বাংলাদেশে রেনেসাঁভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণ যেভাবে সম্ভব
Share on:
বাংলাদেশের সমৃদ্ধ বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যের সূচনা হয়েছিল শত শত বছর আগে। বঙ্গীয় সালতানাতের গৌরবোজ্জ্বল সময় থেকে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বঙ্গীয় অঞ্চল বরাবরই সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রাণশক্তির আলোকবর্তিকার ভূমিকা পালন করেছে। তবে বাস্তবতা হলো, এই বুদ্ধিবৃত্তিক সমৃদ্ধিকে সব সময় যেমন জনগণের কল্যাণে কাজে লাগানো যায়নি, তেমনি বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতা সব সময় বাংলাদেশিদের হাতেও ছিল না।
এ মুহূর্তে বাংলাদেশ যেসব সংকট মোকাবিলা করছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য– রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, শিক্ষানৈতিক ত্রুটি এবং মেধা পাচার বা ‘ব্রেইন ড্রেন’। অর্থনৈতিক খাতে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলেও এসব চ্যালেঞ্জ অগ্রগতির জন্য হুমকি হিসেবে থেকে গেছে। এত কিছুর মাঝেও ২০২৪ সালের জুলাইয়ে নতুন প্রজন্ম দেখিয়ে দিয়েছে, পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব। তারা ভবিষ্যতের জন্য আশার আলো জাগিয়েছে। কিন্তু অমিত এই সম্ভাবনা কেবল কার্যকরী রেনেসাঁর মাধ্যমেই প্রকৃতার্থে কাজে লাগানো যেতে পারে। এখন এমন রেনেসাঁর প্রয়োজন, যার মধ্য দিয়ে সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ ঘটবে। যে জাগরণে জাতির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস যেমন প্রতিফলিত হবে, তেমনি চলমান সময়ের প্রয়োজনীয়তাও পূরণ করা সম্ভব হবে।
বিদ্যমান বাস্তবতা
চীন ও ভারতের মতো দেশ ঔপনিবেশিকতার বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে পারলেও বাংলাদেশ নিজের অবস্থান তৈরিতে হিমশিম খাচ্ছে। শিক্ষা ব্যবস্থা এখনও ঔপনিবেশিক ধাঁচে আটকে আছে। শিক্ষা পদ্ধতিতে সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা কিংবা জীবনঘনিষ্ঠ দক্ষতার ওপর সামান্যই জোর দেওয়া হচ্ছে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ সরবরাহ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। লাখ লাখ বেকার তরুণ হতাশ হয়ে বিদেশে সুযোগ খুঁজছেন, যা ব্রেইন ড্রেন বাড়িয়ে দিচ্ছে।
দেশের শাসন ব্যবস্থা দুর্বল, নাগরিক সমাজ বিভাজিত। রাজনীতিতে প্রায়ই জাতীয় স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তিগত বা দলীয় স্বার্থ প্রাধান্য পায়। একটি ছোট শ্রেণি বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আধিপত্য বিস্তার করে আছে, যাদের সঙ্গে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সম্পর্ক ক্ষীণ। দুর্নীতি ও নৈতিক অবক্ষয় স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। এত চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বেসরকারি খাত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রেখেছে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রবৃদ্ধির হার প্রতিবেশী একাধিক দেশকেও ছাড়িয়ে গেছে। তবে ভঙ্গুর রাজনীতি ও দুর্বল অবকাঠামোর কারণে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা আসবে কিনা, এখনও নিশ্চিত নয়। বরং দুর্নীতি ও কালো টাকার হার বেড়ে ধনী-গরিবের ব্যবধান দিন দিন বাড়ছে।
বুদ্ধিবৃত্তিক রেনেসাঁর প্রয়োজনীয়তা
বাংলাদেশে অন্য সবকিছুর আগে এখন প্রয়োজন জ্ঞানভিত্তিক জাগরণ। এমন জাগরণ, যা বহু শতাব্দী ধরে চলে আসা সাংস্কৃতিক রীতিনীতি ও ধর্মীয় ঐতিহ্যকে প্রতিফলিত করে। এই পুনর্জাগরণ অবশ্যই অন্তর্ভুক্তিমূলক হতে হবে। জাতীয় বুদ্ধিবৃত্তিক কাঠামো বিনির্মাণের এই সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে যুক্ত করতে হবে। বিভিন্ন খাতেই সফল বাংলাদেশি আছে; কিন্তু সামাজিক সংহতির অভাবে অধিকাংশই কাজ করার সুযোগ পায় না। সামাজিক সংহতি ও সামষ্টিকতার ধারণা পুনরুজ্জীবনের মাধ্যমে একতা ও উদ্দেশ্যকে সংহত করতে হবে। এদেশে পারিবারিক মূল্যবোধ, উদারতা ও সরলতার দীর্ঘ ও গর্বিত ইতিহাস রয়েছে। উপযুক্ত পরিবেশ পেলে এগুলো এখনও পুনরুজ্জীবিত ও শক্তিতে রূপান্তরিত হতে পারে।
ঔপনিবেশিকতা থেকে মানসিক মুক্তি
রেনেসাঁ ইউরোপীয়দের বহু শতাব্দীর মানসিক স্থবিরতা থেকে মুক্ত করেছিল। যার ফলে তাদের অভূতপূর্ব বস্তুগত সাফল্যের দিকে নিয়ে যায়। কিন্তু নৈতিক শক্তির অভাব থাকায় কিছু নৃশংস ঘটনাও ঘটেছিল। বাংলাদেশকে এই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হবে; নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের পুনরুজ্জীবনের চেষ্টা করতে হবে। এ জন্য পদ্ধতিগত গবেষণা ও সম্মিলিত পদক্ষেপে সবাইকে সম্পৃক্ত হতে হবে। বাছাইকৃত বিশেষ দল বা গোষ্ঠী নয়; গোটা সমাজের সেবায় মনোনিবেশ করতে হবে। বিভিন্ন খাতে জাতি গঠনের বীজ বপনের মাধ্যমে টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নবজাগরণ সুনিশ্চিত হতে পারে।
পরিবর্তনের বীজ
জাতির মর্যাদা ও প্রভাব তার বুদ্ধিবৃত্তিক পুঁজি ও জাতীয় চরিত্রের মধ্য দিয়েই সূচিত হয়। ব্যক্তি ও জাতির উত্থানের ক্ষেত্রে জ্ঞানই হলো প্রাথমিক মাপকাঠি। যে মঙ্গোলরা একসময় মুসলিম জাতিকে ধ্বংস করেছিল; আবার সেই মুসলিমদের জ্ঞানের উৎকর্ষকে কাজে লাগিয়ে শেষ পর্যন্ত তারা অগ্রসরও হয়েছিল। বাংলাদেশকেও সেভাবেই বুদ্ধিজীবী নেতৃত্বের শক্তিকে স্বীকৃতি দিতে হবে। প্রাথমিকভাবে বাবা-মা ও পরে শিক্ষকরা নতুন প্রজন্মকে জ্ঞানী, আত্মবিশ্বাসী ও সহানুভূতিশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলবেন। স্কুল ও সমাজ উভয় ক্ষেত্রেই শিশুদের শিক্ষা সুনিশ্চিত করতে বিনিয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক ও জীবনঘনিষ্ঠ দক্ষতা বৃদ্ধি সামনে রেখে যদি নাগরিক সমাজকে সম্পৃক্ত করা যায় তাহলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা যেমন শক্তিশালী হবেন, তেমনি সামাজিক সংহতিও বাড়বে। যারা পরিবর্তনের মূল নায়ক তাদেরকে অবশ্যই শিক্ষা, গবেষণা বা শিল্পকলার সব শাখায় শ্রেষ্ঠত্বকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। শ্রেষ্ঠত্বের উৎকর্ষ সাধনের প্রয়াসকে জাতীয় নীতিতে পরিণত করা উচিত। তাহলে দেশের মানুষ উচ্চমাত্রার লক্ষ্য নির্ধারণ ও পরিপূর্ণতা অর্জনে আরও সচেষ্ট ও সক্রিয় হয়ে উঠবে।
প্রবাসীদের ভূমিকা
প্রবাসী বাংলাদেশিরা এই পুনর্জাগরণ প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন। পশ্চিমা দেশগুলোতে যারা শিক্ষা, পেশা ও ব্যবসায় উৎকর্ষ সাধন করেছেন, তারা দেশের ভবিষ্যতের জন্য অমূল্য সম্পদ হতে পারেন। যদিও প্রবাসী তরুণ প্রজন্ম প্রায়শ শিকড় থেকে বিচ্ছিন্নতা বোধ করে; ভালো সুযোগ তৈরি ও পরিচয়সত্তাকে জাগিয়ে তোলার মাধ্যমে তাদের কাজে লাগাতে পারে।
পুনরুজ্জীবনের কর্মপরিকল্পনা
চ্যালেঞ্জিং সময়ে দৃঢ় নেতৃত্ব প্রয়োজন। জাতির পুনরুজ্জীবন দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত প্রক্রিয়া, যার সঙ্গে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা দেশপ্রেমিক, সাহসী ও উদ্ভাবনী শক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিদের দায়িত্ববোধ নিয়েই নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। অনাগত চ্যালেঞ্জগুলো কাটিয়ে উঠতে হবে। পুনর্জাগরণের এ প্রক্রিয়া ছোট পরিসর থেকেই শুরু করতে হবে। এর পর রোল মডেলদের সামনে এনে নেটওয়ার্ক তৈরি করে এবং অর্জনগুলো উদযাপন করার মাধ্যমে চেঞ্জমেকাররা আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারে। সৃজনশীলতা ও ক্রমাগত উন্নতিতে মনোযোগ ধরে রেখে শ্রেষ্ঠত্বের সংস্কৃতি লালন করতে হবে। দেশের ভবিষ্যতের জন্য ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন, যেখানে বুদ্ধিবৃত্তি, ঐতিহ্যমণ্ডিত ইতিহাস, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সৃজনশীলতার মাধ্যমে সামাজিক কল্যাণ সুনিশ্চিত করা হবে। নৈতিক রাজনীতি, জবাবদিহিমূলক শাসন ও উচ্চমাত্রার অর্থনীতি এই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির অপরিহার্য উপাদান।
উপসংহার
বৈশ্বিক উষ্ণতা ও রাজনৈতিক বিষাক্ততা– এ দুটো বিষয় বৈশ্বিক কাঠামোর জন্য বড় ধরনের হুমকি। বাংলাদেশকে প্রাক-ঔপনিবেশিক গৌরব পুনরুদ্ধার এবং উন্নত ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করার জন্য অবশ্যই বৈশ্বিক পরিসরে চিন্তা, কৌশলগত পরিকল্পনা করতে হবে এবং স্থানীয়ভাবে এর প্রয়োগ ঘটাতে হবে। সমৃদ্ধ ও স্বনির্ভর জাতি গঠনের জন্য দেশের অনন্য পরিচয় কাজে লাগিয়ে সৃজনশীল পরিবর্তনকারীদের মৌলিকত্ব ও স্থিতিস্থাপকতা নিশ্চিত করেই কাজ করতে হবে।
অভিভাবক, শিক্ষক ও সামাজিক নেতাদের তৃণমূল পর্যায়ে আত্মবিশ্বাসী, দেশপ্রেমিক ও সুন্দর প্রজন্ম গড়ে তোলার কাজ করে যেতে হবে। শিক্ষা পদ্ধতি উন্নত হলে জনসাধারণের মাঝে বই পড়া, বিশ্লেষণ করার অভ্যাস গড়ে উঠবে; একই সঙ্গে যোগাযোগ দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে। এমনটি হলে সব নাগরিকের মধ্যে একতা ও অর্থবহ উদ্দেশ্য নির্ধারিত হবে।
অন্যান্য জাতি যেমন ঔপনিবেশিক শৃঙ্খল থেকে নিজেদের মুক্ত করেছে, তেমনি বাংলাদেশেরও বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক ও নৈতিক পুনর্জাগরণের মাধ্যমে শক্তিশালী অবস্থানে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সঠিক নেতৃত্ব ও সম্মিলিত ইচ্ছা কাজে লাগিয়ে শুধু গ্রহণকারী অবস্থানে নয়, বরং অন্যকে প্রদানকারী অবস্থানেও চলে যেতে পারে। দেশের জন্য চরম সম্মানের ও প্রাপ্তির এই বিষয়ে কাজ করার এখনই সময়।