মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: রবিবার ১৮, অগাস্ট ২০২৪

বাংলাদেশের পথেই হাটছে পাকিস্তান

Share on:

বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থান সফল হয়েছে। এরপর কি পাকিস্তান? পাকিস্তান যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, নিরাপত্তাসহ বহু সংকটের মুখোমুখি, এর পরিণামে সেখানে ‘বর্ষা বিপ্লব’ হবে কী? গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়েছেন।


২০২২ সালের এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর পাকিস্তানে রাষ্ট্র ও সমাজের ব্যবধান উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। এর কারণ দেশের ভেঙে পড়া অর্থনীতি ও ধ্বংসপ্রাপ্ত শাসন ব্যবস্থা। জনসাধারণ ক্ষুব্ধ; কারণ দু’মুঠো খাবারের সংস্থান করতে তাদের সংগ্রাম করতে হচ্ছে।

বর্তমানে পাকিস্তান দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। দেশটিতে মুদ্রাস্ফীতির হার সবচেয়ে বেশি। এখানে ১ কোটি ২৫ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে এবং আরও সাড়ে ৯ কোটি মানুষ দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করছে। পাকিস্তান অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুসারে, প্রায় ৪৫ লাখ যুবক এখানে বেকার। এদেশে বেকারত্বের হার ১১ শতাংশ, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি। গত দুই বছরে উন্নত কর্মসংস্থানের সুযোগ ও জীবনমানের জন্য ১৬ লাখ পাকিস্তানি দেশে ছেড়ে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে পাড়ি জমিয়েছে।

তাছাড়া আফগানিস্তান ও ইরানের সঙ্গে পাকিস্তান সীমান্তে বেড়া দেওয়া এবং ইন্টারনেট ফায়ারওয়াল স্থাপনের ফলে অনানুষ্ঠানিক ও ফ্রিল্যান্স খাতে চাকরিহীন তরুণের সংখ্যা আরও বাড়বে। অশান্ত খাইবার পাখতুনখোয়া ও বেলুচিস্তানে পশতুন তাহাফুজ আন্দোলনের মঞ্জুর পশতিন ও বালুচ ইয়াকজেহতি কমিটির মাহরং বালুচের মতো মিলেনিয়াল তথা ১৯৯০ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে জন্ম নেওয়া বিক্ষুব্ধ তরুণদের স্বপ্ন ধারণ করেছে, যারা রাজ্যের নৃশংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চালিয়ে যাচ্ছে। তাহলে পাকিস্তানে জেন-জি বিপ্লব কি ঘটতে যাচ্ছে? পুরোপুরি নিশ্চিত নয়। বাংলাদেশের পরিস্থিতির সঙ্গে কিছুটা মিলে গেলেও নিচের চার কারণে পাকিস্তানে বিপ্লবের সম্ভাবনা ক্ষীণ।

প্রথমত, কিছু লোক মনে করে, পাকিস্তান একটি আগুনের বাকসের মতো; যার শিখা বাংলাদেশের মতো দেশজুড়ে প্রতিবাদের আগুন জ্বালিয়ে দেবে। যাই হোক, বাংলাদেশের সমধর্মী ধারা আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও ক্ষোভকে একটি জাতীয় আন্দোলনে রূপ দিয়েছে। অন্যদিকে, পাকিস্তানের জাতিগত ভিন্নতা ও খণ্ডিত রাজনৈতিক দৃশ্যপট দেশব্যাপী বিদ্রোহকে দুর্বল করে দেয়। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ টানা ১৫ বছর দেশ শাসন করেছে। টানা চারবার হাসিনা জয় ছিনিয়ে নিয়েছেন। একই সময় পাকিস্তানে তিনটি ভিন্ন দল শাসন করেছে। গত দুই দশকে পাকিস্তানে কোনো সরকারই পরপর দুটি নির্বাচনে জয়ী হয়নি। বরং বিভক্ত জনগণের সিদ্ধান্ত ও নড়বড়ে সংসদের কারণে জোট সরকারই পাকিস্তান শাসন করেছে। আদতে সাবেক গুপ্তচর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) ফয়েজ হামিদের সহায়তায় পাকিস্তানকে কথিত একদলীয় শাসনের দিকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। তাতে ২০২২ সালের এপ্রিলে সংসদের অনাস্থা ভোটে ইমরান খানের ক্ষমতাচ্যুতের ঘটনার সূচনা ঘটে। পাকিস্তান যদি কখনও কোনো বিপ্লবের সন্নিকটে আসে, তা ছিল গত বছরের ৯ মে; যাকে সামরিক বাহিনী নির্মমভাবে চূর্ণ করে দিয়েছিল। এই সময়ে ৯ মের পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা খুবই কম।

তৃতীয়ত, হাসিনা বিরোধীদের জেলে বন্দি করেছিলেন এবং শক্ত হাতে একচ্ছত্রভাবে দেশ শাসন করেছিলেন। অন্যদিকে, পাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো বর্তমানে থিতু রয়েছে। তাই জটিল রাজনৈতিক মতপার্থক্য, অমীমাংসিত নির্বাচনী বিরোধ ও সিংহাসন দখলের অসীম খেলা সত্ত্বেও পাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো বিদ্যমান ব্যবস্থায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছে এবং আইনি ও রাজনৈতিক উপায়ে সমাধান খুঁজছে।

অবশেষে পাকিস্তানকে বাংলাদেশ থেকে আলাদা করে তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চলক হলো দেশটির শক্তিশালী সামরিক ব্যবস্থা। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়ে ঢাকাগামী জেন-জি বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালাতে অস্বীকার করলে হাসিনার শাসন তাসের ঘরের মতো ধসে পড়ে। তার বিপরীতে পাকিস্তানি সামরিক সংস্থা পিএমএলএনের নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের শক্ত সমর্থক। হুসেইন হাক্কানির মতে, ‘একটি বেসামরিক মুখোশে একটি সামরিক শাসন।’

দৈনিক সমকাল