বয়স ৯ না হলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে নিবন্ধন নয়, শুরু হোক শুদ্ধাচারের পথচলা
Share on:
সরকারি এক অফিসে গিয়ে দেখি পত্রিকা পড়তে পড়তে এক কর্মচারী মহা ক্ষুব্ধ। আড় চোখে দেখি তিনি পড়ছেন একটি খবর, যার শিরোনাম ‘বয়স ৯ না হলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে নিবন্ধন নয়’। খবরটি আমারও মনোযোগ কাড়ল। এক সময় দীর্ঘদিন জন্ম-মৃত্যুনিবন্ধনের প্রকল্প পরিচালক ছিলাম।
শিক্ষার্থীদের বয়স নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুই রকম অবস্থানের কারণে আমাদের যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে।
দৈনিক সমকালে ৩ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত সংবাদটি এ রকম: ‘আগামী ১০ সেপ্টেম্বর ঢাকা বোর্ডে ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের অনলাইন রেজিস্ট্রেশন (নিবন্ধন) শুরু হবে। এ প্রক্রিয়া চলবে ৯ অক্টোবর পর্যন্ত। রেজিস্ট্রেশন করতে শিক্ষার্থীর বয়স ন্যূনতম ৯ বছর হতে হবে।’
২০০৪ সালের জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন আইনে বিদ্যালয়ে ভর্তির সময় জন্মনিবন্ধন সনদ দাখিলের বাধ্যবাধকতা আছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ৫ম শ্রেণিতে সমাপনী পরীক্ষাটি পাবলিক পরীক্ষা হওয়ায় সেখানে জন্মতারিখ লিপিবদ্ধ করা আবশ্যক হয়ে পড়েছিল। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ অনুসারে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির ন্যূনতম বয়স ৬+ বছর। সে হিসাবে একজন শিক্ষার্থী ৫ম শ্রেণিতে উন্নীত হয় ১০+ বছর বয়সে। প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় সেই বয়স হিসাব করেই শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করত। সম্প্রতি এ সমাপনী পরীক্ষাটি উঠে গেছে।
জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন কার্যক্রমে আমরা যন্ত্রণার মুখোমুখি হতাম শিক্ষার্থী নবম শ্রেণিতে উন্নীত হওয়ার পর। দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এসএসসি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়ার বয়স ১৪+ বছরে ধার্য করে রেখেছিল। ১৪+ বছর বয়সে এসএসসি উত্তীর্ণ হওয়ার সুযোগ থাকায় ৯ম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থীর বয়স অনায়াসে ১২+ বছর হতে পারে। অথচ ১ম শ্রেণিতে ৬+ বছর বয়সে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থী নিয়মিতভাবে প্রতিবছর শ্রেণি উত্তীর্ণ হলে ৯ম শ্রেণিতে পড়ার সময় তার বয়স স্বাভাবিক নিয়মে ১৪+ বছর। এই দুই বছরের বাড়তি সুবিধা নিতে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন সংশ্লিষ্ট কার্যালয়গুলোয় দেদার বয়স কমানোর আবেদন আসত। এ জন্য প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের কম ধকল পোহাতে হয়নি।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অনেক দেনদরবার সত্ত্বেও সাধারণ অঙ্ক না জানা কর্মকর্তারা এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের বয়স ১৫+ বছর নির্ধারণ করেছিলেন। পরিশেষে অঙ্ক করতে শিখে ২০২২ সালের ৩ জানুয়ারি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ অনুযায়ী শিক্ষার্থী ভর্তির সংশোধিত নীতিমালায় দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তির বয়স ৭ বছরের বেশি, তৃতীয় শ্রেণিতে ৮ বছরের বেশি, ষষ্ঠ শ্রেণিতে ১১ বছরের বেশি ও সপ্তম শ্রেণিতে ১২, অষ্টম শ্রেণিতে ১৩ ও নবম শ্রেণিতে ভর্তির ন্যূনতম বয়স ১৪ বছর বেঁধে দিয়েছিল। বেঁধে দেওয়া এ বয়স ছিল জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর সঙ্গে শতভাগ সামঞ্জস্যপূর্ণ।
কী এমন কারণ ঘটল, ২০২২ সালের হুকুম বদলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে বয়স ৯ না হলে নিবন্ধন নয়– আদেশ হলো? বুদ্ধিমান মানুষ হয়তো বলবেন, সমস্যা কোথায়? যার বয়স ১১, সে তো ৯ পার করেছেই। ৯ তো ন্যূনতম বলা হচ্ছে! সমস্যা হচ্ছে এখানে, যে শিশু ৯+ বছর বয়সে ৪র্থ শ্রেণিতে পড়েছে সেই শিশু এখন তার হারিয়ে যাওয়া দুই বছর ফিরে পাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়বে। ভবিষ্যৎ দুই বছর বেশি সময় পাবে চাকরি খোঁজার জন্য, চাকরি করবে দুই বছর বেশি। শুধু এখন বদলিয়ে নেওয়া জন্মতারিখ। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা মন্ত্রণালয় উদার চিত্তে শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করছে বয়স নিয়ে তুলকালাম করতে।
মানুষের বয়সের তারতম্য অবশ্যই একটি দুর্নীতি। এই দুর্নীতি করতে সহায়তা করেন অনেক ক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষাসংশ্লিষ্টরাই। ২০০৬ সালের ৩ জুলাই থেকে দেশে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন আইন কার্যকর হওয়া সত্ত্বেও বয়সের গোঁজামিল চলছেই। ষষ্ঠ শ্রেণিতে এখন কমপক্ষে ২৫ লাখ শিক্ষার্থী। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, আগামী এক মাসের মধ্যে এই ২৫ লাখ শিক্ষার্থীর সিংহভাগের অভিভাবক জন্মনিবন্ধন সনদ পরিবর্তনের জন্য দৌড়াবেন। পরিবর্তন সম্ভব হবে না বলে নতুন করে জন্মনিবন্ধন করবেন। দেশে নিবন্ধিত জন্মসংখ্যা মোট জনসংখ্যাকে ছাড়িয়ে যাবে আরও অনেক। যে শিশুর অভিভাবক সফল হবেন বয়স বদলাতে, সেই শিশু শরিক হবে দুর্নীতির অংশ হিসেবে। দুর্নীতির এই প্রাথমিক সবক নিয়েই শুরু হবে তার বেড়ে চলা।
জাতীয় জীবনে শুদ্ধতার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এগিয়ে আসুক। ষষ্ঠ শ্রেণিতে নিবন্ধনের জন্য ৯+ নয়, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর আলোকে ১১+ বছর বয়সকে ন্যূনতম ঘোষণা করুক। শুরু হোক শুদ্ধাচারের পথচলা।