মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: শনিবার ২১, সেপ্টেম্বর ২০২৪

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ব্যবস্থার মানোন্নয়নে যেমন সিনেট ও সিন্ডিকেট প্রয়োজন!

Share on:

সরকারি সব চাকরিতে মেধাবীদের সমান সুযোগ তৈরির লক্ষ্যে এ দেশের তরুণ শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু করেছিল ২০১৮ সালে। সংবিধানের মূলনীতি অনুযায়ী রাষ্ট্রের সব নাগরিকের জন্য সামাজিক ন্যায়বিচার সরকার নিশ্চিত করতে পারেনি।


সদিচ্ছা থাকলে নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে সরকার কোটা সংস্কার কমিশন গঠন করতে পারত, যে কমিশন দ্রুততম সময়ে পরিকল্পনা তৈরি করে গবেষণা অনুসন্ধানের মাধ্যমে ন্যায়ভিত্তিক সুপারিশমালা দিতে পারত, যার বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে ওই সংকটের যৌক্তিক সমাধান হতে পারত। যা-ই হোক দেশ ও জাতির সে সৌভাগ্য হয়ে ওঠেনি।

সে সময় আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নিলে তৎকালীন সরকারের প্রধান নির্বাহী সম্ভবত বিরক্তি ও ক্রোধের বশবর্তী হয়ে নির্বাহী আদেশে পরিপত্র জারির মাধ্যমে ৯ম-১৩তম গ্রেড পর্যন্ত পুরো কোটা পদ্ধতিই বাতিল করে দেন, যা প্রকৃতপক্ষে কখনই আন্দোলনকারী এবং দেশবাসীর কাঙ্ক্ষিত ছিল না। যথাসময়ে কোটা প্রথার সংস্কার না করে পুরো কোটা বাতিল করে দিয়ে মূলত কোটা সংস্কারের যৌক্তিক পরিবর্তনের বিষয়টিকে কূটকৌশলে জিইয়ে রাখা হয়েছিল। ওই পরিপত্রের বৈধতা বাতিল হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে জনগণের মধ্যে যে দুশ্চিন্তা ছিল, তা প্রকাশ্যে আসে ২০২১ সালে একটি রিট করানোর মধ্য দিয়ে। যে আশঙ্কা ছিল তা বাস্তবে পরিণত হয়! চূড়ান্ত শুনানি শেষে গত ৫ জুন সংশ্লিষ্ট হাইকোর্ট বেঞ্চ সরকারের জারি করা পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। এর মাধ্যমে সব ধরনের কোটা প্রথা আবার পুনরুজ্জীবিত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা ভীষণ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন, প্রতিবাদে ফেটে পড়েন এবং কোটা সংস্কারের ন্যায়সংগত ও যৌক্তিক সমাধানের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাতে থাকে। চলমান পরিস্থিতিতে হাইকোর্ট বেঞ্চের ওই রায়ের বিরুদ্ধে সরকার সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে, যার শুনানি সুপ্রিম কোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে ৪ জুলাই অনুষ্ঠিত হবে বলে নির্ধারিত হয়। ভোটের অধিকার হরণকারী জনবিচ্ছিন্ন সরকার আমজনতাকে নির্বোধ ভেবে আদালতকে দিয়ে ওই তারিখে শুনানি আরো এক মাস পিছিয়ে দেয়। তবে সরকারের প্রহসন-প্রবঞ্চনায় শিক্ষার্থীরা আরো বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন, আন্দোলন আরো তীব্রতর হতে থাকে। ৬ জুলাই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়করা সারা দেশে ‘বাংলা বন্ধ’র ডাক দেন। সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ, পরীক্ষা বর্জন ও সাধারণ ছাত্র ধর্মঘটের আহ্বান জানানো হয়। বিচার বিভাগের প্রতি চরম আস্থাহীনতা থেকে শিক্ষার্থীরা নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে বারবার সমাধান চাইলেও সরকার উচ্চ আদালতের দোহাই দিয়ে বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখে।

সরকারের বোদ্ধা কুশীলবরা মনে করেছিল যে তাদের এ ইঁদুর-বেড়াল খেলাটি জনগণ কিছুতেই বুঝবে না। আর সেটিই ছিল সরকারের বড় ভুল ও বোকামি। বিচার বিভাগ থেকে সরকারের ইচ্ছার বাইরে কখনই কোনো রায় ঘোষণা হতে এ দেশের জনগণ দেখেনি। এ কারণে বিচার ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা শূন্যে নেমে গিয়েছিল। আর সে কারণেই সরকার বারবার উচ্চ আদালতের দোহাই দিতে থাকলে এ দেশের ছাত্র-জনতা বিরক্ত ও বিক্ষুব্ধ হতে থাকে এবং সর্বোচ্চ আদালত কী রায় দেবেন সেটা নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা ছিল না।

পতিত সরকার রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ, পুলিশ, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিচার বিভাগকে নির্লজ্জভাবে দলীয়করণ করে কুক্ষিগত করে ফেলেছিল। দেশের সব সরকারি কর্মক্ষেত্রে, সাংবিধানিক ও স্বায়ত্তশাসিত সব প্রতিষ্ঠানে মেধা ও যোগ্যতার মূল্যায়ন যথাযথভাবে হয়নি, সর্বক্ষেত্রেই মেধাবী, যোগ্য, সৎ, পেশাদার ও দক্ষদের মূল্যায়ন না করে স্বজনপ্রীতি করে মেরুদণ্ডহীন, দুর্নীতিবাজ, অসৎ ও অযোগ্যদের পদায়ন করা হয়েছিল।

সবক্ষেত্রে বিগত সরকারের সর্বগ্রাসী রূপ এ দেশের জনগণ প্রত্যক্ষ করেছে। কোটা সংস্কার বিষয়ে বারবার প্রতারণার কৌশল গ্রহণ করায় সরকারের প্রতি ছাত্রসমাজের আস্থা শূন্যে নেমে যায় এবং কোটা সংস্কার আন্দোলন কোটারিতন্ত্রের অবসানের লক্ষ্যে সরকার পতনের এক দফার আন্দোলনে পরিণত হয়। কোটা সংস্কারের ন্যায্য দাবির পেছনে এ দেশের ছাত্র-জনতার মধ্যে আরো একটি স্বপ্ন লুক্কায়িত ছিল, সেটি হলো কোটারিতন্ত্র ভাঙার স্বপ্ন। সারা দেশ থেকে ৫ আগস্ট লাখ লাখ ছাত্র-জনতার ঢাকা মার্চ কর্মসূচির মুখে জনবিচ্ছিন্ন ফ্যাসিস্ট একনায়ক স্বৈরশাসক পদত্যাগে বাধ্য হন এবং দলের অগণিত নিরীহ নেতাকর্মীকে তারই তৈরি করা আগুনে ফেলে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেন ভারতের মোদি সরকারের কাছে, যিনি ভারতকে উগ্র সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করেছেন।

দেশ কার্যত তিনদিন সরকারবিহীন থাকার পর ডকট্রিন অব নেসিসিটি অনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ১৯৪৭-৭১ পর্যন্ত দীর্ঘ ২৪ বছরের গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালেও দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারির পর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সব পক্ষের জাতীয় ঐকমত্য ও সংহতির ভিত্তিতে যে বাংলাদেশ গড়ার সুযোগ আমাদের ছিল, তা হাতছাড়া হয়েছে। পরে ১৯৯০ সালে সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের নেতৃত্বে সামরিক স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে এবং ডকট্রিন অব নেসিসিটি অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন হয়।

আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী সমাজ ও রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জনগণের স্বাধীনভাবে ভোট প্রদানের অধিকার নিশ্চিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে সংযোজিত হয়। ‘‌স্বৈরতন্ত্র নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’—এ দাবিতে নূর হোসেনসহ অনেক ছাত্র-জনতা প্রাণ দিয়েছিল তখন। নব্বইয়ে দেশের ছাত্র-জনতা যে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের স্বপ্ন দেখেছিল, তার বাস্তবায়ন রাষ্ট্র ও সমাজের কোথাও তারা দেখতে পায়নি। রাজনৈতিক দলগুলো যখন যারা ক্ষমতায় এসেছে, তারা ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে গিয়ে গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থাগুলো উন্নত না করে সমাজ ও রাষ্ট্রকে ক্রমান্বয়ে অবনতির দিকে নিয়ে গেছে। ফলে গণতন্ত্রের পথে সমাজ ও রাষ্ট্রকে নিয়ে যাওয়ার ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন হয়নি। জাতীয় ঐক্য ও সংহতি নিয়ে গণতন্ত্রের পথে চলার সুযোগ আবারো হাতছাড়া হয়। ফলে ২০০৭ সালে এসে এক অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির উদ্ভব হয়।

গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও রক্ষা করার কথা বলে ২০০৯ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা রাজনৈতিক শক্তি পুনরায় ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে নিজেরাই কূটকৌশলে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচনী ব্যবস্থার বিলোপ ঘটায়। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলে ক্ষমতায় এলেও তারা ধীরে ধীরে জনগণের ভোটাধিকার হরণ করে গণতান্ত্রিক নির্বাচনী ব্যবস্থা ধীরে ধীরে একেবারে ধ্বংস করে ফেলে, যা দেশবাসী ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে প্রত্যক্ষ করেছে।

একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যখন কোনো নাগরিকের ভোট দেয়ার অধিকার থাকে না তখন সেই সরকারের জনগণের প্রতি জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতা থাকে না। এ কারণে বিগত সরকার দিনে দিনে জনবিচ্ছিন্ন, ফ্যাসিস্ট ও ভয়ংকর কর্তৃত্ববাদী নিপীড়ক সরকার হয়ে ওঠে। স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট শাসনের অবসানের লক্ষ্যে জনগণেরও আকাঙ্ক্ষা ছিল। কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে ছাত্ররা স্ফুলিঙ্গ জাগিয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে এক অকল্পনীয় দুঃসাধ্য সাধন করেছে এ দেশের ছাত্র-জনতা।

দেশের অকুতোভয় শিশু-কিশোর-তরুণ যুবকরা যূথবদ্ধ হয়ে নিঃশঙ্ক চিত্তে প্রাণ দিয়েছে। তাদের এ আত্মদান জনগণকে আলোড়িত করেছে, করেছে সংঘবদ্ধ! এ কারণে আমাদের এ ঐতিহাসিক পরিবর্তন দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের শুরু থেকেই আমার সমর্থন ও প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ছিল। এ আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি। আমাদের নতুন প্রজন্ম জেনারেশন জেড বা জেন-জি অসাধ্যকে সাধন করেছে। ফ্যাসিস্ট শাসকের পতনের পর প্রতিদিন যে ভয়াবহ তথ্য বের হচ্ছে তাতে মানুষ জানতে ও দেখতে পারছে নিপীড়ক ফ্যাসিস্ট স্বৈরশাসকের স্বরূপ। ধর্মীয় ও বাকস্বাধীনতা জন্মগতভাবেই প্রত্যেক মানুষের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ফ্যাসিস্ট সরকারের শাসনামলে সরকারবিরোধী চিন্তাচেতনার ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা ছিল না, এটি ধর্মীয় ও রাজনৈতিক উভয় দিক থেকেই। ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর জনগণ তার নিজ নিজ ধর্ম-কর্ম ও মত প্রকাশ করার অধিকার ফিরে পেয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যে শাসক ক্ষমতায় আসবে জনগণের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা থাকে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যখন কোনো নাগরিক তার ভোট দেয়ার অধিকার হারায় তখন এর চেয়ে দুঃখজনক আর কিছু নেই। দেশের মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য। এখন দরকার একটি শক্তিশালী নির্বাচনী প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠা। এজন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একটি বড় লক্ষ্য হওয়া উচিত সুষ্ঠু নির্বাচনী প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠা করা।

এ আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণ একটি ইতিবাচক শক্তির বিস্তার দেখতে পেয়েছে। সেই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে হবে এখন। একটি রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হচ্ছে শিক্ষা ব্যবস্থা। দেশের প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত শিক্ষা ব্যবস্থাকে একদম ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। ফলে আমরা শিক্ষায় আন্তর্জাতিক মান থেকে অনেক পিছিয়ে পড়েছি।

শিক্ষার আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে এ শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো দরকার। নব্বইয়ের পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতিতে দলীয়করণ ঘটেছে ও অতিমাত্রায় কলুষিত হয়েছে। নব্বই-পরবর্তী যখনই যে রাজনৈতিক দল সরকার গঠন করেছে এবং ক্ষমতা পেয়েছে, তখনই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় তারা তাদের ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনকে দলীয় স্বার্থে নগ্নভাবে ক্ষমতার হাতিয়ার ও সরকারবিরোধী যেকোনো প্রতিবাদ দমনে ব্যবহার করেছে। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী নিয়মিত ছাত্ররা ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতৃত্বে আসার কথা থাকলেও তার বাস্তবায়ন দেখা যায়নি।

সংগঠনগুলো সবসময় মেয়াদোত্তীর্ণ ছাত্রদের দিয়ে পরিচালিত হওয়ায় শিক্ষাজীবন শেষ হয়ে যাওয়ার পরও সংগঠনকে ব্যবহার করে দিনের পর দিন অবৈধভাবে আবাসিক হলগুলোর সিট দখল করে থাকায় কৃত্রিম আসন সংকটে গণরুম সংস্কৃতি চালু হয়েছে। শিক্ষাজীবন শেষ হওয়ার পরও অবৈধ অর্থ ও বিত্ত সংগ্রহে হলে থেকে ক্ষমতার দাপটে তাদের বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড—মাদক ব্যবসা, মাদক গ্রহণ, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে। এ ধরনের কর্মকাণ্ড তাদের জীবনকে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছে। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যারা ভর্তি হন তাদের অধিংকাংশই মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন কোনো শিক্ষার্থী ভর্তি হয়, তখন সে একটি স্বপ্ন দেখে! সে স্বপ্ন তার জীবন গড়ার স্বপ্ন, সে স্বপ্ন তার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ তৈরির স্বপ্ন। একই স্বপ্ন দেখে তার পরিবারও।

কিন্তু নির্মম পরিহাস এই যে কলুষিত ছাত্র রাজনীতির চোরাবালিতে আটকে অসংখ্য মেধাবী শিক্ষার্থীর জীবন গড়ার স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। নব্বইয়ের পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সরকারের নির্লজ্জ স্তাবক শ্রেণী তৈরি করতে শিক্ষকদেরও প্রকটভাবে দলীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করা হয়েছে এবং তার বাস্তবায়নে প্রশাসনকে মেরুদণ্ডহীন করে রাখা হয়েছে। শিক্ষকদের দলীয় লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হওয়া এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিমাত্রায় রাজনৈতিক নিয়োগ ও পদোন্নতির কারণে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা ও গবেষণার মান অনেক নিচে নামিয়ে আনা হয়েছে। দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক শক্তিগুলোকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে তারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় দলীয়করণমুক্ত রাখবে এবং দলীয় স্বার্থে ছাত্র-শিক্ষককে ক্ষমতায় টিকে থাকার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করবে না।

ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতৃত্বে গঠনতন্ত্র মেনে নিয়মিত ছাত্রদের নেতৃত্বে আনার সংস্কৃতি চালু করতে হবে। আর ছাত্র-শিক্ষককেও রাজনীতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। সুষ্ঠু সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণের জন্যই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় দলীয় ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত রাখতে পারলেই শিক্ষা-গবেষণা ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা সম্ভব। আর এটা করতে পারলেই নির্বিঘ্ন ও নিঃশঙ্কচিত্তে দেশের যেসব শিশু-কিশোর-তরুণ প্রাণ দিয়ে শহীদ হয়েছে, তাদের প্রতি প্রকৃত সম্মান দেখানো হবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ বডি হচ্ছে সিনেট ও সিন্ডিকেট। রাষ্ট্রের বিভিন্ন উপাদানের মতো দলীয় প্রভাবে এসব বডিকে মেরুদণ্ডহীন ও অকার্যকর রেখে বিশ্ববিদ্যালয়কে দুর্বল করে রাখা হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থার মানোন্নয়নে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠাসহ দরকার কার্যকর সিনেট ও সিন্ডিকেট। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ ও স্ট্যাটিউট অনুসরণ করে যোগ্যদের দিয়ে এসব বডিকে শক্তিশালী করতে হবে। সিনেটে ছাত্রদের প্রতিনিধিত্ব থাকার কথা থাকলেও সেটি দীর্ঘদিন ধরেই অনুপস্থিত। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনায় ছাত্রদের অংশগ্রহণ নেই। সিনেটে ছাত্র প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচন অনুষ্ঠানও জরুরি।

আমরা রাষ্ট্র গঠনের জন্য তিনবার সুযোগ পেয়েছি। এক. ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যখন স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলো তখন; দুই. ১৯৯০ সালে সামরিক শাসনের পতনের পর; তিন. ২০২৪-এ ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর। ২০২৪ সালে অনেক প্রাণ ও ত্যাগের বিনিময়ে যে সুযোগ পেয়েছি তা দেশ ও জাতির পুনর্গঠনে কাজে লাগাতে হবে। পরিচ্ছন্ন বাংলাদেশ, পরিচ্ছন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও পরিচ্ছন্ন শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ায় প্রয়োজন জাতীয় ঐকমত্য ও সংহতি। এ সুযোগ আবার আসবে কিনা তা বলা কঠিন। অনেক প্রাণের বিনিময়ে যা আমরা পেয়েছি তা আর হারাতে চাই না।

দৈনিক বণিক বার্তা