ভারতে ইলিশ রপ্তানি‘র ইতিহাস
Share on:
অতিসতর্ক ও অভিজ্ঞ মানুষকে যতই এই নামে আখ্যা দেওয়া হোক, ইলিশই প্রকৃতার্থে ‘গভীর জলের মাছ’। ডিম ছাড়ার জন্য নোনা সাগর থেকে যখন স্বাদু নদীতে অগ্রসর হতে থাকে, তখন অন্য অনেক মাছের মতো কিনারা বা কোল নয়; ইলিশ চলাফেরা করে মধ্যস্রোত দিয়ে।
সমুদ্রগামিনী বৃহৎ, প্রশস্ত, গভীর ও স্রোতস্বিনী নদীই তাই ‘জলের রুপালি শস্য’ আহরণের আদর্শ ক্ষেত্র। সেই ইলিশ বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানি নিয়ে, পশ্চিমবঙ্গের কথ্যভাষায় যেভাবে বলা হয়, বিতর্ক ‘জমে ক্ষীর’।
বিতর্কের সূত্রপাত অন্তর্বর্তী সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতারের বক্তব্য থেকে। শপথ গ্রহণের সপ্তাহেই তিনি বলেছিলেন, এবার বাংলাদেশ থেকে ভারতে ইলিশ রপ্তানি হচ্ছে না। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহেও তিনি বলেন–‘দেশের মানুষের চাহিদা মিটিয়ে তারপর ইলিশ মাছ বিদেশে রপ্তানি করা হবে। দেশের মানুষ ইলিশ পাবে না, আর রপ্তানি হবে সেটা হতে পারে না’ (সমকাল, ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪)। ইলিশ বিষয়ে তাঁর মন্তব্যের সূত্র ধরেই পক্ষে-বিপক্ষে সংবাদমাধ্যমে ও সামাজিকমাধ্যমে তুমুল তর্ক শুরু হয়। এমনকি ইলিশ রপ্তানির সিদ্ধান্ত স্থগিত চেয়ে হাইকোর্টে রিটও করেন একজন আইনজীবী।
শেষ পর্যন্ত অবশ্য সরকার রপ্তানির পক্ষেই সিদ্ধান্ত নেয়। শর্তসাপেক্ষে ২ হাজার ৪২০ টন ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দেয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমদের বক্তব্য, দেশে ২০২২-২৩ অর্থবছরেও উৎপাদিত ৫ লাখ ৭১ হাজার টন ইলিশ থেকে রপ্তানির অনুমতিপ্রাপ্ত পরিমাণ মোট উৎপাদনের শূন্য দশমিক ৫ শতাংশেরও কম। তার মানে, আহরিত ৯৯.৫ শতাংশ ইলিশ দেশেই থেকে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন– ‘এ বিষয়ে যারা ইমোশনালি কথাবার্তা বলে বলুক। তবে এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আমি বিভিন্ন মহল থেকে বাহবা পাচ্ছি’ (সমকাল, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪)।
সরকারের দুই উপদেষ্টার অবস্থানের সপক্ষেই জোরালো যুক্তি রয়েছে। ফরিদা আখতারের এই উৎকণ্ঠা যথার্থ যে, যত কম পরিমাণেই ইলিশ রপ্তানি হোক না কেন, সেই অজুহাতে স্থানীয় বাজারে ইলিশের দাম বেড়ে যায়। বাস্তবে এবারও সেটাই ঘটেছে। রপ্তানির সিদ্ধান্ত আসার পরপরই বাজারে মাছটির সরবরাহ কমে যায় এবং দাম বাড়তে থাকে। ২৬ সেপ্টেম্বর প্রথম চালানের ৫৪ টন যখন বেনাপোল বন্দর দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে ঢোকে, সেদিনই যশোর পাইকারি বাজারে রপ্তানি মূল্যের চেয়ে কেজিপ্রতি কমবেশি ৫০০ এবং খুচরা বাজারে কেজিপ্রতি কমবেশি ৯০০ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছিল মাছটি (দেশের বাজারে ইলিশের কেজি ১,৬৫০ টাকা, ভারতে রপ্তানি হয় ১,১৮০ টাকায়, প্রথম আলো, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪)।
এটাও সত্য, যদি বৈধপথে রপ্তানি বন্ধ থাকে, তবে অবৈধ পথে ইলিশ চোরাচালান বেড়ে যেতে বাধ্য। এবার রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্তের পরপরই দেশের বিভিন্ন এলাকা দিয়ে ইলিশ চোরাচালানের খবর আসছিল (ভারতে পাচার হচ্ছে ইলিশ ঢুকছে মাদক, সমকাল, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪)। চোরাচালানে রাজস্ব হারানো ছাড়াও বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রশ্নটিও গুরুত্বপূর্ণ। রিজার্ভ ও রেমিট্যান্স টানাটানির সময়ে বছরে গড়ে এক কোটি ডলারের আয় কে ছাড়তে চায়? পাশাপাশি ভারত থেকে শুঁটকি ও তাজা মাছ আমদানিতে ব্যয় হওয়া বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের প্রশ্নও রয়েছে। যদি ইলিশ না যায়, তাহলে আমদানিকৃত কাতলা থেকে কাঁচকির দাম গাঁটের বৈদেশিক মুদ্রা দিয়েই মেটাতে হবে।
মুশকিল হলো, সরকারের দুই উপদেষ্টাই দাঁড়িয়ে রয়েছেন নদীর দুই তীরে। কিন্তু ইলিশের মতোই মাছটির প্রকৃত ইস্যুগুলো উজান-ভাটি করছে নদীর মধ্যস্রোত বেয়ে। এক তীরের ভোক্তা অধিকার কিংবা অপর তীরের বাণিজ্য সম্ভাবনার চশমা দিয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জাতীয় মাছটি নিয়ে প্রকৃত কর্তব্য নির্ধারণ করা কঠিন। ইলিশের প্রজনন থেকে উৎপাদন ও পরিবেশনের প্রকৃত ইস্যুগুলো বুঝতে হলে তীরে দাঁড়িয়ে বিতর্ক নয়; যেতে হবে নদীর মধ্যস্রোতেই। সেখানেই নিহিত ইলিশ রপ্তানি বিতর্কের বাকি ইতিহাসের তিনটি অধ্যায়।
প্রথমত, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতারের মন্ত্রণালয়ই প্রতিবছর পৃথক সময়ে নদীতে জাটকা বা ডিম্ববতী ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করে থাকে। বাস্তবতা হচ্ছে, এই নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ করতে গিয়ে, পোনা বা মা ইলিশ বাঁচাতে গিয়ে জেলে সম্প্রদায়ের অনাহারি-অর্ধাহারি পিতা-পুত্রদের ওপর জুলুমের সীমা থাকে না।
২০০৪ সালে জাটকা রক্ষা কর্মসূচির ‘পাইলটিং’ হয়েছিল মেঘনা নদীর যে ষাটনল-চরভৈরবী এলাকায়, নদী বিষয়ে আমার প্রথম গবেষণাক্ষেত্র ছিল সেটাই। গবেষণার বিষয়, সরকারের জাটকা রক্ষা কর্মসূচি কীভাবে জেলেদের জীবন ও জীবিকার ওপর প্রভাব ফেলছে। ওই অভিজ্ঞতা নিয়েই প্রকাশিত হয়েছিল আমার প্রথম গ্রন্থ।
তখন ও পরবর্তী সময়ে দেখেছি, নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে সারাবছরই জেলেদের পুলিশ ও প্রভাবশালীদের চাঁদা দিতে হয়। নিষেধাজ্ঞা ও অভিযান চলাকালে রেট বাড়ে কেবল। যেসব গরিব জেলে চাঁদার চাঁই ভরাতে পারে না, তাদের ওপর চলে জুলুম। জাল ও জলযান পুড়িয়ে দেওয়া কেবল নয়; জেল ও জরিমানা কেবল নয়; ইলিশের বংশ রক্ষায় যুযুধান প্রশাসক ও পুলিশের গুলিতে প্রাণও হারাতে হয় মানবসন্তানকে। আর নিষেধাজ্ঞা চলাকালে বরাদ্দ সরকারি চালের বড় অংশ যথারীতি বারো ভূতে খেয়ে ফেলে।
বিএনপি, ওয়ান-ইলেভেন, আওয়ামী লীগ সরকার গত হয়ে অন্তর্বর্তী সরকার বর্তমান। কিন্তু পরিস্থিতি এখনও তথৈবচ। সহযোদ্ধা মোহাম্মদ আরজু এই সেদিন লিখেছেন- ‘অক্টোবর মাসে (আশ্বিনের পূর্ণিমাকে কেন্দ্র করে) ডিম পাড়া ইলিশ ধরা বন্ধের মৌসুম শুরু হবে। মৎস্য মন্ত্রণালয় অভিযান চালাবে। এই অভিযান কি বিগত বছরগুলোর চেয়ে ভিন্ন রকম হবে? জেলেদের ওপর চাঁদাবাজি-বন্দুকবাজি-মামলাবাজির বাইরে কাজের কাজ কিছু হবে?’ (ইলিশ ব্যবস্থাপনা ও জেলেদের প্রতি বেইনসাফি, সমকাল, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪)।
বাকি ইতিহাসের দ্বিতীয় অধ্যায়ের প্রশ্নটি বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমদের কাছে; সাগর ও নদীর প্রাকৃতিক ক্ষেত্র থেকে প্রকৃতিপ্রদত্ত ইলিশ মাছের দাম এত বেশি কেন? ঢাকা কিংবা কলকাতায় যে দামে ভোক্তারা মাছটি কেনেন, তার কত অংশ ইলিশ আহরণকারী জেলেদের কাছে যায়? যে দামে দাদনদাতা আড়তদারের কাছে ইলিশ বিক্রি করে, রাজধানীর খুচরা বাজারে সেটা অন্তত দ্বিগুণ দর ওঠে কেন? উৎসে জেলের পারিশ্রমিক ও প্রান্তে ভোক্তার পকেট কাটা মধ্যস্বত্বভোগীদের নিয়ন্ত্রণে কী করবেন বাণিজ্য উপদেষ্টা?
তৃতীয় অধ্যায়ের দায় পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের। খবরে প্রকাশ, ইলিশ রপ্তানি অনুমোদনের জন্য ভারতীয় মাছ আমদানিকারক সংগঠন এফআইএ থেকে গত ৯ সেপ্টেম্বর তাঁর কাছেই প্রথম অনুরোধ এসেছিল। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বিবেচনায় তিনি স্বাভাবিকভাবেই ইতিবাচক উদ্যোগ নিয়েছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, ইলিশ উৎপাদনের জন্য বাংলাদেশের নদ-নদীগুলোতে যে পর্যাপ্ত প্রবাহ প্রয়োজন, সেই তাগিদ কি তিনি তখন দিয়েছিলেন?
শেষ কথা, ইলিশ প্রজনন ও উৎপাদনের জন্য দেশের নদ-নদীগুলোতে কেবল পর্যাপ্ত প্রবাহ থাকলেই চলবে না; দখল ও দূষণও দূর করতে হবে। ইলিশ কেবল কূটনৈতিক দিক থেকে ‘স্পর্শকাতর’ নয়; প্রতিবেশগত দিক থেকেও যথেষ্ট ‘সংবেদনশীল’। পরিবেশ বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে চিন্তা ও তৎপরতায় জড়িত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার যদি সেটি না বোঝে, তাহলে আর কোন সরকার বুঝবে? আভি নেহি তো কাভি নেহি!