেও বিজেপির পক্ষে সম্ভাব্য সব প্রতিষ্ঠানকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করা হয়েছে। ভারতের প্রতিষ্ঠানগুলো বন্দী হয়ে আছ। এর প্রচারমাধ্যম একটি নির্দিষ্ট অংশের সেবা করতে ব্যস্ত থাকে। তদন্তকারী সংস্থাগুলোর সুতোর নাটাই বিজেপি নিজের হাতে রেখে দিয়েছে শত্রুদের ভয় দেখাতে, বন্ধুদের পক্ষে রাখতে আর দাতাদের ঝাঁকুনি দিয়ে প্রচারণার টাকা জোগাড় করতে। নীতিনির্ধারণের ওপর একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করে মোদি ব্যবসাগুলোকে নিজের পাশে রাখতে পারছেন।
সম্প্রচার বিল পাস করা বিলম্বিত করা গেছে। তবে সরকারের কাছে রয়ে গেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচক কণ্ঠগুলোকে চুপ রাখার যথেষ্ট উপায়। সেগুলো সরকার নিয়মিত ব্যবহার করছে। বিজেপিশাসিত ভারতের বৃহত্তম রাজ্য সম্প্রতি ঘোষণা করেছে যে সমালোচনামূলক সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টগুলোর জন্য তারা কারাদণ্ডের বিধান আনবে।
তবু ভারতে গণতান্ত্রিক পুনরুজ্জীবনের উপলব্ধি মোদির তৃতীয় মেয়াদকে নতুন করে বৈধতা দেয়। গণতান্ত্রিকভাবে ভারতের পিছিয়ে পড়ার বাস্তবতা বহু বছর ধরে বিশ্বব্যাপী মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। এখন বাইরের অনেক পর্যবেক্ষক বিশ্বাস করছেন যে ভারতের গণতন্ত্র প্রাণ ফিরে পেয়েছে, আর হিন্দুত্ববাদের রাজনৈতিক উপযোগিতা ফুরিয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে মোদি এবারের নির্বাচনী প্রচারণার সময় সবাইকে নিয়ে চলার ভান পরিত্যাগ করেছেন। তিনি এবং বিজেপির বাকিরা বারবার আশ্রয় নিয়েছেন ইসলামভীতির বার্তার। ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতিকে শক্তিশালী করছেন বহুগুণ।
কয়েক মাসের মধ্যে ঝাড়খণ্ডে রাজ্য নির্বাচন হবে। বিজেপি সেখানে প্রকাশ্যে রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে উসকানি দিচ্ছে এই দাবি করে যে রোহিঙ্গা মুসলমানরা তাদের নারীদের বিয়ে করে জমি দখল করছেন। মুসলিম দাতব্য প্রতিষ্ঠান পরিচালনাকারী আইন পরিবর্তন করে মোদির দল ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে আরেক খেলা খেলার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
ভারত যে নিরাময়ের পথে নেই, সেটা স্পষ্ট। এর গণতান্ত্রিক পিছু হটে যাওয়া থামা তো দূরের কথা, এর গতি বরং বাড়ছে। কারণ, বিজেপি যত বেশি অনিরাপদ বোধ করবে তত বেশি শক্তভাবে সে বিরোধীদের মোকাবিলা করবে।
মোদি তাঁর থলে থেকে যা বের করেছেন, তা ফিরিয়ে নিতে হালকা নির্বাচনী ধাক্কা যথেষ্ট নয়। তিনি যে উগ্র সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী মতাদর্শের প্রতিনিধিত্ব করেন, তা ক্ষমতা নিয়েই তুষ্ট থাকে না। তারা ক্ষমতাকে দেখে দেশের সাংবিধানিক বাধ্যতামূলক বহুত্ববাদকে ধ্বংস করার উপায় হিসেবে। হিন্দুত্ববাদী বুলডোজার থেমে নেই। এবারের নির্বাচন সেই বুলডোজারের চলার পথে একটা পথে একটি ধাক্কা ছিল মাত্র।