বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় গড়তে চাই শিক্ষাবান্ধব নীতি
Share on:
বিশ্ববিদ্যালয় হবে বিশ্বজনীন। মান ও সুযোগ-সুবিধার প্রশ্নে বিশ্বমানের হতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে।
এ জন্য প্রথমেই নজর দিতে হয় শিক্ষাবান্ধব নীতি, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত পরিবেশ, উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগ, যোগ্যতম উপাচার্য নিয়োগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে গণতন্ত্র ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যকার সুসম্পর্ক, বাক্স্বাধীনতা, চাকরির সন্তুষ্টি, পড়াশোনার আনন্দ ও সার্বিক নিরাপত্তায়। উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন মেনে (১৯৭৩-এর স্বায়ত্তশাসন) এবং নিয়ন্ত্রণমূলক আইন সংস্কার করে একাডেমিক যোগ্যতা ও শিক্ষকসমাজে গ্রহণযোগ্যতাকে প্রাধান্য দিতে হবে। আগের উপাচার্যদের আমলনামা প্রকাশ এবং দুর্নীতি ও অন্যায়ের ক্ষেত্রে বিচার নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় পরের উপাচার্য ও অন্যান্য প্রশাসক সৎপথে থাকার উৎসাহ হারাবেন।
মঞ্জুরি কমিশনের অনাহূত খবরদারি কমাতে হবে এবং হেকেপসহ ওপর থেকে চাপানো প্রকল্পগুলোর দৌরাত্ম্য থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে মুক্তি দিতে হবে। মন্ত্রণালয় ও মঞ্জুরি কমিশন থেকে বারবার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিজস্ব আয় বাড়ানোর ওপর জোর দিয়ে মূলত বৈকালিক ও সান্ধ্য কোর্স পরিচালনার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। এই অনৈতিক চর্চা বন্ধ করতে হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অন্য/প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষকতার সুযোগ বন্ধ করতে হবে। ওপর মহল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে হস্তক্ষেপ বন্ধের পাশাপাশি উপাচার্যদের একচ্ছত্র ক্ষমতা কমাতে হবে। ক্ষমতা শুধু উপাচার্য বা উপ-উপাচার্যের মধ্যে ভাগাভাগি করলে হবে না; ডিন, প্রভোস্ট, বিভাগের সভাপতি সবার মাঝে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে উপাচার্যের একচ্ছত্র ক্ষমতা কমাতে হবে।
প্রভাষক পদে পিএইচডি ছাড়া নিয়োগ দেওয়া বন্ধ করতে হবে এবং মৌখিক পরীক্ষাটি সংশ্লিষ্ট ফ্যাকাল্টিতে জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকদের সামনে সম্পাদন করতে হবে। যোগদানের পর প্রশিক্ষণ ও মূল্যায়নের পর চাকরি স্থায়ী করা যেতে পারে। শিক্ষক নিয়োগের জন্য নীতিমালা সব বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিন্ন হওয়া উচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে যেসব পর্ষদে নির্বাচন হয়, সেগুলোতে উপাচার্য সব সময় হস্তক্ষেপ করতে না পারলেও অধিকাংশ প্রশাসক নিয়োগ দেন তিনি। সে জন্য সিনেটসহ সব নির্বাচনী পর্ষদে যথাসময়ে নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার মান ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সুসম্পর্কের লক্ষ্যে অনুপাত বিবেচনায় নিতে হবে, যাতে একজন শিক্ষক তাঁর ক্লাসের সব শিক্ষার্থীকে জানার সুযোগ পান। ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত যথাযথ হলে শিক্ষার্থীদের সমস্যা অনুধাবনপূর্বক যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ সহজতর হয়। বর্তমানে এক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক সংলাপ নেই বললেই চলে। ফলে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কী পাঠদান করা হয়, তা জানার সুযোগ খুবই সীমিত। তা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মঞ্জুরি কমিশন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক সহায়তায় যেসব গবেষণাকর্ম সম্পাদিত হয়, তা কোথাও যথাযথভাবে সংগৃহীত হয় না। ফলে একজনের গবেষণা সম্পর্কে অন্যের জানার সুযোগ কম। তাই সারাদেশের গবেষণাকর্মগুলো যদি কোনো নির্দিষ্ট সাইটে জমা রাখার ব্যবস্থা করা যায়, সবাই জানার সুযোগ পাবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা সহজতর ও কঠিনতম করতে হবে। ভর্তি পরীক্ষার ভোগান্তি কমাতে হবে, তবে পরীক্ষা পদ্ধতিতে সংস্কার করতে হবে।
এমসিকিউনির্ভর পরীক্ষার মাধ্যমে প্রকৃত মেধা যাচাই সম্ভব হয় না। ভর্তির পর বিশ্ববিদ্যালয় যেন সব শিক্ষার্থীর কাছে অভয়ারণ্য হিসেবে জ্ঞানের উন্মুক্ত পাঠাগাররূপে প্রতিভাত হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। ভর্তির সঙ্গে সঙ্গে তাদের জন্য থাকার নিরাপদ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। আপাতত সবার জন্য সিট বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব না হলে মেধার ভিত্তিতে তা দিতে হবে। যেখানে খাবারের মান ভালো থাকবে; থাকবে পড়াশোনার জন্য অনুকূল পরিবেশ। গণরুম সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে। ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের লেজুড়বৃত্তি রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। তাদের অধিকার, রাষ্ট্র ভাবনা ও চিন্তার প্রকাশ ঘটানোর সুযোগ থাকবে, তবে সেটা জাতীয় রাজনীতির প্রকোপমুক্ত থাকতে হবে। তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, বিতর্ক, খেলাধুলা ইত্যাদির সুব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে; যার মূল কেন্দ্র হবে ছাত্র সংসদ। তাই অনতিবিলম্বে ছাত্র সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে।
শিক্ষকদের মতো শিক্ষার্থীদের নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিত থাকতে হবে। কলেজিয়েট-ননকলেজিয়েট নিয়ম মানতে হবে কিংবা নিয়মটি তুলেই দিতে হবে, যার খুশি সে ক্লাস করবে। তরুণ প্রজন্মের মনস্তত্ত্ব ও যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম প্রবর্তন করতে হবে। বারবার পরীক্ষা দেওয়ার বিশেষ সুবিধা বন্ধ করতে হবে। শিক্ষকরা যদি ছুটি বা অন্য কোনো কারণে ক্লাস নিতে না পারেন, তা আগেভাগে অফিসিয়ালি জানিয়ে দেবেন। তবে পরীক্ষা অনুষ্ঠানের ৪৫ দিন আগে অবশ্যই সব কোর্সের ক্লাস সম্পন্ন করতে হবে। পরীক্ষা সম্পন্ন হওয়ার তিন মাসের মাথায় ফলাফল প্রকাশের ব্যবস্থা নিতে হবে।
ক্লাসের ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন আবশ্যক। ক্লাসরুমের সাউন্ডসিস্টেম উন্নত করতে হবে। লেকচারধর্মী ক্লাস থেকে পারস্পরিক আলোচনাভিত্তিক ক্লাসের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করা, ক্রিটিকাল চিন্তার সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে। মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ৭০-১০০ নম্বরের বার্ষিক পরীক্ষা অপেক্ষা নিয়মিত মূল্যায়নের ব্যবস্থা রাখতে হবে, যাতে সারাবছর শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় ব্যস্ত থাকেন। প্রতিমাসে ক্লাসের অগ্রগতি নিয়ে বিভাগ ও ডিন অফিসে আলোচনার ব্যবস্থা রাখতে হবে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণকালীন শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। কোনোভাবেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যাবে না।
শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন যথা– শাটল ট্রেন সংস্কার, হলে দ্রুত আসন বরাদ্দ, খাবারের মান বৃদ্ধি, ক্যাম্পাসে আগের মতো আন্তঃক্যাম্পাস বাস চালু করা সময়ের দাবি। সেই সঙ্গে ফ্যাকাল্টিভিত্তিক হল নির্দিষ্টকরণ বন্ধ করতে হবে। একই হলে বিভিন্ন ফ্যাকাল্টি ও বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষার্থীদের সহাবস্থান জ্ঞানের পরিধি বাড়ায়। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও বিরোধিতা সত্ত্বেও নব্বইয়ের শেষের দিকে আন্তঃক্যাম্পাস বাস বন্ধ ও ফাকাল্টিভিত্তিক হলপ্রথা চালু করা হয়েছিল। সর্বোপরি উপাচার্য ও রেজিস্ট্রার অফিসে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সহজ অ্যাকসেস ও সেবা নিশ্চিত করতে হবে। কোনো কাজে আবেদন করে দিনের পর দিন ঘোরাঘুরি কিংবা ফোন করার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে হবে।