মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: সোমবার ১৯, অগাস্ট ২০২৪

‘ভারতীয় হস্তক্ষেপ চাওয়া রাষ্ট্রদ্রোহি অপরাধ’

Share on:

সজীব ওয়াজেদ জয়কে আমি কোনোদিন গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করিনি। অনেকেই তাকে গুরুত্ব দেন, কারণ তিনি বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া প্রধানমন্ত্রীর পুত্র।


কিন্তু বিগত সাড়ে ১৫ বছর তিনি বাংলাদেশের রাজনীতি বিষয়ক এমন কোনো কথা বলেননি বা এমন কোনো কাজ করেননি যেজন্য তাকে গুরুত্বের সাথে নিতে হবে। শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর হঠাৎ করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিশেষ করে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জয় উদিত হয়েছেন। উদিত হওয়ার পরেই প্রায় প্রতিদিন আমেরিকার মতো স্বপ্নের দেশে বসে একেক দিন একেক রকম বিবৃতি দিচ্ছেন। একটি বিবৃতিতে তিনি বলেছেন যে তার মা পদত্যাগ করেননি। এটা তিনি বলেছিলেন ৭ আগস্টের পরে। কিন্তু তার মা শেখ হাসিনা ৭ আগস্ট এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন যে কেন তিনি পদত্যাগ করেছেন। হাসিনার সবগুলি বিবৃতি ভারত থেকে আসছে। তার মা পদত্যাগ করেছেন এই মর্মে শেখ হাসিনা নিজে বিবৃতি দিলে তার একদিন বা দুইদিন পর তার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় বলেছেন যে তার মা পদত্যাগ করেছেন বলে যে বিবৃতি দিয়েছেন সেখানে তার মার বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে। তাহলে সেই বিবৃতি কারা বিকৃত করলো? সারা দুনিয়ার মধ্যে একমাত্র ভারতই তাকে আশ্রয় দিয়েছে। সেই ভারতের সরকার বা গণমাধ্যম কি তার বিবৃতি বিকৃত করতে পারে? এসব কারণেই বলছি যে তাকে গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করার কোনো কারণ নাই।

গত ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবের মৃত্যু দিবসকে উপলক্ষ করে ভারত থেকে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগারদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন যে ঐদিন অর্থাৎ ১৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ যেন ঢাকায় ১০ লক্ষ লোকের সমাবেশ ঘটায় এবং শোক দিবস পালন করে। সজীব ওয়াজেদ জয়ও ঢাকায় সমাবেশ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তো ঢাকায় কেমন সমাবেশ হলো? দৈনিক সংগ্রামের এই কলামিস্ট গত ১৫ আগস্ট ধানমন্ডি ৩২ নাম্বার থেকে শুরু করে পুরো পান্থপথ এলাকা ঘুরেছেন। দেখা গেল, ১০ লক্ষ তো দূরের কথা, ১০ হাজার লোকও হয়নি। ১০ হাজারও দূরের কথা, ১০ শত লোক, অর্থাৎ ১ হাজার লোকও হয়নি। আসলে অতি প্রত্যুষে রোকেয়া প্রাচী এবং কয়েকজন পেইন্টার ও রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী এসেছিলেন। কিন্তু বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন নেতা সেখানে গেলে ওরা ভয়ে পালিয়ে যান। একমাত্র গোপালগঞ্জে কিছু লোক জমায়েত হয়েছিল। এই যাদের অবস্থা, সেখানে তাদের নতুন নেতা সজীব ওয়াজেদ জয় বলেন যে আগামী ৯০ দিনের মধ্যে যদি নির্বাচন দেওয়া হয় তাহলে নাকি আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়ী হবেন। তার বিবৃতি শেষ করে তিনি বলেছেন যে আওয়ামী লীগ এখনো বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দল।

শুরুতেই আমি বলেছি যে জয়কে আমি গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করি না। তারপরেও তাকে নিয়ে কথা বলছি কেন? বলছি এজন্য যে প্রতিদিন একটি করে বিবৃতি ইস্যু করার মধ্য দিয়ে তিনি একদিন এমন একটি বিবৃতি দিয়েছেন যেটি চরম রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। আর তখনই তাকে আমার গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করতেই হলো। ইংরেজিতে দুটি শব্দ আছে। শব্দ দুটি হলো High treason অর্থাৎ চরম রাষ্ট্রদ্রোহিতা। গত ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় যে খবর বেরিয়েছে তার শিরোনাম, (নিউ এজ) Sajeeb hopes India to ensure polls in 90 days. বঙ্গানুবাদ: সজীব আশা করেন যে ভারত বাংলাদেশে ৯০ দিনের মধ্যে যাতে নির্বাচন হয় সেটি নিশ্চিত করবে। খবরে বলা হয়, “আমি আশা করবো যে ভারত বাংলাদেশে ৯০ দিনের মধ্যে যাতে নির্বাচন হয় সেটি নিশ্চিত করবে।” তিনি আরো আশা করেন যে, “বাংলাদেশে বর্তমানে যে Mob Rule অর্থাৎ উন্মত্ত জনতার শাসন চলছে সেটি ভারত বন্ধ করবে। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী এই সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে।” তিনি আশা করেন যে “আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠিত করা এবং নির্বাচনী প্রচারণা করার সুযোগ দেবে এই সরকার।”

॥ দুই ॥

আমার মনে হয় যে সজীব ওয়াজেদ জয়ের ওপরে উল্লেখিত বক্তব্য যে চরম রাষ্ট্রদ্রোহ সেটি আর বিস্তারিত বলার অবকাশ রাখে না। বাংলাদেশে ৯০ দিনের মধ্যে ইলেকশন হবে কিনা সেটি ভারত ঠিক করার কে? বাংলাদেশে Mob Rule বা উন্মত্ত জনতার শাসন চলছে কিনা ভারত সেটি দেখার কে? আওয়ামী লীগকে নির্বাচনী প্রচারণা করতে দেওয়া হবে কিনা কিংবা আওয়ামী লীগকে পুনরায় সংগঠিত হতে দেওয়া হবে কিনা সেটি ঠিক করার ব্যাপারে ভারত কে? এধরনের কথা বলে জয় নির্লজ্জভাবে ভারতকে বাংলাদেশে হস্তক্ষেপ করার আহ্বান জানিয়েছেন। এই ধরনের কথা বলে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের ওপর ভারতীয় খবরদারিকে আহ্বান জানিয়েছেন এবং এসব কথা বলে বাংলাদেশকে অপমান করেছেন। গত ১৪ আগস্ট ভারতের বহুল প্রচারিত ইংরেজি দৈনিক ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে’ দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন যে ভারত বাংলাদেশের সংবিধানকে সমুন্নত করবে। আমার সন্দেহ হয় যে এসব কথার অর্থ তিনি বোঝেন কিনা। আর যদি বুঝেও এসব কথা বলে থাকেন তাহলে বলতেই হবে যে তিনি এবং তার আওয়ামী লীগ ভারতের কেনা গোলাম হয়ে গেছেন।

জয় কি জানেন না যে, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান কেন হলো? ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে এবং ২০০৯ সালের ৫ জানুয়ারি ক্ষমতা গ্রহণ করে। তারপর ২০১১ সালে ঐ সরকার সংবিধানের ১৩ নং অনুচ্ছেদ বাতিল করে। ১৩ নং অনুচ্ছেদে ছিল নির্বাচনকালীন সরকার বা কেয়ারটেকার সরকারের বিধান। এটি বাতিল করার পর শেখ হাসিনার অধীনে তিনটি নির্বাচন হয়েছে। একটি হলো ২০১৪, আরেকটি ২০১৮ এবং সর্বশেষ ২০২৪। এসব নির্বাচনে জনগণ যদি ভোট দিতে পারতো তাহলে ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থান বা গণবিপ্লব সাধিত হতো কিনা সন্দেহ। যে বিপ্লব সাধন করতে গিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার (অব) সাখাওয়াত হোসেনের উক্তি অনুযায়ী ১ হাজারেরও বেশি লোক প্রাণ দিয়েছেন (মানবজমিন: ১৬ আগস্ট ২০২৪)। সেখানে এসব শহীদের রক্ত মাড়িয়ে ভারত আওয়ামী লীগকে যে উদ্ধার (Rescue) করতে আসবে না সেটি একটি পাগলেও বোঝে। রাষ্ট্রদ্রোহ একটি বিরাট অপরাধ। এই অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- পর্যন্ত হয়। সজীব ওয়াজেদ জয় আইনের এই ধারাগুলি যদি কিছুটা পড়ে থাকেন তাহলে তিনি ভবিষ্যতে আর এসব বালখিল্য কিন্তু রাষ্ট্র বিরোধী উক্তি করবেন না।

॥ তিন ॥

শেখ হাসিনা এবং তার ছেলে জয় জনগণ কর্তৃক ডাস্টবিনে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পরেও কথা বলে যাচ্ছেন কেন? কথায় বলে, ছাগল নাচে খুঁটির জোরে। জয়ের কথাগুলো ঐ ভারতীয় গণমাধ্যম ছাপে আর হাসিনার কথাগুলো ভারতের ইলেকট্রনিক মাধ্যম সম্প্রচার করে। ভারত এবার বাংলাদেশে চরম পরাজয় বরণ করেছে। কিভাবে পরাজিত হয়েছে? বাংলাদেশে তাদের একমাত্র শিখন্ডি হাসিনা গণধিকৃত হয়ে পালিয়ে যাওয়ার পর দেখছি, ওদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিরও মাথা খারাপ হয়ে গেছে। দৈনিক নিউ এজসহ একাধিক পত্র পত্রিকায় প্রথম পৃষ্ঠায় যে সংবাদ ছাপা হয়েছে তার শিরোনাম, 140cr Indian worried about safety of Hindus in Bangladesh: Modi. অর্থাৎ বাংলাদেশের হিন্দুদের নিরপত্তা নিয়ে ১৪০ কোটি ভারতীয় জনগণ উদ্বিগ্ন: মোদি। নরেন্দ্র মোদি এই সাংঘাতিক উক্তি আজেবাজে জায়গায় করেননি। ভারতের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে অর্থাৎ ১৫ আগস্ট লক্ষ লোকের বিশাল রাষ্ট্রীয় সমাবেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে তিনি এই উক্তি করেছেন।

বাংলাদেশে হিন্দুদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৮ শতাংশ (২০২৩ সালের আদমশুমারির আপডেট মোতাবেক)। এই আদমশুমারি মোতাবেক বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৭ কোটি ২০ লক্ষ। তার ৮ শতাংশ হয় ১ কোটি ৩৭ লক্ষ। রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্পর্কে মোদি সাহেব যে অজ্ঞ তা বলছি না। কিন্তু তিনি যে কতবড় সাম্প্রদায়িক তা তার এই উক্তি থেকেই বোঝা যায়। ভারতের ১৪০ কোটি মানুষ ১ কোটি ৩৭ লক্ষ মানুষের (হিন্দু) জন্য উদ্বিগ্ন। তাহলে কি তাদের বাংলাদেশের অবশিষ্ট মানুষ অর্থাৎ ১৫ কোটি ৮২ লাখ মানুষের জন্য কোনো উদ্বেগ নাই? উদ্বেগ যে নাই সেটি তো বিশে^র চতুর্থ শক্তিশালী দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রী এমন চরম এক পক্ষীয় এবং সাম্প্রতিক উক্তির মাধ্যমে প্রমাণ করলেন। মোদি সাহেবকে পাল্টা প্রশ্ন করতে হয়। আপনি বাংলাদেশের হিন্দুদের জন্য উদ্বিগ্ন। তাহলে আমরা অর্থাৎ বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষ কি ভারতের ২০ কোটি মুসলমানের জন্য উদ্বিগ্ন হতে পারি না? আমরা অবশ্যই উদ্বিগ্ন। কিন্তু আওয়ামী লীগ ছাড়া বর্তমান সরকার এবং অবশিষ্ট সমস্ত রাজনৈতিক দল কূটনৈতিক নিয়ম নীতি মেনে চলেন। তাই তারা মোদি সাহেবের মতো চরম সাম্প্রদায়িক উক্তি করেন না।

॥ চার ॥

প্রসঙ্গত, মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের একটি উক্তি এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর থেকে বলা হয়েছে যে তারা বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের সাথে আলাপ করছে। বাংলাদেশ নিয়ে আমেরিকা ভারতের সাথে আলাপ করবে কেন? এটা কি শিয়ালের কাছে মুরগী বর্গা দেওয়ার মতো নয়? আমরা আজ স্থানাভাবে ভারত কর্তৃক বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের জুজু তোলা নিয়ে আলোচনা করতে পারছি না। সংক্ষেপে এটুকু বলতে চাই যে গত ১৫ আগস্ট টকশোতে বিশিষ্ট টেলিভিশন টকশো আলোচক ড. জাহেদুর রহমান একটি তথ্য দিয়েছেন। তিনি দায়িত্ব নিয়ে বলেছেন যে ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে হাসিনার উৎখাতের দিন পর্যন্ত ৭ শতাধিক ব্যক্তি শহীদ হয়েছেন। তারমধ্যে হিন্দুর সংখ্যা মাত্র ২ জন। বাংলাদেশের ২০৫ জায়গায় হিন্দুদের ওপর আক্রমণ চালানো হয়েছে বলে ভারত থেকে যে শোরগোল তোলা হচ্ছে ফ্যাক্ট চেকে দেখা গেছে যে তারমধ্যে ২০১টিই মিথ্যা অভিযোগ। অথচ ৭ শতাধিক ব্যক্তির (ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াতের তথ্য মোতাবেক ১ হাজারেরও বেশি) শাহাদাত সম্পর্কে ভারত একটি কথাও বলেনি। সেই ভারতের সাথে বাংলাদেশকে নিয়ে আমেরিকার কোনো আলাপ আলোচনা বাংলাদেশের মানুষ মানতে রাজি নয়।

দৈনিক সংগ্রাম