ভারতের সাথে পেঁয়াজ, ইলিশ এবং বাণিজ্যের নিজস্ব নিয়ম চাই
Share on:
ভারত থেকে পণ্য আনা সুবিধাজনক বলে আমরা প্রথমেই চাই তাদের সঙ্গে বাণিজ্য করতে। সে সুযোগ সবসময় থাকে না বলে বিকল্পের খোঁজ করতে হয়। হালে পেঁয়াজ আমদানিতে এটা ঘটছিল। আমরা চীন, পাকিস্তান, এমনকি মিসর থেকে পেঁয়াজ আনছিলাম।
ভারত মাঝে পেঁয়াজ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা তুললেও দিয়ে রেখেছিল কঠিন শর্ত। তাতে লাভজনক দামে সেটা আনা যাচ্ছিল না। কিছু ব্যতিক্রম বাদে সারাদেশের মানুষই কিন্তু দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজ খেতে চায়। এর দাম আমদানি করা পেঁয়াজের কাছাকাছি হয়ে গেলে তো আরও। ‘দেশি পেঁয়াজ’ ঘরে সংরক্ষণের জন্যও ভালো। ঝাঁজের কারণেও লোকে এটা পছন্দ করে।
পেঁয়াজের দাম অবশ্য এত বেড়ে যাচ্ছিল, ন্যূনতম রপ্তানি মূল্য আর উচ্চ শুল্ক আরোপিত না থাকলে ভারত থেকে দ্রুত এনে বাজারটা আমরা সামলাতে পারতাম। যা হোক, দেরিতে হলেও ভারত পেঁয়াজ রপ্তানির ওপর উল্লিখিত শর্ত প্রায় প্রত্যাহার করেছে। এতে দেশটি থেকে এখানে পেঁয়াজ আমদানি বাড়বে। ভারতেরও বাড়বে রপ্তানি। তাদের পেঁয়াজ রপ্তানি তো অনেক কমে গিয়েছিল। স্বাভাবিক দামে রপ্তানি করতে না পারায় পেঁয়াজের দাম কমে যাচ্ছিল ভারতে। তাতে বিশেষত পেঁয়াজ উৎপাদনের জন্য খ্যাত অঞ্চলের কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিলেন। বিক্ষোভও হচ্ছিল সেখানে।
পেঁয়াজ রপ্তানি নিরুৎসাহিতকরণ, পরে তা শিথিল করে দেওয়ার সঙ্গে ওখানকার নির্বাচনী রাজনীতিও নাকি জড়িত। সেটা তাদের বিষয়। এ ক্ষেত্রে আমরা কেবল দেখতে চাইব, এখনকার চেয়ে কতটা কমে পেঁয়াজ আনতে পারব ভারত থেকে। ব্যবসায়ীরা সে হিসাব কষেই আমদানি করবেন। বেশি দামে ভারত থেকে পেঁয়াজ এনে তাদের অনেকে ঠকেছেন বলেও খবর মিলছিল। আমদানি করা পেঁয়াজ প্রায় সমান দামেও বেচা যাচ্ছিল না। ইতোমধ্যে অন্যান্য উৎস থেকে যারা পেঁয়াজ এনেছেন, তারা ভারত থেকে আরও কমে পণ্যটি আমদানির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন কিনা, সে প্রশ্নও উঠছে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য আছে মানের প্রশ্ন। উচ্চ মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতিতে মান বিচারের সুযোগ কত শতাংশ ক্রেতার রয়েছে, সে প্রশ্নও আছে। সিংহভাগ বিক্রেতা উচ্চ দামের পণ্য এনে দোকানে তোলেন না এর ক্রেতা কম বলে। তবে ক্রেতাদের জন্য উদ্ভূত পরিস্থিতি ইতিবাচক। কম দামে আমদানি সম্ভব হলে তারাও কম দামে পেঁয়াজ পাবেন। ভারত তার রপ্তানিতে বিধিনিষেধ শিথিল করেছে বলে খবরেই বাজারে কিছু ইতিবাচক প্রভাব পড়ার কথা। ইতোমধ্যে আমদানি করা পেঁয়াজ দ্রুত বাজারে ছাড়ার কারণেও দাম কমে আসার কথা।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য ধাক্কা খেয়েছিল। এখন ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি বাড়লে পরিস্থিতি কিছুটা বদলাবে। অন্তর্বর্তী সরকারও কিন্তু পেঁয়াজ, আলু ও ডিম আমদানি বাড়াতে কর-শুল্কে ছাড় দিয়েছে নতুন করে। ইতোমধ্যে কিছু ডিম এসেছে ভারত থেকে। দাম বৃদ্ধির প্রবণতা থাকায় সরকার চাইছে ধাপে ধাপে হলেও কিছু ডিম আসুক। এ নিয়ে আপত্তিও কম নেই, বিশেষত মুরগি ও ডিম উৎপাদকদের। তবে দেশের পূর্বাঞ্চলে ভয়াবহ বন্যায় এ খাত ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সরবরাহে যে কিছুটা ঘাটতি রয়েছে, সেটা তাদেরও স্বীকার করার কথা। আলুও কিছু আমদানির চেষ্টা রয়েছে। বিগত সরকারের আমলেই এটা শুরু হয়েছিল। আলুর মতো বহুলভোগ্য সবজির দাম কিন্তু এখনও চড়া। শুল্ক প্রত্যাহার হওয়ায় এখন আলুর আমদানিও বাড়বে। আর এটা ভারত থেকে আসার সম্ভাবনাই বেশি। সেখান থেকে একই সময়ে পেঁয়াজ আমদানিও বাড়বে। এতে দু’দেশের বাণিজ্যে নতুন করে গতি আসার সম্ভাবনা।
দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার বাংলাদেশ। পেঁয়াজের মতো মসলা পণ্যের তুলনায় আমরা অবশ্য অনেক বেশি আনছি শিল্পের কাঁচামাল। যেমন ভারতের মোট সুতা রপ্তানির ৩৫ শতাংশই হয় বাংলাদেশে। দেশটি স্বভাবতই চাইবে না বাংলাদেশে তার সুতা রপ্তানি কমুক কিংবা অন্য দেশ থেকে রপ্তানি হোক। এতে নিজ দেশে পণ্যটির দাম কমবে; তুলা চাষিরাও হবেন ক্ষতিগ্রস্ত। পেঁয়াজের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। কোনো দেশই চায় না রপ্তানি কমাতে। যুদ্ধ পরিস্থিতিতেও রপ্তানি নিশ্চিত করতে চায় দেশগুলো। সীমান্তে যত গোলযোগই হোক; ভারত কি চীনের সঙ্গে বাণিজ্য কমাতে চাইছে? হালে চীন বরং হয়ে উঠেছে তার সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। বেশি আমদানি করছে, না বেশি রপ্তানি– সে প্রশ্ন আছে বটে। তবে বেশি আমদানিও আমরা করে থাকি সেখান থেকেই, যেখানে ‘তুলনামূলক সুবিধা’ বেশি। ভারত তার নীতি পরিবর্তন করলেও আমরা ততক্ষণ পর্যন্ত ওখান থেকে পেঁয়াজ আনতে চাইব না, যতক্ষণ এর লাভজনক দামের ব্যাপারে আশ্বস্ত হচ্ছি। লাভজনক হলে ভারতের বদলে দূরবর্তী উৎস যেমন মিসর থেকেও পেঁয়াজ আনবেন ব্যবসায়ীরা। ক্রেতারাও কিনতে গিয়ে দামের বিষয়টা বড় করে বিবেচনায় নেবেন।
আসছে দুর্গাপূজায় এবার অবশ্য বাংলাদেশ থেকে ইলিশ যাচ্ছে না ভারতে। তাদের আমদানিকারকদের তরফ থেকে এমন প্রস্তাব এলেও সরকার অবস্থান বদলায়নি। বাংলাদেশ থেকে ইলিশ রপ্তানি কিন্তু বন্ধ রাখা হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। দুর্গাপূজার সময় কেবল কিছু ইলিশ পাঠানো হতো ভারতে। সেটা ছিল বিগত সরকারের ‘রাজনৈতিক বিবেচনা’। অন্তর্বর্তী সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা তাদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন, দেশের মানুষই এবার ইলিশ খাবে। এদেশেও হিন্দু সম্প্রদায় রয়েছে এবং তারাও পূজা উদযাপন করবে।
উল্লেখ্য, সিংহভাগ ইলিশ বাংলাদেশে আহরিত হলেও এখানে অনেক দিন ধরে এর দাম চড়া। এবার দাম আরও বেড়েছে। আগেকার মতো ভারতে ইলিশ পাঠালে দাম আরও বাড়বে বৈকি। এ অবস্থায় ভারতে ইলিশ পাচারের শঙ্কা অবশ্য রয়েছে ওখানে উৎসবকেন্দ্রিক চাহিদার কারণে। মিয়ানমার হয়েও কিছু ইলিশ ভারতে চলে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এমন সব চেষ্টা হয়তো বানচাল করা যাবে না; তবে প্রয়াস থাকতে হবে। পুলিশ সক্রিয় নয় এখনও; তবে বিজিবির তৎপরতা ভালোভাবেই লক্ষণীয়। নৌপথেও পাচার রোধ করা চাই। এর পরও বোধ হয় আশা করা যাবে না– দেশে ইলিশের দাম সহনীয় হবে। এর দাম কীভাবে কমানো যায়, সেটা গভীর অনুসন্ধানের বিষয়। এ ক্ষেত্রে তথ্যগত সঠিকতা আছে কিনা, সেটা আগে দেখা দরকার। দেশে ইলিশের উৎপাদন ও আহরণ অব্যাহতভাবে বাড়ার যে খবর দেওয়া হচ্ছিল, তা সঠিক ছিল কি?
দেশে পেঁয়াজ ‘যথেষ্ট উৎপাদিত’ হলেও এর দাম কেন এভাবে বাড়ল, সেটাও অনুসন্ধানের বিষয়। এর উৎপাদন সংক্রান্ত তথ্যও কি ঠিক আছে? সংরক্ষণের অভাবে পেঁয়াজ নষ্ট হওয়ার হার কেন যৌক্তিক পর্যায়ে আনা যাচ্ছে না? হালে ‘গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ’ও দেশে কম উৎপাদিত হচ্ছে না। আমদানির পাশাপাশি নিশ্চয় জানতে চাইব এ মুহূর্তে সেই পেঁয়াজ উৎপাদনের খবর। জুলাই-আগস্টে দেশে যা-ই ঘটুক– পেঁয়াজের এ আগাম মৌসুমটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা নয়। সেটা না হলে শীতের আগ দিয়ে আমদানি কম হলেও পেঁয়াজের দাম আর বাড়ার কারণ নেই।