বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের উপযুক্ত নেতৃত্ব ফিরে আসুক
Share on:
সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান হয়েছেন অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ। এই নিবেদিত শিক্ষাবিদ কতটা সংবেদনশীল ও বিনয়ী, তার প্রমাণ ছাত্রজীবনেই পেয়েছিলাম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলে থাকাকালে (১৯৮১-৮৮) শেষ দুই বছর আমাদের প্রভোস্ট ছিলেন ড. এস এম এ ফায়েজ। ১৯৮৭ সালে এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার আন্দোলন ছিল তুঙ্গে। ক্যাম্পাসজুড়ে অস্থিরতা, অবরোধ, কর্মসূচি, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। প্রায় প্রতিদিন পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের সংঘর্ষ। নভেম্বর মাসের দিকে দোয়েল চত্বর এলাকায় এক সংঘর্ষের পর ছাত্রদের কেউ পুলিশের ক্যাপ নিয়ে এসে হলের ছয়তলায় আমাদের কক্ষের সামনে রাখে। রাতে আমার রুমমেট সেটা জানালার কার্নিশে রেখে দেয়। কিছুদিন পর হল রেইডের সময় পুলিশ ক্যাপটি দেখতে পেয়ে আশপাশের রুমগুলোর বাসিন্দাদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়।
ওই সময় আমি ও আমার রুমমেট গ্রামের বাড়িতে। রমনা থানায় যে আমাদের নামে মামলা হয়েছে, জানতাম না। একদিন স্থানীয় থানার পুলিশ গ্রামের বাড়িতে হানা দেয়। পরিবারের সদস্যরা কিংকর্তব্যবিমূঢ়; আমি কোনো রকম পালিয়ে ঢাকায় চলে আসি। পুলিশে কর্মরত হলের সাবেক ছাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। মিন্টো রোডের বর্তমান ডিবি কার্যালয়ে তখন ছিল ডিএমপি ডিসি (সাউথ) দপ্তর; ডিসি এম. মমিনউল্লাহ পাটোয়ারী। বললেন, তোমরা যে অপরাধী না, সেটা বুঝতে পেরেছি। কোনো অপরাধী এখানে স্বেচ্ছায় আসে না। কিন্তু রমনা থানার ওসির সঙ্গে কথা বলে জানালেন, মামলাটির চার্জশিট হয়ে গেছে। এখন কোর্ট থেকে জামিন নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। পরামর্শ দিলেন হলের প্রভোস্টের সহযোগিতা নিয়ে আদালতে গিয়ে জামিন চাইতে। আমরা হতাশ; হাতে উকিল ধরার টাকাও নেই।
প্রভোস্ট ড. ফায়েজের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিস্তারিত বললাম। তিনি ছিলেন চেইন স্মোকার। হাতের সিগারেট ফেলে দিয়ে আমাদের কথা শুনলেন। তাঁর কথামতো পরদিন ১১টায় মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগে গেলাম। তিনি ক্লাস থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, ‘গাড়িতে ওঠো।’ মনে পড়ে, স্যারের ভক্সওয়াগন টাইপের গাড়িতে আমরা জজকোর্ট এলাকায় যাচ্ছি। তিনি সিগারেট ফুঁকছেন আর আমাদের সান্ত্বনা দিয়ে চলেছেন।
আমাদের আইনজীবী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রনেতা আবেদ রাজা। অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে দাঁড়ালাম। আমি রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও মহিউদ্দিন ইতিহাস বিভাগের। অ্যাডভোকেট রাজার উপস্থাপনা আর প্রভোস্ট মহোদয়ের উপস্থিতির কারণে ১০ হাজার টাকার জামানতে আমাদের জামিন হলো। কোর্ট থেকে বেরিয়ে ফায়েজ স্যার অ্যাডভোকেট রাজার হাতে জোর করে ৫০০ টাকা এবং আমাদের দু’জনকে ৪০০ টাকা দিয়ে বললেন, ‘তোমরা অনেক কষ্ট করেছ, কিছু খেয়ে নিও।’ স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে আমরা অভিভূত, বাকরুদ্ধ!
মামলাটি চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হতে হতে আমি বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উত্তরবঙ্গের এক জেলায় সহকারী কমিশনার ও তৃতীয় শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে যোগদান করি। ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরিরত অবস্থায়ও আমাকে দু-একবার ঢাকার জজকোর্টে হাজিরা দিতে হয়েছিল।
১৯৯৭ সালে আমি তরুণ সহকারী সচিব; আজিমপুর কোয়ার্টারে বসবাস। এক ছুটির দিনে সস্ত্রীক হেঁটে নিউমার্কেটে যাচ্ছি। ট্রাফিক সিগন্যালে হঠাৎ গাড়ির গ্লাস নামিয়ে ফয়েজ স্যার বললেন, ‘এই মান্নান, এসো তোমাদের লিফট দিই।’ আমরা সামান্য পথ হেঁটেই যেতে চাইলাম; কিন্তু তিনি মানলেন না। আমার স্ত্রী বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছিলেন, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানও এমন অনাড়ম্বর হতে পারেন!
ওয়ান ইলভেন সরকারের সময়, ২০০৮ সালে চাঁদপুরের এডিসি থেকে আমার পদায়ন রাজউকের পরিচালক হিসেবে। একদিন এক তরুণী আমার কক্ষে প্রবেশ করে জানালেন, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পারিবারিক একটা প্লটের মালিকানা ও নামজারি জটিলতা নিয়ে অনেক দিন ধরে ঘুরছেন। কাজটা আমার নয়, এস্টেট শাখার দায়িত্বে; তবুও সেই তরুণীর ফোনে উপাচার্যের সঙ্গে কথা বলার আগ্রহ প্রকাশ করি। কারণ ওই পদে আর কেউ নন, ফায়েজ স্যার।
পরিচয় পেয়ে তিনি ভীষণ আনন্দিত হলেন, আমার ও পরিবারের জন্য আশীর্বাদ করে বললেন, ‘তুমি একটু দেখো, জরুরি পারিবারিক বিষয়।’ কাজটি ছিল জটিল; কিন্তু আমার সার্বক্ষণিক তাগাদায় এক পর্যায়ে সম্পন্ন হয়। ব্যক্তিগত কাজেও কখনও আমি এতটা সিরিয়াস হইনি। কারণ মনের গহিনে ভেবেছিলাম, ফায়েজ স্যারের ঋণ শোধ করার এটাই সুযোগ।
ফায়েজ স্যার এমন সময় ইউজিসির দায়িত্ব নিলেন, যখন বিভিন্ন পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে অব্যবস্থাপনা, নৈরাজ্য, সার্টিফিকেট বাণিজ্য রমরমা। উচ্চশিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের দুঃসময় চলছে। অধ্যাপক ফায়েজ তাঁর মেধা ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবেন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন উপযুক্ত ব্যক্তিকেই নেতা হিসেবে পেয়েছে।