সম্পাদকীয় প্রকাশনার সময়: বৃহস্পতিবার ২৭, জুন ২০২৪

বিলম্বিত বোধোদয়

Share on:

দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও পাঠ্যসূচি নিয়ে ষড়যন্ত্র সর্বসাম্প্রতিক নয় বরং তা দীর্ঘ পরিসরেই চলে আসছে। বিভিন্ন সময়ে সরকারের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা একটি কুচক্রীমহল বরাবরই এই কাজে ইন্ধন দিয়ে এসেছে এবং এখনো তা রীতিমত অব্যাহতই রয়েছে।


তাদের উদ্দেশ্যই হচ্ছে দেশের পাঠ্যসূচি থেকে ইসলাম ও ইসলামী মূল্যবোধভিত্তিক সবকিছুই বাদ দিয়ে দেশকে একটি আদর্শহীন রাষ্ট্রে পরিণত করা। সে ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের জন্যই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কমিশন গঠন করে আধুনিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার নামে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় মোশরেকী ধ্যান-ধারণা ও নাস্তিক্যবাদী দর্শন স্থান দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু এতে তারা কখনোই পুরোপুরি সফল ও স্বার্থক হতে পারেনি বরং এদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের তীব্র প্রতিবাদের মুখে তারা বারবারই রীতিমত হোঁচোট খেয়েছে। এবারও সে ঘটনার পুনরাবৃত্তিই হচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে।

মূলত অতীত ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি শুরু হয়েছে  আধুনিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও বিজ্ঞানমনোষ্ক শিক্ষার নামে ধর্মীয় ও মূল্যবোধভিত্তিক শিক্ষা সংকোচনের নতুন ষড়যন্ত্র। এ ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য চিহ্নিত একটি মহলকে নতুন পাঠ্যসূচি প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়। আর এ দায়িত্ব পেয়েই এই বিশেষ মহল দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আবেগ-অনুভূতি, বোধ-বিশ^াসের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে আমাদের দেশের পাঠ্যসূচিতে ভ্রান্ত ও অভিশপ্ত ডারউইনী মতবাদসহ বিজাতীয় সংস্কৃতি, ভিন্ন ধর্মীয় আদর্শ পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করে পাঠ্যসূচি প্রণয়ন করে। পাঠ্যসূচিতে অশ্লীলতা অন্তর্ভুক্ত করার অভিযোগও ওঠে বেশ জোরালোভাবে। এমনকি ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মাদ্রাসা শিক্ষাতেও গর্হিত অনেক কিছুই অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যা ইসলামী মূল্যবোধের সাথে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। শিক্ষার্থীদের শেখানোর চেষ্টা করা হয় ‘মানুষ বানরের উত্তরসূরি’। ফলে সারাদেশেই নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। পাঠ্যসূচিতে এমনই একটি বিতর্কিত বিষয় ছিল ‘শরীফ-শরীফা’র গল্প। যা সমকামীতাকে উৎসাহিত করা হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে।

অবশ্য পাঠ্যসূচি প্রণেতারা এ অভিযোগ শুরু থেকেই অস্বীকার করে এসেছে। কিন্তু জনগণের তীব্র প্রতিবাদের মুখে সরকার এতদ্বিষয়ক একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে তেমন অগ্রগতি পরিলক্ষিত না হওয়ায় ধরে নেওয়া হয়েছিলো যে, দেশের আত্মসচেতন মানুষের তীব্র সমালোচনার মুখেও সরকার এই গল্পটি পাঠ্যসূচিতে বহালই রাখবে। আর এমন খবর গণমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়েছিল। 

তবে হালে সে অবস্থার খানিকটা পরিবর্তন হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। কারণ, গণমাধ্যমে খবর বেড়িয়েছে যে, বিতর্কিত শরীফার গল্প পাঠ্যবই থেকে বাদ দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। দেশজুড়ে তুমুল বিতর্ক শুরু হওয়ার পর শরীফার গল্পের পরিবর্তে এখানে অন্য একটি গল্প সংযোজনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে শরীফার এই গল্প বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। নতুন শিক্ষাক্রমে সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে মানুষে মানুষে সাদৃশ্য ও ভিন্নতা অধ্যায়ের এই গল্পটি শুরু থেকেই বিতর্কের জন্ম দেয়। পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও গল্পটি নিয়ে বেশ লেখালেখি শুরু হয়। ফলে সরকার ও সংশ্লিষ্টদের টনক নড়ে। যা ইতিবাচক বলেই মনে করছেন আত্মসচেতন মহল।

সম্প্রতি এক চিঠিতে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডকে (এনসিটিবি) এই নির্দেশনার কথা জানায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এনসিটিবিকে পাঠানো মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়েছে, এই গল্পের পরিবর্তে অন্য আরেকটি গল্প সংযোজন করার জন্য জেন্ডার বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে মতামত নেয়া যেতে পারে এবং সংশোধিত গল্প সংযোজন করার ব্যবস্থা নেয়ার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়। এ বিষয়ে এনসিটিবির একজন সদস্য জানিয়েছেন, আমরা মন্ত্রণালয় থেকে এসংক্রান্ত একটি চিঠি পেয়েছি। সে আলোকে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে। যা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে।

স্মরণ করা দরকার যে, চলতি বছরের শুরু থেকেই শরীফার গল্প নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে অল্পবিস্তর আলোচনা শুরু হয়। তবে গত ১৯ জানুয়ারি রাজধানীর কাকরাইলে ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সে ‘বর্তমান কারিকুলামে নতুন পাঠ্যপুস্তক: বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক সেমিনারে সৃষ্ট একটি ঘটনায় গল্পটি নিয়ে শুরু হয় তুমুল সমালোচনা। সে সেমিনারে নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে তৈরি সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের শরীফার গল্প যে কয়েকটি পৃষ্ঠায় রয়েছে, সে পৃষ্ঠাগুলো ছিঁড়ে আলোচনায় আসেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের খ-কালীন শিক্ষক আসিফ মাহতাব। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ-সংক্রান্ত একটি ভিডিও ভাইরাল হয়ে যায়। এরপর গল্পটি নিয়ে শুরু হয় বিতর্ক। পরে ২৪ জানুয়ারি ‘শরীফার গল্প’ পর্যালোচনা করার জন্য উচ্চপর্যায়ের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সেই কমিটিও শরীফার গল্প বাদ দেয়ার সুপারিশ করে প্রদিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। এরই আলোকে গল্পটি বাদ দেয়ার সুপারিশ করে মন্ত্রণালয়। বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের বিলম্বিত উপলব্ধি বলেই মনে করা হচ্ছে। 

শিক্ষা প্রতিটি জাতি রাষ্ট্রের জন্যই নিয়ামক শক্তি। তাই শিক্ষা ও কারিকুলাম প্রণয়নে কোন উদাসীন বা দায়িত্বহীনতার আশ্রয় নেওয়ার সুযোগ নেই। প্রত্যেক জাতির শিক্ষা কারিকুলাম প্রণীত হয় সেদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর বোধ-বিশ্বাস ও আবেগ-অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে। কিন্তু এক্ষেত্রে আমরাই বোধহয় বিশে^র মধ্যে ব্যতিক্রম। তাই পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয় বিজাতীয় ও নাস্তিক্যবাদী দর্শন এবং আদর্শ। কিন্তু পাঠ্যসূচি থেকে শরীফার গল্প বাদ দেওয়া সরকারের একটি প্রশংসনীয় পদক্ষেপ। যদিও তা বিলম্বিত বোধদয় হিসাবেই মনে করছেন দেশের আত্মসচেতন মানুষ।

দৈনিক সংগ্রাম