শিক্ষা ও সংস্কৃতি প্রকাশনার সময়: সোমবার ৫, অগাস্ট ২০২৪

বাংলাদেশ যাবে কোন পথে?

Share on:

বাংলাদেশে গত কয়েক দিনের ঘটনাপ্রবাহ দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে এক নতুন বাস্তবতার মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশে একটি গণ-অভ্যুত্থান ঘটছে। এই পরিস্থিতির পটভূমি এক দিনে তৈরি হয়নি, তৈরি হয়েছে এক দশক, কমপক্ষে কয়েক বছর ধরে।


কিন্তু এখনো যাঁরা এই অগ্ন্যুৎপাতের উৎস খোঁজার জন্য গত এক মাসের ঘটনাপ্রবাহের দিকে মনোনিবেশ করে আছেন, সরকারকে আগে জনগণের ভাষা বা দেয়াললিখন পড়তে না পারার জন্য তিরস্কার করছেন, সরকারের কী করা উচিত বলে পরামর্শ দিচ্ছেন, তাঁরাও যে এখন রাজপথের ভাষা বুঝতে অপারগ, সেটা স্পষ্ট। ফলে তাঁরা এখনো যা বলছেন, ক্ষমতাসীনদের শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে ক্ষমতাসীন দল ও সরকারকে যার জন্য মৃদু তিরস্কার করছেন, তা আসলে সরকার যা করেছে-করছে, তা থেকে ভিন্ন নয়।

এসব পরামর্শ ক্ষমতাসীনদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করবে বলে মনে হয় না। কেননা যে ব্যক্তিকেন্দ্রিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেখানে সিদ্ধান্ত একক ব্যক্তির। যে গোষ্ঠীগুলো এখন শক্তি প্রয়োগ করে এবং একটি রাজনৈতিক শাসনের কুহেলিকা তৈরি করে এই ব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে পারবে, তাদের ছাড়া আর কারও কথাই সরকারপ্রধানের শোনার কারণ নেই, সম্ভাবনাও নেই।

ফলে যাঁরা এখনো এ প্রশ্নের মধ্যেই আছেন জুলাই মাসের ১৪ তারিখের আগে কী হয়েছিল, কী দাবি ছিল, তাঁরা এটা ধর্তব্যেই নিতে পারছেন না, কী বিশাল হত্যাযজ্ঞ ঘটেছে, কী ভয়াবহ নির্যাতন ঘটেছে ও ঘটছে এবং তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যে তাঁরা বছরের পর বছর ভ্রুক্ষেপ করেননি যে তাঁদের তৈরি করা বয়ান তাঁদের বৃত্তের বাইরে আর বিশ্বাসযোগ্য নেই।

চাপিয়ে দেওয়া ভয়ের সংস্কৃতির কারণে মানুষের নীরবতাকে তাঁরা ভেবেছেন সম্মতি। ক্ষমতাসীনেরাও তা-ই ভেবেছেন। বাংলাদেশের ইতিহাস এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্বৈরতান্ত্রিক তো বটেই, যৎকিঞ্চিৎ অগণতান্ত্রিক সরকারের ইতিহাস যাঁরা জানেন তাঁরা এ বিষয়ে অবগত যে ক্ষমতার কাছাকাছিরা তা-ই ভাবেন।

সব স্ফুলিঙ্গ অগ্নিকাণ্ড ঘটায় না, অগ্নিকাণ্ড ঘটার জন্য অন্য উপাদান থাকার প্রয়োজন হয়। সেটা আমি বা আপনি লক্ষ করলাম কি না, অগ্রাহ্য করলাম কি না, তা দিয়ে এর মাত্রা নির্ধারিত হয় না। অগ্নিকাণ্ড শুরু হয়ে যাওয়ার পর স্ফুলিঙ্গ কখন কীভাবে শুরু হয়েছিল সেই আলোচনা না করে দরকার এই হিসাব করা, অগ্নিকাণ্ড বিস্তারের কী কী শর্ত উপস্থিত ছিল, কেন এই শর্ত তৈরি হয়েছিল, কে বা কারা তৈরি করেছিল এবং এই আগুন কী করে নেভানো যায়।

বাংলাদেশে এক দশকের বেশি সময় ধরে যে কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরতান্ত্রিক শাসন এবং ক্লেপ্টোক্রেসি বা চৌর্যবৃত্তির অর্থনীতি তৈরি করা হয়েছে, সেটাই এই স্ফুলিঙ্গকে আগুনের শিখায় পরিণত হওয়ার শর্ত পূরণ করেছে। রাজনীতির ময়দানে আগুনের লেলিহান শিখায় সরকার ও তার বৈধ-অবৈধ বাহিনী জ্বালানি জুগিয়ে যাচ্ছে।

আক্ষরিক ও প্রতীকী অর্থে অস্ত্রের ঝনঝনানি দিয়ে, অত্যাচার-নিপীড়ন করে, আদালত-পুলিশের সাজানো মামলার নামে—ষড়যন্ত্র তত্ত্ব এবং তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতির অজুহাত দিয়ে তাকে আড়াল করা যাবে—এমন আশা কেবল তাঁরাই করতে পারেন, যাঁরা মরিয়া, যাঁরা একটা ভিন্ন বাস্তবতার মধ্যে আছেন।

এর বিপরীতে আমাদের দেখা দরকার, একটি স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণের পথগুলো কী। এক দশকের বেশি সময় ধরে সারা বিশ্বেই গণতন্ত্রের পশ্চাদপসরণ ঘটেছে। কিন্তু সেখান থেকে আবার অনেক দেশ ঘুরেও দাঁড়িয়েছে।

কী উপায়ে স্বৈরতন্ত্র পরাভূত হয়েছে, সে বিষয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনেক আলোচনা আছে। গণতন্ত্র বিষয়ে বিশ্বের যেসব প্রতিষ্ঠান গবেষণা করে তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ভ্যারাইটিস অব ডেমোক্রেসি (ভি-ডেম) ইনস্টিটিউট। ভি-ডেম ইনস্টিটিউটের ২০২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত দুই দশকে আটটি দেশ স্বৈরশাসন প্রক্রিয়া উল্টে দিতে সক্ষম হয়েছে।

বাংলাদেশে গত কয়েক দিনের ঘটনা প্রমাণ করে যে সরকারের পক্ষ থেকে যত বেশি সহিংসতা ও নির্মমতা চালানো হয়েছে, মানুষের ভেতরে তাতে কেবল ক্ষোভই বাড়েনি, তাঁরা রাজপথে সমাবেশে শামিল হয়েছেন। ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণ বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরতান্ত্রিক শাসন এবং ক্লেপ্টোক্রেটিক অর্থনৈতিক নীতি যে ক্ষোভের তৈরি করেছে, তাতে ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন স্ফুলিঙ্গের ভূমিকা পালন করেছে।

দৈনিক প্রথম আলো