মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: শনিবার ১৭, অগাস্ট ২০২৪

বাংলাদেশের গণ-অভ্যুত্থান থেকে ভারতের শেখার আছে

Share on:

বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটানো গণ-আন্দোলন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং প্রতিবেশী ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পাঠ নির্দেশ করে।


এ অভ্যুত্থান শান্তিপূর্ণভাবে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর বর্বর আক্রমণের কারণে বেগ পেলেও এতে আগুনে ঘির মতো কাজ করেছে আওয়ামী লীগ সরকারের দমন-পীড়ন ও ক্রমবর্ধমান অগণতান্ত্রিক নীতি। একই সঙ্গে জনগণের অসন্তোষের অন্তর্নিহিত কারণগুলোও এতে ঘৃতাহুতির মতো কাজ করেছে, যেগুলো তেমনভাবে আলোচনায় আসেনি।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রাথমিক ভিত্তি ছিল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের যোদ্ধা ও তাদের উত্তরাধিকারীদের জন্য সরকারি চাকরিতে সংরক্ষিত ৩০ শতাংশ কোটা বিলুপ্তি। যদিও শেখ হাসিনা সরকারের এক নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে ২০১৮ সালে সব ধরনের কোটা বিলুপ্ত করা হয়েছিল। এ বছর জুনে উচ্চ আদালত কোটা পুনর্বহাল করলে ব্যাপক বিক্ষোভের সূচনা হয়। এক মাস পর আন্দোলনের তীব্রতার মুখে উচ্চ আদালত নিম্ন আদালতের রায় বাতিল করে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৫ শতাংশে নামিয়ে আনেন এবং ৯৩ শতাংশ সরকারি চাকরির পদ মেধার ভিত্তিতে পূরণের আদেশ দেন।

তবে ততদিনে তৎকালীন সরকারের বর্বরোচিত দমন-পীড়নে তিন শতাধিক আন্দোলনকারীর মৃত্যু ঘটে। এর মধ্যে ছিলেন আন্দোলনের সক্রিয় শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। তার মৃত্যু জনরোষ বাড়িয়ে তোলে এবং প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবির উত্থান ঘটায়। এরপর ৫ আগস্ট তীব্র আন্দোলনের মুখে এবং সামরিক বাহিনী আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে তার নেয়া কঠোর সিদ্ধান্তকে নাকচ করে দিলে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেন এবং ভারত পালিয়ে যান।

নির্মম পরিহাস এই যে, তিনি বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা যিনি একসময় সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো ছাত্রনেতা এবং গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনকর্মী ছিলেন। হাসিনা টানা চারবার প্রধানমন্ত্রী পদে থাকাকালীন বাংলাদেশে অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক রূপান্তর নিয়ে এসেছেন। আর এটি সম্ভব হয়েছিল অভাবনীয় গার্মেন্ট রফতানি প্রবৃদ্ধি এবং গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো বিনিয়োগের কারণে যা নারীদের কর্মসংস্থান বাড়াতেও সহায়ক হয়েছিল। এছাড়া গত দুই দশকে দারিদ্র্যের হার অর্ধেকে কমে এসেছে এবং ২০১৯ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি (বর্তমান মার্কিন ডলার অনুযায়ী) ভারতের তুলনায় অতিক্রম করেছে। দেশটি ২০২৬ সালে “এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পথে রয়েছে।

কিন্তু হাসিনার কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা তার অর্থনৈতিক সাফল্যকে খাটো করে ফেলেছে। সন্দেহভাজন চরমপন্থীসহ আইনজীবী, সাংবাদিক এবং আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার কর্মীদের আটক এবং গুম প্রভৃতি কাজের মাধ্যমে ত্রাসের পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছে। সরকারের এসব কাজ ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় আরো বেড়ে গিয়েছিল।

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংসের পর ২০২৪ সালের নির্বাচন নিছকই লোক দেখানো ছিল। বেশির ভাগ বিরোধী দল ওই নির্বাচন বয়কট করেছিল বা তাদের কার্যকরভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণে বাধা দেয়া হয়েছিল। সে সময় হাসিনা ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয়ী হন এবং টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করেন। যদিও এ সরকারের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও ভারত ও অন্যান্য বড় ক্ষমতাধর রাষ্ট্র তৎক্ষণাৎ এ সরকারকে স্বীকৃতি দেয়।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অস্থিরতাও গণ-আন্দোলনের পেছনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল। গত দশক ধরে ক্রমবর্ধমান অসমতা ও বেকারত্ব এবং নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি শেখ হাসিনার স্বজনপ্রীতির রাজনীতি ও তার শাসনামলে ব্যাপক দুর্নীতি ঘিরে জমে থাকা জনগণের ক্ষোভকে আরো তীব্র করেছে। উপরন্তু মুখের জোরে এসব সমস্যা অস্বীকার ও সমাধান না করার নীতি জনরোষ আরো বাড়িয়ে তোলে

বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, কেবল জিডিপির উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও শক্তিশালী রফতানি সামগ্রিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পারে না। যখন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুবিধা ন্যায্যভাবে বণ্টন হয় না, বেশির ভাগ নাগরিকের চোখে উন্নতি ধরা দেয় না। এমনকি আরো খারাপ অবস্থায় পড়ে যান তারা। তাদের প্রত্যাশাগুলো হতাশায় পরিণত হয়। তখন তারা সম্পদ ও আয়ের ন্যায্য বণ্টনের প্রয়োজন অনুভব করে।

আরেকটি শিক্ষণীয় দিক হলো, কর্মসংস্থান অতীব জরুরি। তরুণদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি ন্যায্য বেতন ও উন্নত কর্মপরিবেশ তৈরিও গুরুত্বপূর্ণ। যখন অধিকাংশ মানুষের আয় স্থিতিশীল থাকে বা কমে যায়, তখন জনগণ সরকারের অর্থনৈতিক গতিশীলতার বর্ণনায় আস্থাহীন হয়ে পড়ে।

আয়, সম্পদ ও সুযোগের সুস্পষ্ট বৈষম্য বিবেচনায় রেখে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরকারের এসব পাঠ থেকে শিক্ষা নিয়ে মনোযোগী হওয়া উচিত। এটিই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। তবে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক গণ-অভ্যুত্থান আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিদেশী পর্যবেক্ষকদের জন্যও একটি সতর্কবার্তা, যারা উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও বিদেশী বিনিয়োগের মাত্রা দেখে খুব বেশি প্রভাবিত হন।

দুঃখজনকভাবে, অনেক বিশ্লেষক বাংলাদেশে চলমান অর্থনৈতিক সমস্যার পেছনে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কার্যক্রমকে উপেক্ষা করেছেন। কিছু বিশ্লেষক ২০২৩ সালে বাংলাদেশ আইএমএফ থেকে যে ৪৭০ কোটি ডলারের মঞ্জুরি পায় সেটিকে অপ্রয়োজনীয় বলেছিলেন। প্রাথমিকভাবে এ মঞ্জুরি নেয়ার উদ্দেশ্য ছিল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানো, যা কভিড-১৯ মহামারী অভিঘাতে এবং বিশ্বব্যাপী খাদ্য ও জ্বালানির মূল্য বেড়ে যাওয়ায় ক্ষয় হয়েছিল। কিন্তু আইএমএফের ঋণের শর্তে ছিল ডলারের বিনিময় হারের সহজীকরণ। এটি টাকার মানের তীব্র অবমূল্যায়ন ঘটায় এবং জ্বালানি পণ্যের নতুন মূল্যনীতি নির্ধারণ করে। পক্ষান্তরে এসব মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেয়।

বাংলাদেশের বাজেট ঘাটতি ও ব্যয় কমাতে আইএমএফ চাপ সৃষ্টি করেছিল, যা মৌলিক পরিষেবা বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক কর্মসূচির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কঠোর মুদ্রানীতি গ্রহণ ও সুদহার বৃদ্ধি করেছে। এটি ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ওপর বিশাল চাপ সৃষ্টি এবং কর্মসংস্থানের সংকট আরো তীব্র করেছে। গত জুনে আইএমএফ ঋণের তৃতীয় কিস্তি ১১২ কোটি ডলার অনুমোদন করে এবং ঋণের অবশিষ্ট কিস্তিগুলো পেতে বাংলাদেশকে নতুন ৩৩টি শর্ত দেয়।

যদিও পদক্ষেপগুলো “উন্নত অর্থনীতি এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াতে করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়। কিন্তু ইতিহাস বলে এসব কাজের মাধ্যমে খুব ভালো ফলাফল পাওয়া যায় না। বরং আইএমএফের ঋণ কর্মসূচি বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক অস্থিরতা এবং জনরোষ উসকে দিয়েছে। কেনিয়া, নাইজেরিয়া ও ঘানার মতো দেশ যারা আইএমএফের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে, তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরো অস্থিতিশীল অবস্থায় পড়েছে।

বাংলাদেশের গণ-অভ্যুত্থানের সবচেয়ে প্রধান রাজনৈতিক পাঠ হলো, শেখ হাসিনার মতো স্বৈরশাসকরা দুর্দমনীয় নয়। তারা গণতান্ত্রিক প্রতিবাদ দমন করতে, মিডিয়ার মুখ বন্ধ করতে পারে, স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করতে এবং বিচার ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতে পারে, কিন্তু চিরকাল ক্ষমতায় থাকতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে এসব শাসক যত বেশি নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে, তত বেশি তারা জনগণের প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হতে বাধ্য।

শেখ হাসিনার পতন মোদি সরকারের জন্য বড় ধরনের সতর্কবার্তা, যেহেতু মোদির মধ্যেও তার মতো কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা রয়েছে। বৈশ্বিক নেতাদেরও এ থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত যে স্বল্পমেয়াদি ভূরাজনৈতিক লাভের জন্য অগণতান্ত্রিক শাসনের পক্ষ অবলম্বন করার কারণে দীর্ঘমেয়াদে বড় ধরনের মাশুল গুনতে হতে পারে।

দৈনিক বণিকবার্তা