বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আন্দোলন কতটা যৌক্তিক
Share on:
ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ। শিক্ষার্থীরা জিম্মি। সারা দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আন্দোলন চলছে। এটি অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রত্যাশিত। যে ক্ষতি হচ্ছে, তা পুষিয়ে নেওয়া সহজ হবে না। এই আন্দোলন নিয়ে নানা মহলে চলছে তীব্র আলোচনা-সমালোচনা। অনেকেই এই আন্দোলনের যৌক্তিকতা খুঁজে পাচ্ছেন না। ফলে শিক্ষক, ছাত্র, সাংবাদিক, সরকারি পেশাজীবীদের সমালোচনার মুখে পরছেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শিক্ষকদের আন্দোলন নিয়ে রীতিমতো ট্রল হচ্ছে। একজন শিক্ষক হিসেবে যেমন লজ্জিত হচ্ছি, সমাজের নানান পেশার বিবেকবান মানুষও তেমনি শিক্ষকদের প্রতি এই নেতিবাচক মনোভাবে লজ্জিত হচ্ছেন। কিন্তু কেন একটি দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষক একযোগে সর্বাত্মক কর্মবিরতিতে গেলেন? এই লেখায় এ প্রশ্নের কিছু উত্তর খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
প্রথমেই শিক্ষক কমিউনিটির একজন সদস্য হিসেবে আমি শিক্ষার্থীদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করছি। সর্বজনীন পেনশন স্কিমের ‘প্রত্যয় স্কিম’টি নিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আপত্তি উঠেছে।
শিক্ষকমহল মনে করছেন, এটি বৈষম্যমূলক ও অবমাননাকর। এ বিষয়ে শিক্ষকেরা প্রথমেই এ চূড়ান্ত আন্দোলনে যাননি। তাঁরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে উদ্বেগগুলো তুলে ধরার পরও কর্তৃপক্ষ কর্ণপাত করেননি। শেষমেশ কোনো উপায়ান্তর না দেখে তাঁরা এ চূড়ান্ত আন্দোলনে নেমেছেন। এই আন্দোলনের যৌক্তিকতা খুঁজতে গেলে শুধু প্রত্যয় স্কিম দিয়ে বিচার করলে ভুল হবে। একটু আগে ফিরে যেতে হবে।
শিক্ষকদের প্রতি নানা সময় অবনমনকর মানসিকতার কারণে সৃষ্ট ক্ষোভের এটি একটি বহিঃপ্রকাশ। দীর্ঘদিন থেকে শিক্ষকমহল একটি স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের জোরালো দাবি করে আসছিলেন। এ ব্যাপারে সরকারের ওপরমহল থেকে মোটামুটি আশ্বাস পাওয়া গেলেও ২০১৫ সালের অষ্টম জাতীয় পে স্কেলে তার সম্পূর্ণ বিপরীত ঘটনা ঘটলে শিক্ষকমহলে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়।
ওই পে স্কেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের (অধ্যাপক) গ্রেড এক ধাপ পিছিয়ে দেওয়া হয়। ফলে শিক্ষায় ও মেধায় এগিয়ে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা এটা মেনে নেননি। তীব্র শিক্ষক আন্দোলনের মুখে সরকার অধ্যাপকদের জন্য তিনটি গ্রেড করেন, যেখানে প্রথম গ্রেডে অধ্যাপকদের মাত্র ২৫ শতাংশ যেতে পারবেন। পাশাপাশি নতুন একটি ‘সুপার গ্রেড’ চালু করেন, যে গ্রেডে শিক্ষকেরা যেতে পারবেন না। শিক্ষকসমাজ সেটি নিয়ে মনঃক্ষুণ্ন হলেও মেনে নিয়েছেন।
শিক্ষকেরা অবসরের সময় সেশন বেনিফিট বলে একটি সুবিধা পেতেন, জন্মসূত্রে চাকরির মেয়াদ যেদিনই পূর্ণ হোক না কেন, সেশনের শেষ দিন ৩০ জুন পর্যন্ত চাকরি করতে পারতেন। হঠাৎ সেটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এখন যেদিনই ৬৫ বছর পূর্ণ হবে, পরদিন থেকেই অবসর।
পিএইচডি শেষে যোগদান করলে আগে বিশেষ বর্ধিত বেতন সুবিধা দেওয়া হতো, সেটিও আর নেই। শিক্ষকদের এমনিতেই তুলনামূলক সুযোগ-সুবিধা কম। তারপরে এই ছোট ছোট সুযোগ-সুবিধা দিনে দিনে কর্তন করা শুরু হয়। শিক্ষকেরা সেটি নিয়েও আপত্তি জানাননি।
শেষে, প্রত্যয় স্কিমের ঘোষণা এলে শিক্ষকেরা সেটি নিয়ে সরব হন এবং তীব্র বিরোধিতা করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, সর্বজনীন পেনশন স্কিম শুধু যাঁরা কোনো পেনশন-ব্যবস্থার মধ্যে নেই, তাঁদের জন্য। যাঁরা পেনশন-ব্যবস্থার মধ্যে আছেন, তাঁরা এর অন্তর্ভুক্ত হবেন না। সেখানে বছর না পেরোতেই হঠাৎ স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রত্যয় স্কিমের ঘোষণা এলে শিক্ষকমহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। কারণ, যেসব সরকারি কর্মচারী এই স্কিম তৈরি করলেন, তাঁরা নিজেরাই সেই স্কিমের বাইরে থাকলেন।
বিদ্যমান পেনশন স্কিমের অধীন যাঁরা একই সুবিধাদি পেতেন, নতুন স্কিমে তাঁদের একই স্কিমের অন্তর্ভুক্ত করা হলে সেটি নিয়ে বৈষম্যের কথা হয়তো উঠত না। যেখানে বেতন স্কেল সবার জন্য একসঙ্গে কার্যকর হয়, সেখানে সরকারি কর্মচারীদের বাইরে রেখে নতুন স্কিম প্রচলন করাকে শিক্ষকেরা অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক বলে মনে করেন।
চলতি বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, আগামী জুলাই থেকে সরকারি কর্মচারীও এই পেনশন স্কিমের মধ্যে আসবেন। সরকার ঘোষণা দিয়েছে বটে, কিন্তু এখনো কোনো প্রজ্ঞাপন আসেনি। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেনশন স্কিমের কাঠামো কেমন হবে, প্রত্যয় থেকে কতটা আলাদা বা কাছাকাছি হবে, সে বিষয়ে কিছু পরিষ্কার নয়।
বিদ্যমান স্কিমের চেয়ে প্রত্যয় স্কিমে কী কী সুবিধা থাকছে না, সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে অবসরের বয়স বলা হয়েছে ৬০, যা বিদ্যমান স্কিমে ৬৫, প্রতি মাসে বেতন থেকে টাকা কাটা হবে, অবসরে এককালীন আনুতোষিক নেই, অর্জিত ছুটির বিপরীতে আর্থিক সুবিধা নেই, পেনশনের বার্ষিক বৃদ্ধি নেই, এবং বোনাস-ভাতা ইত্যাদির কথা বলা নেই।
যদিও পেনশন কর্তৃপক্ষ স্পষ্টীকরণ নোটিশে বলেছে, শিক্ষকদের জন্য ৬৫ বছর বহাল থাকবে। উল্লেখ্য, যাঁরা এই আন্দোলন করছেন, তাঁদের নিজেদের জন্য এটি করছেন না। কারণ, নতুন স্কিম কার্যকর হবে ১ জুলাই ২০২৪ সালের পর যাঁরা নতুন চাকরিতে যোগদান করবেন, তাঁদের ক্ষেত্রে। তাহলে শিক্ষকদের এই আন্দোলন কেন?
শিক্ষকেরা মনে করছেন, এই স্কিম উচ্চশিক্ষার জন্য হুমকি। এটি কার্যকর হলে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকতা পেশায় মেধাবী শিক্ষার্থীরা আগ্রহ হারাবেন। এই আশঙ্কা একেবারে অমূলক নয়। বর্তমান তরুণ প্রজন্মের শিক্ষকেরা উচ্চশিক্ষায় বিদেশ গমন করে ফিরে আসার আগ্রহ হারাচ্ছেন।
এ ছাড়া মেধাবী শিক্ষার্থীদের এখন উচ্চশিক্ষায় বিদেশ গমনের প্রবণতা অনেক বেশি। এমনকি বিসিএস পরীক্ষায় শিক্ষা ক্যাডারে পছন্দ দেওয়ার হার সবচেয়ে কম। অন্য ক্যাডারের চেয়ে এখানে সুযোগ-সুবিধা যেমন কম, তেমনি এটি অবহেলিত। সার্বিকভাবে শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীদের আগ্রহ এবং পছন্দ কমে যাওয়ার আশঙ্কা আরও বেড়ে যাবে। ভবিষ্যতে মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় বিমুখ হয়ে গেলে জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
শিক্ষা ক্ষেত্রে এই আশঙ্কা শিক্ষকসমাজ যত প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করছে, হয়তো অন্যরা সেভাবে উপলব্ধি করছে না। কিন্তু ভবিষ্যতের শিক্ষাকে বাঁচানোর দায় শুধু শিক্ষকদের নয়, বর্তমান শিক্ষার্থীদের, রাষ্ট্রের বিবেকবান, বিদ্যানুরাগী দেশপ্রেমী সব নাগরিকেরও এ ব্যাপারে ভূমিকা রাখার দায় আছে।
এটা ঠিক, শিক্ষকদের পেশাগত উৎকর্ষ এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ আছে, সমালোচনা আছে। শিক্ষকদের অতিমাত্রায় দলীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ততা, সরকার তোষণের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া, সুবিধাবাদী অবস্থান নেওয়া এই উদ্বেগের মূলে।
বিশ্বের ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই। শিক্ষা ও গবেষণার মান ক্রমান্বয়ে নিম্নগামী হচ্ছে। গ্র্যাজুয়েটদের মান কমে যাচ্ছে। এগুলো খুবই যৌক্তিক। তদুপরি, এই রাষ্ট্র সৃষ্টিতে এবং সমাজ বিনির্মাণে শিক্ষকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
রাষ্ট্র তার প্রয়োজনে নতুন নিয়ম প্রচলন করতেই পারে, তবে সেটি যদি বৈষম্যমূলক এবং দুরভিসন্ধিমূলক হয়, তার প্রতিবাদ করার যৌক্তিক অধিকার শিক্ষকদেরও থাকা উচিত।
ফরিদ খান, অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়