বাংলাদেশে ‘মুক্ত সাংবাদিকতা’ ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ‘হত্যা মামলা‘
Share on:
সম্পাদক পরিষদ শনিবার যে বিবৃতি দিয়েছে, তাকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য একটা সতর্কবার্তা বলা যায়।
সমকালসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, পরিষদের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক স্বাক্ষরিত ওই বিবৃতিতে বলা হয়, ‘ঢালাও অভিযোগের ভিত্তিতে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলার ঘটনা’ এখনও যে ‘অব্যাহত’ আছে, তাকে সম্পাদক পরিষদ ‘দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে’ ‘প্রচলিত আইনের অপব্যবহারের শামিল’ এবং ‘অন্তর্বর্তী সরকারের স্বাধীন সাংবাদিকতার প্রতিশ্রুতিরও লঙ্ঘন’ বলে মনে করে। বিবৃতিতে এও বলা হয়, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এহেন মামলা দেওয়ার প্রবণতা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অন্তর্বর্তী সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে।
প্রতিশ্রুতির লঙ্ঘন এবং প্রচলিত আইনের অপব্যবহার একটা সরকারের ভাবমূর্তির কতটা ক্ষতির কারণ হয়, তা শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার না বুঝতে পারলে আর কে বুঝবে!
উল্লেখ্য, এ ধরনের উদ্বেগ সম্পাদক পরিষদ এ নিয়ে চতুর্থবার প্রকাশ করল। এর আগে ২২ আগস্ট একাত্তর টেলিভিশনের সাবেক সাংবাদিক শাকিল ও রুপা গ্রেপ্তার হওয়ার পর; ৩১ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে সম্পাদক পরিষদের বৈঠকের পর এবং ৩ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে পরিষদ সদস্যদের সাক্ষাৎ শেষে দেওয়া বিবৃতিতে অনুরূপ উদ্বেগ প্রকাশিত হয়। উপরন্তু একই বিষয়ে বারবার উদ্বেগ প্রকাশ করতে গিয়ে সম্পাদক পরিষদের ভাষাও ক্রমশ কঠোর হয়েছে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের সংবিধানে বাক, ব্যক্তি ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা স্বীকৃত হলেও গত ৫৩ বছরে খুব বম সময়ই আমরা সে অধিকার ভোগ করেছি। এ ক্ষেত্রে সেনাশাসন ও নির্বাচিত সরকারের আমলের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই। বিগত সরকারের সময়ে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এ অধিকার কতটা সংকুচিত ছিল, তা তো সবাই হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থানের পেছনে চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের পাশাপাশি সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাহীনতার বিরুদ্ধে জনমনের ক্ষোভও অন্যতম শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। তাই ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথ গ্রহণের পরপর যখন অন্যান্য মানবাধিকারের পাশাপাশি স্বাধীন সাংবাদিকতা নিশ্চিত করারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তখন সচেতন সব মহলের মতো সম্পাদক পরিষদও স্বস্তি প্রকাশ করেছিল।
বাস্তবে বর্তমান সরকার সমাজের সচেতন মানুষের সেই স্বস্তি ধরে রাখার বিষয়ে যত্নবান বলে মনে হচ্ছে না। ৫ আগস্ট থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শতাধিক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, যেগুলোর অধিকাংশ হত্যা মামলা, কিছু হলো চাঁদাবাজির। যা বিস্ময়কর, এ পর্যন্ত দায়েরকৃত সব হত্যা মামলার ভাষা ও ধারা প্রায় এক; অভিযুক্ত সবাই নাকি গত ১৬ জুলাই ও ৫ আগস্টের মধ্যে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডে ‘ইন্ধন’ জুগিয়েছেন। কয়েকটির এজাহার বিশ্লেষণ করে আইনজীবীরাই বলছেন, মামলাগুলোর ভিত্তি নেই বললেই চলে। অর্থাৎ মামলা গ্রহণকারী পুলিশ বা আদালত চাইলে প্রাথমিক পর্যবেক্ষণেই এগুলো বাতিল হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, মামলা বাতিল তো দূরের কথা, বরং সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে নতুন নতুন মামলা হচ্ছে।
নিঃসন্দেহে সুনির্দিষ্ট অপরাধে জড়িত কোনো সাংবাদিকের দায়মুক্তির সুযোগ নেই। আবার অন্য শাসনামলের মতো বিগত সরকারের সময়েও অনেক সাংবাদিক পেশাদারিত্ব বাদ দিয়ে এমনকি নীতিবিবর্জিত কর্মকাণ্ডেও লিপ্ত ছিলেন। তাই বলে তাদের প্রতিহিংসার শিকার বানানো আদৌ সমর্থনযোগ্য নয়। কারণ এতে আর যা হোক, স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিবেশ রক্ষা হয় না।
সম্পাদক পরিষদের প্রস্তাবমতো, প্রয়োজনে প্রেস কাউন্সিলে একটি কমিটি গঠন করে অভিযুক্ত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে তদন্ত ও অনুসন্ধান হতে পারে। সেখানে প্রেস কাউন্সিল আইনের ধারা লঙ্ঘনকারীদের সাজা হতে পারে। যদি কারও বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধ সংঘটনের আলামত পাওয়া যায়, তাদের প্রচলিত আইনে বিচারও চলতে পারে। এ প্রত্যাশা নিশ্চয় বাতুলতা হবে না– সরকার সম্পাদক পরিষদের এসব সুপারিশ দ্রুত বিবেচনায় নেবে এবং প্রতিশ্রুত স্বাধীন সাংবাদিকতা নিশ্চিত করবে।