বাংলাদেশ ব্যাংকের নেতৃত্বে যোগ্যতা ও আত্মমর্যাদাবোধের অভাব
Share on:
রবীন্দ্রনাথের এ গান পূজা পর্যায়ের হলেও এর উপপর্যায় হচ্ছে ‘বিরহ’। সেই বিরহ এখন পেয়ে বসেছে বাংলাদেশ ব্যাংককে। ডেপুটিরাসহ গভর্নর পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। এগুলোর কোনটি গৃহীত হবে আর কোনটি হবে না সেটি পরের বিষয়।
কিন্তু এদের কেউই আর নিজ পদে ফিরছেন বলে মনে হয় না। আগে যত গভর্নর বিদায় নিয়েছেন তারা সবাই কর্মকর্তাদের সহানুভূতি কিংবা কখনো অশ্রুজল দেখেছেন। কিন্তু গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদারের মতো পদস্থ আর কাউকে এ রকম অসম্মানজনক বিদায় নিতে হয়নি। তাদের অনেকেরই মান, মেধা, লেখাপড়া কিংবা ব্যক্তি-চারিত্রিক অঙ্গীকার কোনোটিই বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো একটি জ্ঞানভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যায় না। ব্যাংকসংক্রান্ত সব সূচকে গত তিন বছরে ক্রম-অধঃপতন তার প্রত্যক্ষ পরিণতি। ২০১৬ থেকে গত দুই মেয়াদের দুজন গভর্নরের কেউই এ পদের জন্য যোগ্য ছিলেন না।
প্রথমজনের দোষ নেই। জনাব কবিরকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে গভর্নর পদ দেয়া হয়েছিল। গ্রামদেশে বর না এলে কনের লগ্নভ্রষ্ট হওয়ার কলঙ্ক এড়াতে প্রতিবেশী কিঞ্চিৎ অযোগ্য কোনো ছেলেকে ডেকে এনে তাৎক্ষণিক বিয়েতে রাজি করানোর মতো ঘটনা। কিন্তু দ্বিতীয়জন যতদূর শোনা যায়, বেশ কায়দা করে দীর্ঘ সময়ে নানা চাল কষে এ পদে এসে ঢুকেছেন। তার আগমন বাস্তবায়িত করার স্বার্থে গভর্নর নিয়োগের আইনেও পরিবর্তন আনা হয়। গভর্নর কবিরের ঘাড়ে বন্দুক রেখে তার আয়ুষ্কাল দুই বছর বাড়ানোর পুরো কারসাজি যিনি করেছেন তাকে পলায়নপর অবস্থায় পদত্যাগ করতে হলো। জনাব তালুকদার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মোড়ল হওয়ার বেশ আগেই লোকে জেনে যায় যে তিনি আসছেন। একটি পদ পাওয়ার জন্য নানা চাতুরী তারাই করেন যাদের যথাযথ যোগ্যতা ও আত্মমর্যাদাবোধের অভাব রয়েছে।
সরকারের অবশ্য তাতে অসুবিধা ছিল না। তারা চাইত নিঃশর্ত আনুগত্য, যার জন্য কম যোগ্যতাসম্পন্ন আমলাদের চেয়ে ভালো আর কেউই হতে পারে না। মেধার ঘাটতি তারা লবিং দিয়ে পুষিয়ে দিতে পারেন। তাই সরকারের কাছেও মেধার বিষয়টি ছিল গৌণ। সেজন্য প্রায় সর্বত্রই একাডেমিক বিতাড়নে মহোৎসব চলেছে। আমলাতন্ত্রেও উচ্চ শিক্ষিত রয়েছেন। কিন্তু আনুগত্যের সনদে তারা অযোগ্যদের চেয়ে পেছনে পড়ে থাকেন। জনাব ফজলে কবিরকে যখন ঘুম থেকে ডেকে তুলে গভর্নর পদ দেয়া হলো তখন একজন অর্থনীতিতে ডক্টরেট সাবেক অর্থসচিব সেই পদের যোগ্য ছিলেন। তাকে সে পদে নেয়া হলো না। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সম্ভবত ড. আতিউর রহমানের পর আবার আরেকজন ডক্টরেটের সঙ্গে ‘টাগ অব ওয়্যার’-এ পড়তে চাইলেন না। কী জানি, সব কথা হয়তো তিনি শুনবেন না। তার চেয়ে সব কথা মেনে চলবেন—এমন মানুষকে গভর্নর পদে বসানো দরকার। এতে রাষ্ট্র-স্বার্থের চেয়ে রাজনৈতিক তুষ্টি সাধনের কাজটি সহজতর হয়।
গভর্নর কবির অর্থমন্ত্রী মুহিতকে হতাশ করেননি। সব অর্থমন্ত্রী চান বাংলাদেশ ব্যাংক নামক প্রতিষ্ঠানটি অর্থমন্ত্রকের অধীন একটি সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের মতো থাকুক। অর্থমন্ত্রীরা আরো চান গভর্নর সরকারি রাজনৈতিক সমর্থনপুষ্ট একদল ব্যাংকলুটেরা ধনিক গোষ্ঠী যখন যা চায় তাকে পরমার্থ করে যেন গভর্নর নীতিমালা সাজান। এ মাপকাঠিতে বিগত দুজন গভর্নর ১০-এ ১০ পেয়েছেন। কিন্তু বারোটা বাজিয়ে দিয়েছেন দেশের অর্থনীতির। বেড়েছে বেকারত্ব, উচ্চ মূল্যস্ফীতি রয়েছে অনমনীয় এবং শেষতক প্রবৃদ্ধি গেছে নেমে। এর কারণ বৈশ্বিক কভিড বা রাশিয়ার পুতিন নয়। এর কারণ ম্যাক্রো ব্যবস্থাপনা অনুধাবনের যথাযথ অধ্যয়ন তাদের ছিল না। ছিল না কোনো গবেষণাগত অভিজ্ঞতা।
তবে অভিজ্ঞ ডেপুটিদের উপদেশ নিয়ে যদিবা তারা কিছু পদক্ষেপ নিতে পারতেন সেটি নেয়ার মতো মেরুদণ্ডের উলম্বতা তাদের ছিল না। পদ কামড়ে ধরে রাখার পরমার্থ মাথায় জেঁকে বসে থাকলে সব নীতি বিসর্জন দিতে হয়। নাখালপাড়ার বণিকপতির চাপে গভর্নর কবির হোটেলে বসেই মুদ্রানীতি ঠিক করে ফেলতেন। গভর্নর তালুকদার চেয়ারে বসার হপ্তাখানেকের মধ্যে খেলাপিবান্ধব নীতিকে আরো চাঙ্গা করে বেশ নিরাপদ বোধ করলেন। এ দুজন গভর্নরের ভাগ্যে জুটেছিল ২০১৯-২৩ মেয়াদের অর্থমন্ত্রী যিনি খেলাপি ঋণের বিকৃত সংজ্ঞায়নে এক দূষিত, স্খলিত নবযুগের সূচনা করে গেছেন। যতদূর শোনা যায়, তিনি নাখালপাড়ার বণিকপতির এক দাবার গুঁটি হিসেবে এ স্থানটি পেয়েছিলেন যেন লুটেরা গোষ্ঠী সর্বত্র সুযোগ-সুবিধা পায়। কালো টাকা বা পাচার করা টাকাকে সাদা করার ক্ষেত্রেও তিনি বাজেটে ধারা সংযোজন করেন, যা অনৈতিক এবং এক পাচার-উদ্দীপক আইন।
একটি জাতীয় দৈনিক তাকে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে অযোগ্য অর্থমন্ত্রী বলে উল্লেখ করলেও কথাটি ঠিক নয়। তিনি ছিলেন সবচেয়ে বিপজ্জনক অর্থমন্ত্রী, যিনি সবচেয়ে ক্ষতি করেছেন অর্থ খাতের নৈতিকতার। লুণ্ঠন বাড়িয়েছেন। তার বিরুদ্ধেও নানা অসততার অভিযোগ উঠেছে, যা পত্রিকায় এসেছিল। পদ খাটিয়ে অঢেল সম্পদ বাড়িয়েছেন। দোষ তার নয়। যে সরকার তাকে নীতি প্রণয়নের গুরুদায়িত্ব দিয়েছে তাদের ওপর এর দায় বর্তায়। এ জাতীয় একজন অপরিণামদর্শী অর্থমন্ত্রী পেয়েছিলেন দুজন অনুগত গভর্নর যাদের আন্তরিক প্রশ্রয়ে ব্যাংক খাতের লুণ্ঠনকর্ম নিরাপত্তা পেয়েছে। এজন্যই গভর্নরের মেরুদণ্ড ও যোগ্যতা নিয়ে দেশে দেশে এত কথা। এত যাচাই। বাংলাদেশের ইতিহাসেও যাচাই ও যোগ্যতার বিষয়টি সব আমলেই বিচক্ষণতার সঙ্গে পালন করা হয়েছে। তবে তার ব্যত্যয় ঘটেছে ২০১৬ থেকে।
অধ্যাপক রেহমান সোবহান গত ৭ জুলাইয়ে এক ব্যাংক খাতবিষয়ক সেমিনারে বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের, মতো প্রতিষ্ঠানের গভর্নর হিসেবে আমরা পেয়েছিলাম ড. ফরাসউদ্দিন, ড. ফখরুদ্দীন আহমদ, ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের মতো মানুষকে। সে নিয়োগ পর্যন্ত ধারাটি ঠিক ছিল। কিন্তু এরপর হঠাৎ করে এ ধারার বিচ্যুতি ঘটিয়ে যে ধারার নিয়োগ শুরু করা হলো তা ব্যাংক খাতের জন্য ভালো ফল বয়ে আনেনি। অধ্যাপক সোবহান অতি ভদ্র মানুষ। আমাদের মতো এত তিক্ত ভাষায় কথা না বললেও বুঝিয়ে দিয়েছেন গভর্নর নিয়োগে আওয়ামী লীগ সরকারের আরো সতর্ক ও গুণগ্রাহী হওয়ার প্রয়োজন ছিল। শুধু আনুগত্যের সন্ধানই এখানে যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকে সব উচ্চ পদে নিয়োগের শর্তাবলি হিসেবে শিক্ষাগত যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, গবেষণা প্রভৃতির স্পষ্ট উল্লেখ থাকলেও একমাত্র গভর্নরের নিয়োগের কোনো যোগ্যতাগত শর্তের উল্লেখ নেই। তাই অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব থাকাকালীনই কেউ কেউ ঠিক করে ফেলেন কতদিনে গভর্নর হবেন। পৃথিবীর কোথাও এটি হয় না। অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম কাজ এ গভর্নর নিয়োগের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ঠিক করা। যুক্তরাজ্যের ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের গভর্নর নিয়োগ দেয়ার আগে আন্তর্জাতিকভাবে খোঁজা হয় কে ভালো হতে পারেন। জাতি, ধর্ম ও নাগরিকত্বের কোনো তোয়াক্কা না করে শুধুই দেখা হয় মুদ্রা অর্থনীতিতে কী তার জ্ঞান, ডিগ্রি, গবেষণা ও প্রভাব। এভাবেই তারা কানাডার নাগরিক ড. মার্ক কার্নিকে ডেকে এনে গভর্নর বানিয়েছিল ২০১৩-২০ পর্যন্ত।
ব্রিটেনে তখন আরো অনেক অর্থনীতিবিদ ছিলেন। কিন্তু সরকার পেতে চেয়েছে ‘বেস্ট অব দ্য বেস্ট’। এটুকু মেধাসম্মান ও গুণগ্রাহিতা না থাকলে একটি জাতি রাতারাতি ‘স্মার্ট’ হতে পারে না। হার্ভার্ড ও অক্সফোর্ড গ্র্যাজুয়েট কার্নি ছিলেন অন্যতম সফল গভর্নর। এর আগে ২০০৩-১৩ মেয়াদে গভর্নর ছিলেন লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের অধ্যাপক মিরভিন কিং, যিনি তার জ্ঞানবলে ২০০৭-০৯-এর আর্থিক সংকট ও বিশ্বমন্দা থেকে ব্রিটিশ অর্থনীতিকে উদ্ধার করেন। আমাদের দুজন গভর্নর সুদহার ও বিনিময় হারের খেলাধুলা বুঝতে না পেরে, খেলাপি ঋণ বাড়িয়ে, ডলার সংকটকে মন্দ থেকে মন্দতর করে বিদায় নিলেন। এজন্যই পৃথিবীতে যোগ্যতার প্রশ্নটি আসে। চাতুর্য বা লবিং বিদ্যা দিয়ে ‘ডি গ্রেড’ ঢাকা যায় না।
ব্যাংক খাতের এ অধঃপতনের হাওয়া লেগেছে জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে, যা ২০১৯-এর প্রায় শতকরা ৮ ভাগ থেকে নেমে এখন প্রায় সাড়ে ৫ ভাগে ঠেকেছে। ২০০৯ সালের প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ এখন বাড়তে বাড়তে খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবেই প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা। কিন্তু রোগাক্রান্ত বা মন্দ ঋণের পরিমাণ প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকা, যা সমস্ত প্রদত্ত ঋণের প্রায় এক-চতুর্থাংশ। উন্নয়নের ধারা যদি এতই প্রবল হতো তাহলে তার পাশাপাশি খেলাপির আনুপাতিক পরিমাণ অবশ্যই কমে আসার কথা। কিন্তু খেলাপি ঋণের প্রবল উত্থান উন্নয়নগাথার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। মনে হচ্ছে ধনকুবেররা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে শুধু লোকসান মেনে নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন। আসলে ঋণ প্রশাসন বলে কিছু নেই। সেজন্য জিডিপির অংশ হিসেবে ব্যক্তি বিনিয়োগ বাড়ছে না। এতে প্রবৃদ্ধি কমছে। এতে কীভাবে এ দেশ রাতারাতি উন্নত দেশ হয়ে যাবে? প্রতিষ্ঠান ও জ্ঞানভিত্তিক নেতৃত্ব নিশ্চিত না করে কোনো দেশ উন্নত রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পায় না।
সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী জুনে সংসদে দাঁড়িয়ে বললেন খেলাপি ঋণ জিডিপির অংশ হিসেবে নাকি বাড়েনি। মুদ্রা পাচারের বিষয়টিও নাকি অপপ্রচার। প্রথমত জিডিপির অংশ হিসেবে খেলাপি ঋণ পরখ করার মাপকাঠি তিনি কবে আমদানি করলেন বোঝা গেল না। দ্বিতীয়ত, ২০১৯-২৩ কালপর্বের চৌকস হিসাববিদ অর্থমন্ত্রী খেলাপি ঋণের সংজ্ঞার বিকৃতি ঘটিয়েছেন এবং সাবেক দুই গভর্নর এ বিকৃতিকে শিরোধার্য করেছেন। পুরো ঋণের ৫ বা ১০ ভাগ দিলেই যদি খেলাপি কলঙ্ক ঘুচে যায় তাহলে সেটি কি নতুন ঋণগ্রহীতাদের জন্য ভালো চারিত্রিক শিক্ষা দেয়? নবপ্রজন্মের উদ্যোক্তারাও এখন ‘শয়তানের ত্রিভুজ’ বা ‘ডেভিল’স ‘ট্রায়াঙ্গল’কে প্রাতঃস্মরণীয় কৌশল বলে মনে করে থাকেন। ঋণখেলাপি, কর ফাঁকিদাতা ও মুদ্রা পাচারকারীরা একই গোয়ালের গরু। তারাই রচনা করেছেন বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের মতো শয়তানের ত্রিভুজের এ দুর্ভেদ্য ব্যূহ।
অর্থমন্ত্রী ও গভর্নর মিলে খেলাপি ঋণের বিকৃত সংজ্ঞায় ‘হাতিকে বেড়াল’ বলতে বাধ্য করেছেন। কিন্তু এতে যে হাতির ওজন বেড়ালতুল্য হয়ে যায় না সেটি একজন ডক্টরেট মন্ত্রীর অনুধাবনের ক্ষমতা থাকলেও তিনি জ্ঞানপাপী সেজেছেন। কারণ যেকোনো মূল্যে সরকারের সবকিছু ভালো বলার বাগ্মিতা প্রদর্শনে তাকে এ চাকরি দেয়া হয়েছে। বিদ্রোহ দমনে তিনি নাকি ব্রিটিশ মডেল অনুসরণ করবেন। গভর্নর নিয়োগে ব্রিটিশ মডেল অনুসরণ করলে বেকারত্ব আর মূল্যস্ফীতির যন্ত্রণায় ছাত্র-জনতার ভোগান্তি আর ক্ষোভ এত প্রকট হতো না। বিদ্রোহও হতো না এত দুর্দমনীয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পদস্থরা পদ হারিয়ে বা আগেভাগে পদত্যাগ করে আজ ‘সবাই গেছে বনে’। এখনই সুবর্ণ সুযোগ প্রতিষ্ঠানটিকে ঠিক করার, গভর্নরের নিয়োগনীতিকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন করার। তার পদমর্যাদা কমপক্ষে একজন মন্ত্রীর মর্যাদায় আসীন করা প্রয়োজন। যোগ্য লোক এ মর্যাদা পেলে তার জন্য জন-অসন্তোষ থাকবে না। যুক্তরাষ্ট্রে গভর্নরতুল্য ফেড চেয়ারকে যখন-তখন কংগ্রেসে ডেকে অর্থনীতির অবস্থা বা দুরবস্থার জন্য জবাবদিহিতায় আনা হয়। ফাইন্যান্স কমিটি পারলে তাকে তুলোধুনো করে ফেলে। তখনই তিনি তার প্রজ্ঞাপ্রসূত সিদ্ধান্তের পক্ষে বিতর্ক করতে পারেন।
এ সবকিছুর জন্য চাই যথাযথ যোগ্যতা। ক্রমাগত নীতি অস্থিরতায় আক্রান্ত গভর্নর তালুকদার শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশ বন্ধ করেন, যা আগে কখনো ঘটেনি। তবে খেলাপি বণিকপতিদের প্রবেশে কোনো বাধা ছিল না। কেউ বলেন তার অস্থিরতা ও অন্তঃসারশূন্যতা ক্রমেই ফাঁস হয়ে যাচ্ছে দেখে এমন কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। যদিও তার পক্ষে আমেরিকা-ব্রিটেনের দৃষ্টান্ত টানতে তারা ভোলেননি। কিন্তু নিয়োগের যোগ্যতাপ্রশ্নে তারা আমেরিকা-ব্রিটেনের উদাহরণ টানেন না। সেটা টানলে তাদের নিয়োগই বাতিল হয়ে যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংককে সর্বতোভাবে অর্থমন্ত্রকের খপ্পর থেকে মুক্ত করতে হবে। বিলুপ্ত করতে হবে ফাইন্যান্স ডিভিশন। এটির পুনর্বহালের পর ব্যাংক খাতের অবস্থা মন্দ ছাড়া ভালো হয়নি। ‘গভর্নর’ হবেন একজন সাংবিধানিক পদাধিকারী নিয়ন্ত্রক। তার নিয়োগ ও দায়বদ্ধতা থাকবে প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদীয় কমিটির কাছে। অর্থমন্ত্রী হবেন গভর্নরের সহকর্মী, কোনোভাবেই ‘বস’ নন। ব্যক্তি ঋণ আমাদের জিডিপির প্রায় শতকরা ৩৫ ভাগ। জিডিপির মাত্র এক ভাগ দখল করে এমন বিভাগের মন্ত্রী যদি শপথ নিতে পারেন তাহলে জিডিপির ৩৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করেও একজন গভর্নর কেন শপথ নেয়ার যোগ্যতা পান না? রাষ্ট্র সংস্কারের স্বার্থে এগুলোর পরিবর্তন দরকার। যুক্তরাষ্ট্রে একজন গভর্নর (ফেড চেয়ার) নিয়োগের আগে কংগ্রেসে তার জীবনী নিয়ে আদ্যোপান্ত আলোচনা ও কঠিন বিতর্ক হয়।
নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ বেন বারনানকে ফেডের প্রধান থাকার সময় ‘টাইম ম্যাগাজিন’ মন্তব্য করেছিল যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান আসলে যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্টের পরই দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি। বাংলাদেশে তার অবস্থান কেবিনেট সচিবের নিচে। এজন্যই গভর্নরের পদটিকে যোগ্যতাপ্রযুক্ত করার কোনো তাড়া সরকারের থাকে না। মেধাবী ও যোগ্য লোক রাষ্ট্রের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে। কিন্তু দলীয় ব্যবসায়িক স্বার্থে সবসময় সাড়া দিতে নাও পারেন। এ ভয় থেকেই কেন্দ্রীয় ব্যাংককে স্বায়ত্তশাসন বা গভর্নরের নিয়োগনীতি বিশ্বমানের করতে রাজনৈতিক সরকারগুলোর আগ্রহ কম। আজ বৃহত্তর অর্থনীতির স্বার্থে এ জায়গাগুলোয় পরিবর্তন আনতে হবে। তাহলে সরকার বদল হলেও গভর্নরকে দলবলসহ ‘সবাই গেছে বনে’ অবস্থায় পড়তে হবে না।