বাংলাদেশের রাজনৈতিক ‘যুবকম্প’ বিশ্বকে ঝাঁকুনি দিচ্ছে
Share on:
মাস ছয়েক আগেও বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দখল অটুট ছিল বলে মনে হয়েছিল। দেশের সব কটি প্রতিষ্ঠানকে হাতের মুঠোয় রাখা ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচনে টানা চতুর্থ মেয়াদে জিতেছিল।
অনেক আগে থেকেই সেখানে সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, বিরোধীদলীয় সদস্য ও অন্য সমালোচকদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলায় ফাঁসানো হচ্ছিল। কাউকে কারাগারে পাঠিয়ে, কাউকে নির্বাসিত জীবন বেছে নিতে বাধ্য করে, কাউকে তুলে নিয়ে গুম করা হচ্ছিল। ফলে সরকারের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে পারছিল না। সে সময় মনে হচ্ছিল, দেশটির কর্তৃত্ববাদ নিশ্চিতভাবে টিকে থাকবে।
কিন্তু হঠাৎ করেই সরকারি চাকরিতে ক্ষমতাসীন দলের লোকজনের চাকরি নিশ্চিতকরণে চালু করা কোটাপদ্ধতি সংস্কারে সারা দেশে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে এবং দেশজুড়ে ছাত্রদের নেতৃত্বে বিক্ষোভ শুরু হয়। বিক্ষোভ দমনে সরকারের দিক থেকে সহিংস প্রতিক্রিয়ার পথ বেছে নেওয়া হয়। তাতে কয়েক শ নিহত হন, যাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন তরুণ। অবশেষে রক্তক্ষয়ী বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে হাসিনার ১৫ বছরের শাসনের ভঙ্গুরতা প্রকাশ পেয়ে যায়।
২০২২ সালে শ্রীলঙ্কায় ‘আরাগালিয়া’খ্যাত যে গণবিক্ষোভ দেশটির রাজাপক্ষে পরিবারকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করেছিল, সেই দৃশ্যকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার দৃশ্য বাংলাদেশেও দেখা যায়। গত ৫ আগস্ট তরুণ বাংলাদেশিরা হাসিনাকে পদত্যাগ করতে এবং দেশ থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেন।
চলতি বছরে এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোকে যে যুববিদ্রোহ কাঁপিয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশের যুববিদ্রোহ সেই সিরিজের সর্বশেষতম ঘটনা।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানে তরুণদের একটি ধাক্কা দেখা যায়। সেখানে বিশেষ করে তরুণ ভোটাররা সামরিক বাহিনীকে প্রত্যাখ্যান করে কারাবন্দী সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের প্রার্থীদের সর্বোচ্চসংখ্যক ভোট দেন এবং পার্লামেন্টে ইমরানপন্থীরা সর্বোচ্চ আসন পান।
এর পরের মাসে সেনেগালে তরুণেরা তাঁদের কাছ থেকে প্রায় চুরি হতে যাওয়া গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেছিলেন। তরুণ ভোটাররা বাসিরু দিওমায়ে ফায়ে নামের একজন স্বল্পপরিচিত কর পরিদর্শককে মাত্র কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে কারাগার থেকে প্রেসিডেন্টের পদে বসিয়ে দেন।
তারপর গত জুন মাসে তরুণদের কম্পন পৌঁছে গিয়েছিল কেনিয়ায়। সেখানে প্রতিবাদকারীরা গর্বের সঙ্গে নিজেদের ‘জেন-জি’ পরিচয় দিয়ে প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম রুটোর নিত্যপণ্যের ওপর নতুন কর আরোপের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছিলেন।
বাংলাদেশের মতো কেনিয়াতে কর্তৃপক্ষ প্রাণঘাতী সহিংসতার মাধ্যমে বিক্ষোভ দমনের পথ বেছে নিয়েছিল। সরকারের সহিংস প্রতিক্রিয়ায় কয়েক ডজন মানুষ নিহত হন এবং কয়েক শ আহত হন। শেষ পর্যন্ত রুটো কর বাড়ানোর বিল প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন।
এখন সব মনোযোগ নাইজেরিয়ার দিকে। সেখানে জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয় নিয়ে বিক্ষোভ হচ্ছে। সেখানে তরুণেরা গোটা ব্যবস্থাকেই দারুণভাবে ঝাঁকুনি দিচ্ছেন।
দেখা যাচ্ছে, একটি নতুন প্রজন্ম এশিয়া ও আফ্রিকার কিছু অংশে নিজেদের তুলে ধরছে। তরুণেরা সেখানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তুলছেন এবং বিরল প্রকৃতির জোট গঠন করছেন।
এটিই প্রথম প্রজন্ম, যাঁরা ইন্টারনেটের আগের জীবন দেখেননি। তাঁরা শুধু তাঁদের কর্মসূচি ঘোষণা কিংবা রাস্তায় লাইভ স্ট্রিম প্রতিবাদ করার কাজে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করেন না, বরং নিজেদের সংগঠিত করার কাজে ও নিজেদের মধ্যে আলাপ–আলোচনা ও বিতর্ক করার কাজেও এটি ব্যবহার করছেন।
এ প্রক্রিয়ায় তাঁরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারসহ নানা ধরনের উদ্ভাবনী কৌশল বের করছেন। যখন তাঁদের রাস্তায় নামা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে, তখন তাঁরা ডিজিটাল বিক্ষোভের মাধ্যমে নতুন পরিসর তৈরি করে ফেলছেন। আর এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে সরকারগুলো ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে তা পুরোপুরি বন্ধ করার মতো প্রযুক্তি-নিপীড়নের পথ বেছে নিচ্ছে।
‘জেন-জি’খ্যাত তরুণদের এই আন্দোলনগুলো রাজনীতির প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রত্যাখ্যান করে ঐতিহ্যগত জাতিভিত্তিক ও রাজনৈতিক বিভাজনকে অতিক্রম করছে। এই আন্দোলনগুলো প্রায়ই ঐতিহ্যগত রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের সংগঠনগুলোকে এড়িয়ে যাচ্ছে।
জনতুষ্টিবাদ ও কর্তৃত্ববাদ পরিপূরক শক্তি—সাধারণভাবে এ ধারণা সমাজে প্রচলিত থাকলেও এখন আমরা স্বৈরাচারবাদকে চ্যালেঞ্জ করে, এমন জনতুষ্টিবাদও দেখতে পাচ্ছি। আমরা এমন একটি প্রজন্মকে দেখতে পাচ্ছি, যাঁরা প্রচণ্ড নির্ভীক ও আপসহীন। রাষ্ট্রীয় সহিংসতা দিয়ে তাঁদের নিরস্ত করা তো দূরের কথা, বরং তা তাদের সংকল্পকে উল্টো দৃঢ় করছে।
তবে এশিয়া ও আফ্রিকা—এ দুই বিশাল মহাদেশজুড়ে সক্রিয় হওয়া এই ‘যুবকম্প’কে অতিরঞ্জিত করে দেখানো কিংবা সাধারণীকরণ করা নিশ্চিতভাবে ভুল হবে। জেন-জি প্রতিবাদকারীরা সবাই একই চরিত্রের নন, তাঁরা সবাই তাঁদের উচ্চাকাঙ্ক্ষায় আদর্শবাদীও নন।
অন্য যেকোনো বয়সের লোকদের গ্রুপগুলোর মতো জেন-জি তরুণেরাও রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত। উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশের কথা বলা যেতে পারে। সেখানে জেন-জি তরুণদের একটি অংশ কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের লাঠিয়াল বাহিনীখ্যাত ছাত্রলীগের সদস্য, যাঁরা এই সহিংসতার জন্য অনেকাংশে দায়ী ছিলেন।
যদিও সেনেগালের প্রতিষ্ঠানগুলোয় স্থিতিস্থাপকতা থাকায় সেখানকার উত্তরণ অপেক্ষাকৃত মসৃণ ছিল, কিন্তু বাংলাদেশে সে অবস্থা নেই।
সেখানে এখনো পরিস্থিতি অনিশ্চিত রয়েছে। সহিংসতা ও নাগরিক অস্থিরতার হুমকি এখনো দেশটিতে বিদ্যমান। সেখানে আওয়ামী লীগের সদস্যদের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক প্রতিশোধমূলক হামলা এবং হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ এটিই প্রমাণ করছে যে বিজয়ের স্বাদ মানুষকে প্রতিশোধপ্রবণতার দিকে নিয়ে যেতে পারে।
তবু এসব দেশের ঘটনাবলির মধ্যে কিছু লক্ষণীয় মিল রয়েছে। ওপরে উল্লেখিত প্রতিটি দেশে ১৫ থেকে ৩৪ বছর বয়সী মানুষ সেখানকার মোট জনসংখ্যার অন্তত এক-তৃতীয়াংশ।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, সেখানে প্রতিবছর প্রায় ৬ শতাংশ শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হলেও যুবকদের অন্তত ১৫ শতাংশ বেকারত্ব মাথায় নিয়ে সংগ্রাম করছেন।
এই দেশগুলোর মধ্যে অনেক দেশেই অতিরিক্ত ঋণের বোঝায় ভারসাম্যহীন। এসব দেশ তাদের ঋণ পরিশোধে সরকারি ব্যয়ের ২০ থেকে ৬০ শতাংশ অর্থ ব্যয় করে ফেলে, যার কারণে তারা শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং জলবায়ুসংক্রান্ত জরুরি পদক্ষেপের মতো জরুরি জনঘনিষ্ঠ ব্যয় কমাতে বাধ্য হয়ে থাকে।
এটি কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়। যেসব দেশে এই বিক্ষোভগুলো হচ্ছে, সেসব দেশ বিশ্বের সবচেয়ে জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ।
যেসব দেশে তরুণদের বিক্ষোভ হয়েছে, তার প্রতিটিতে দেখা গেছে, সরকারগুলো এমন কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে, যা অধিকতর যন্ত্রণার কারণ হিসেবে তরুণদের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে।
কেনিয়ায় অসহনীয় কর আরোপ, বাংলাদেশে চাকরির অন্যায্য বরাদ্দ ও নাইজেরিয়ায় জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের মতো পদক্ষেপই এসব যুববিক্ষোভের সূত্রপাত করেছে।
আবার এ কথাও মনে রাখতে হবে, সরকারের এসব পদক্ষেপই বিক্ষোভের একমাত্র কারণ নয়; বরং এগুলো কেবল কয়েক দশক ধরে জমা হওয়া বঞ্চনা ও অভিযোগের বারুদ-বাক্সে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।
শুধু অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কাতেই তরুণেরা বিক্ষুব্ধ হয়েছেন, তা নয়; বরং তাঁদের শাসকদের লোভ, রাষ্ট্রের বর্বরতা এবং মানুষের চাওয়া–পাওয়ার প্রতি সরকারগুলোর প্রতিক্রিয়াহীনতাও এর পেছনে কাজ করেছে।
একটি পুরোনো দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থার মধ্যে গোটা সমাজব্যবস্থার বছরের পর বছর আটকে থাকা তরুণেরা মেনে নিতে পারছেন না। তাঁরা পুরোনো, সেকেলে ব্যবস্থাগুলোকে সরিয়ে তাঁদের নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপনের স্বপ্ন দেখতে চাইছেন।
কিন্তু এই পরিবর্তন সহজে আসবে না। এই পরিবর্তনের নিশ্চয়তাও নেই। এক দশক আগে তারুণ্যের বিদ্রোহ আরব বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। সেখানে একনায়কতন্ত্রের পতন ঘটেছিল, যা একটি ন্যায্য ও ন্যায়সংগত ব্যবস্থা প্রবর্তনের আশা জাগিয়েছিল। কিন্তু সেই আরব বসন্ত ব্যর্থ হয়েছে।
ব্যর্থতা এড়াতে এই মুহূর্তে যে সুযোগ তৈরি হয়েছে, তা দ্রুত কাজে লাগাতে হবে এবং সম্ভাব্য সব বিপদ মাথায় রেখে সাবধানে তরুণদের পা ফেলতে হবে।