মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: মঙ্গলবার ২০, অগাস্ট ২০২৪

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার সংকট নির্মূলে করণীয়

Share on:

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় যে একটি গভীর সংকট রয়েছে, তা হলো শিক্ষার্থীদের কেবল চাকরি পাওয়ার জন্য প্রস্তুত করা হয়, কিন্তু উদ্যোক্তা হওয়ার বিষয়ে শিক্ষাদান করা হয় না।


এই সংকটের মূলে রয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোর্স কারিকুলাম, শিক্ষকদের পেশাগত ব্যাকগ্রাউন্ড এবং শিক্ষা ব্যবস্থার কাঠামো। এই সমস্যা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা নিম্নরূপ :

১. কোর্স কারিকুলামের সংকট : বাংলাদেশের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোর্স কারিকুলাম চাকরি পাওয়ার উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়। এখানে শিক্ষার্থীদের কেবল চাকরির বাজারে প্রবেশের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য এবং দক্ষতা শেখানো হয়। এই কারিকুলামগুলো সাধারণত তত্ত্বগত শিক্ষার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়, যেখানে প্র্যাকটিক্যাল দক্ষতা এবং উদ্ভাবনী চিন্তাধারার স্থান অনেক কম। ফলস্বরূপ, শিক্ষার্থীরা শুধুমাত্র চাকরি করার জন্য প্রস্তুতি নেয়, কিন্তু উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সৃজনশীলতা, ঝুঁকি গ্রহণের ক্ষমতা এবং সমস্যার সমাধান করার দক্ষতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়।

২. শিক্ষকদের পেশাগত অভিজ্ঞতা : বাংলাদেশের শিক্ষকদের বেশিরভাগই নিজ নিজ ক্ষেত্রে চাকরিজীবী। তারা কখনও উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টা করেননি বা কোনো ব্যবসা পরিচালনা করেননি। এই কারণে, তারা শিক্ষার্থীদের উদ্যোক্তা হওয়ার প্রয়োজনীয় জ্ঞান এবং দিকনির্দেশনা দিতে অক্ষম। শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষকদের কাছ থেকে যা শিখছে, তা হলো কিভাবে একজন ভালো চাকরিজীবী হওয়া যায়, কিন্তু কিভাবে একজন চাকরিদাতা হওয়া যায়, সেই বিষয়টি অনুপস্থিত।

৩. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাঠামো : বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাঠামো এমনভাবে নির্মিত যে এখানে উদ্ভাবন এবং উদ্যোগ নেওয়ার পর্যাপ্ত সুযোগ নেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সাধারণত কোনো ইনকিউবেশন সেন্টার, উদ্যোক্তা ক্লাব বা উদ্ভাবনী প্রকল্পের জন্য প্ল্যাটফর্ম নেই। শিক্ষার্থীদের ব্যবসা শুরু করার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা এবং জ্ঞান প্রদান করা হয় না। এর ফলে, তারা উদ্যোগ নেওয়ার প্রাথমিক ধারণা থেকেও বঞ্চিত থাকে।

৪. কোর্স কারিকুলাম এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাঠামো পরিবর্তনের প্রয়োজন : বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য কোর্স কারিকুলামে বিশাল পরিবর্তন আনা জরুরি। উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোকে কারিকুলামের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ:

ব্যবসা পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা : ব্যবসা পরিচালনার মৌলিক ধারণা, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া শেখানো।

ইনোভেশন ও উদ্ভাবনী চিন্তা : উদ্ভাবনী চিন্তাধারা এবং সমস্যা সমাধানের কৌশল শেখানো।

প্র্যাকটিকাল প্রশিক্ষণ: বাস্তব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা স্টার্টআপে ইন্টার্নশিপ বা প্র্যাকটিকাল প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।

উদ্যোক্তা ক্লাব : শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উদ্যোক্তা ক্লাব স্থাপন করে শিক্ষার্থীদের ব্যবসা প্রকল্পে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া।

৫. শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়ন : শিক্ষকদের উদ্যোক্তা বিষয়ক প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং তাদের পেশাগত দক্ষতা উন্নয়ন করা অত্যন্ত জরুরি। শিক্ষকদের শুধু চাকরি শেখানোর দক্ষতা থাকলেই হবে না, তাদের উচিত উদ্যোক্তা হওয়ার প্রয়োজনীয় দক্ষতা এবং জ্ঞান প্রদান করতে সক্ষম হওয়া। এ জন্য শিক্ষক প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে উদ্যোক্তা বিষয়ক কোর্স অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।

৬. শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণ এবং দক্ষতা উন্নয়ন : বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় চাকরিদাতা বা উদ্যোক্তা হওয়ার ওপর গুরুত্ব না দেওয়ার অন্যতম কারণ হলো শিক্ষকরাই মূলত চাকরিজীবী। বেশিরভাগ শিক্ষক কখনও উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টা করেননি বা ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতা অর্জন করেননি। এর ফলে তারা শিক্ষার্থীদের উদ্যোক্তা হওয়ার বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান বা উৎসাহ প্রদান করতে সক্ষম হন না। এজন্য শিক্ষকদের বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদান এবং তাদের দক্ষতা উন্নয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত। শিক্ষকদের মধ্যে ব্যবসায়িক চিন্তাভাবনা এবং উদ্যোক্তা হওয়ার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে, যাতে তারা শিক্ষার্থীদের সেই পথে উৎসাহিত করতে পারেন।

৭. নীতিগত পরিবর্তন : সরকারের শিক্ষানীতি এবং কর্মসংস্থান নীতিতে এমন পরিবর্তন আনা উচিত, যা শিক্ষার্থীদের উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য উৎসাহিত করে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা তৈরি করতে হবে উদ্যোক্তা শিক্ষা প্রদান এবং উদ্ভাবনী প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে।

৮. উদ্যোক্তা সংস্কৃতি গড়ে তোলা : শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত এমন একটি সংস্কৃতি গড়ে তোলা যেখানে উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করা হয়। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বুঝতে পারবে যে চাকরি পাওয়ার পাশাপাশি নিজের উদ্যোগে কিছু করার মাধ্যমেও সফল হওয়া যায়।

৯. উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প ও উদাহরণ : উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প ও উদাহরণ প্রদান : শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সফল উদ্যোক্তাদের গল্প এবং তাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করার জন্য বিশেষ সেশন বা সেমিনার আয়োজন করা উচিত। এই উদ্যোগ শিক্ষার্থীদের উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য অনুপ্রেরণা যোগাবে এবং তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বাড়াবে।

১০. উদ্যোক্তা সহায়ক প্রোগ্রাম এবং ইনকিউবেশন সেন্টার : শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে উদ্যোক্তা সহায়ক প্রোগ্রাম এবং ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন করা উচিত, যেখানে শিক্ষার্থীরা তাদের উদ্যোগের ধারণাগুলোকে বাস্তব রূপ দেওয়ার সুযোগ পাবে। এসব প্রোগ্রামের মাধ্যমে তারা ব্যবসায়িক পরিকল্পনা তৈরি, ফান্ডিং সংগ্রহ, বাজার গবেষণা এবং প্রতিষ্ঠান পরিচালনার মূলনীতি সম্পর্কে অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারবে।

১১. আর্থিক সহায়তা ও পরামর্শদান : শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এমন ব্যবস্থা রাখতে হবে যেখানে শিক্ষার্থীরা নিজেদের উদ্যোগে ব্যবসা শুরু করার জন্য আর্থিক সহায়তা এবং পরামর্শ পেতে পারে। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বাস্তব জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পাবে।

১২. সফল উদ্যোক্তাদের সাথে সংযোগ : শিক্ষার্থীদের সফল উদ্যোক্তাদের সাথে সংযোগ স্থাপন করা এবং তাদের সাথে মতবিনিময়ের সুযোগ প্রদান করা উচিত। এটি শিক্ষার্থীদের মধ্যে উদ্যোক্তা হওয়ার প্রতি আগ্রহ এবং প্রেরণা তৈরি করবে।

১৩. সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনের মূল্যায়ন : শিক্ষাব্যবস্থায় সৃজনশীলতা এবং উদ্ভাবনের মূল্যায়ন জরুরি। শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল ধারণা এবং উদ্যোগের প্রতি শিক্ষকদের ও প্রতিষ্ঠানের সমর্থন থাকতে হবে।

১৪. শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন : সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার পুনঃমূল্যায়ন : সবশেষে, বাংলাদেশে সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার একটি পুনঃমূল্যায়ন প্রয়োজন, যাতে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য শুধুমাত্র চাকরি পাওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে, বরং শিক্ষার্থীদের স্বাধীনভাবে নিজেদের ক্যারিয়ার গড়ার এবং উদ্যোগ গ্রহণের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়।

উপরোক্ত পদক্ষেপগুলো গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার সম্ভাবনা অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে, যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।