বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামো এবং পুনর্বিবেচনা
Share on:
ধরুন বাংলাদেশের ব্যাংক খাত সুস্থ হয়ে উঠেছে, পোশাক শিল্পের রফতানি চুক্তি নবায়ন হয়েছে, বিদেশে অর্থ পাচার বন্ধ হয়েছে এবং বন্যার ক্ষয়ক্ষতি পুরোপুরি মেরামত করা গেছে। এ অবস্থায় কি আমরা মনে করব যে আমাদের অর্থনীতির সব সমস্যা দূর হয়ে গেছে?
যদিও এগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি, কিন্তু শুধু এতটুকুতেই সন্তুষ্ট থাকলে আমরা বর্তমান অর্থনৈতিক কাঠামোকে নিখুঁত বলে ধরে নেয়ার ভুল করব। এ নিবন্ধে আমরা ঠিক এ বিষয়কেই প্রশ্নের মুখোমুখি করতে চাই।
এ সমাধানগুলো যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হলেও এগুলো কেবল দেশের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের বাহ্যিক লক্ষণগুলোকেই মোকাবেলা করে। আমরা এ তাৎক্ষণিক সমস্যাগুলোর ঊর্ধ্বে গিয়ে আমাদের অর্থনীতি নিয়ে ভাবার ধরনটাকেই প্রশ্ন করতে চাই। আমাদের বক্তব্য হলো, বাংলাদেশের প্রয়োজন শুধু খণ্ডিত (পিসমিল) সমাধান নয়; বরং দরকার তার সমগ্র অর্থনৈতিক পরিকল্পনাটাকে নতুন করে ভাবা, যাতে নিশ্চিত করা যায় যে দেশের উন্নতি সাধারণ মানুষের জীবনমানও উন্নত করে।
অনেক বছর ধরে বাংলাদেশ একটা উন্নয়নের ফর্মুলা মেনে আসছে। ফর্মুলাটি মূলত কেন্দ্রীভূত ছিল কয়েকটা জিনিসের ওপর, যেমন উঁচু জিডিপি বৃদ্ধি, কম মজুরিতে তৈরি জিনিসপত্র রফতানি, ট্রিকল-ডাউন বা নিম্নমুখী অর্থনীতি (যেখানে ধনীদের থেকে গরিবদের দিকে টাকা-পয়সা গড়াবে), আর রাস্তাঘাট-ব্রিজ-কলকারখানা এসব বাড়ানো। কিন্তু এ পদ্ধতি কি সত্যিই তার কথামতো কাজ করেছে?
২০০১ সাল থেকে বাংলাদেশ গড়ে বার্ষিক ৬ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করে চলেছে এবং ভবিষ্যতে আরো উচ্চ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই জিডিপি প্রবৃদ্ধি কি সত্যিই সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়ন করছে? একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যাক, ধরুন একটি দেশের জিডিপি ১০ শতাংশ বাড়ল, কিন্তু সেই বৃদ্ধির ৯৯ শতাংশ কেবল ১ শতাংশ জনগোষ্ঠীর হাতে গেল। বাকি ৯৯ শতাংশ মানুষের আয় হয় স্থির রইল, নয়তো কমে গেল। এটা কাগজে-কলমে উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হলেও বাস্তবে সংখ্যাগরিষ্ঠের জন্য উন্নয়ন নয়। বাংলাদেশে আমরা একই ধরনের তবে কম তীব্র প্রবণতা লক্ষ করছি। জিডিপি বৃদ্ধির পাশাপাশি আয়বৈষম্যও বেড়েছে। আয়বৈষম্যের একটি সূচক জিনি ইনডেক্স, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সমান্তরালে ক্রমাগত বেড়েছে। এটি ইঙ্গিত করে যে আমাদের তথাকথিত ‘অর্থনৈতিক বিস্ময়’-এর সুফল যথাযথভাবে পৌঁছাচ্ছে না তাদের কাছে, যাদের এটি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
বাংলাদেশ তার রফতানি অর্থনীতি গড়ে তুলেছে কম মজুরির শ্রমিকদের ঘাম ঝরিয়ে। কিন্তু এ সস্তা শ্রমের ওপর নির্ভর করে প্রবৃদ্ধি অর্জন করা—এটা না ভালো, না টেকসই। কেন? কারণ এই মডেল খুবই অনিশ্চিত। যেকোনো সময় আরো কম মজুরির অন্য কোনো দেশ এসে আমাদের তৈরি পোশাক শিল্পকে টপকে যেতে পারে। ইতিহাসে এমন ঘটনা কম ঘটেনি। একসময় ব্রিটেনের বস্ত্র শিল্প ধুঁকছিল জাপানের সস্তা কাপড়ের সামনে। আর আজ? চীনের শিল্প পিছু হটছে বাংলাদেশ আর ভিয়েতনামের মতো কম খরচের দেশগুলোর কাছে। এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশ সবসময় একটা ‘তলানির দিকে দৌড়’ প্রতিযোগিতায় আটকে থাকবে, যেখানে সস্তা বিকল্পের কাছে শিল্প হারানোর ভয় লেগেই থাকবে। অন্য দেশের কম মজুরির হুমকি ছাড়াও নতুন প্রযুক্তির আগমন আর দেশে দেশে বাড়তি সুরক্ষার প্রবণতাগুলোও (যেমন ফ্রেন্ড-শোরিং বা নিয়ার-শোরিং) কম উদ্বেগের কারণ নয়।
আমাদের বর্তমান এ কৌশল আসলে কতটা কার্যকর? এ কম মজুরির অর্থনীতি তো আসলে দরিদ্র মানুষকে শোষণেরই আরেক নাম। ১৯৭০-এর দশকে হয়তো বাংলাদেশের কাছে অন্য কোনো পথ খোলা ছিল না। কিন্তু ৫০ বছর পর এসেও কি আমরা একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি? এটাকে কী করে কাম্য প্রবৃদ্ধি বলা যায় যখন বেশির ভাগ মানুষকে গরিব থাকতে হচ্ছে আর কম মজুরি নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে? আসল কথা হলো, এ কম মজুরির শিল্পের ওপর নির্ভর করে যে অর্থনৈতিক নীতি আমরা নিয়েছি, সেটা আমাদের সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিচ্ছে না। বরং এটা আমাদের ক্রমাগত অর্থনৈতিক দুর্দশার একটা চক্রে আটকে রাখছে।
‘নিচের দিকে গড়ানো অর্থনীতি’ বা ট্রিকল-ডাউন ইকোনমিকসের মূল কথা হলো, ধনীদের সুবিধা দিলে সেটা আপনা আপনি সবার কাছে ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু বাস্তবে কী ঘটছে? এ পদ্ধতিতে টাকা-পয়সা ওপরের মহলে জমা হচ্ছে, নিচে নামছে না। একটা বড় উদাহরণ দেয়া যাক, সাম্প্রতিক আওয়ামী লীগ (আ.লীগ) সরকারের আমলে যে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। বণিক বার্তা পত্রিকার খবর অনুযায়ী, আ.লীগের গত ১৫ বছরের শাসনকালে প্রায় ১৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দেশের বাইরে পাচার হয়ে গেছে। এটা আমাদের দেশের ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব পরিমাণের অর্থ পাচার।
এ ঘটনা আসলে একটা বড় ছবির ছোট্ট একটা অংশ: টাকা-পয়সা নিচের দিকে যাওয়ার বদলে ওপরের দিকেই উঠে যাচ্ছে। বাংলাদেশের অবস্থা দেখলে বোঝা যায় এটা এক ধরনের ‘স্বজনপ্রীতিমূলক পুঁজিবাদ’ (ক্রোনি ক্যাপিটালিজম)। এখানে যারা আগে থেকেই ধনী, তাদেরকেই আরো সুবিধা দেয়া হয়। আর যারা সত্যিকারের পরিশ্রম করে তারা পিছিয়ে পড়ে।
সমাজের সবচেয়ে অসহায় মানুষগুলো, বিশেষ করে যারা আর্থিকভাবে পিছিয়ে আছে তাদের সবচেয়ে বেশি দরকার ভালো শিক্ষা আর স্বাস্থ্যসেবার মতো মৌলিক সুযোগ-সুবিধা। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশ সরকার এ গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোয় খুবই কম টাকা খরচ করে। দেশটা তার মোট আয়ের মাত্র ১ দশমিক ৮ শতাংশ শিক্ষায় আর ২ শতাংশ স্বাস্থ্যে ব্যয় করে। এটা গরিব দেশগুলোর মধ্যেও সবচেয়ে কম।
এ অপর্যাপ্ত বিনিয়োগের ফলে কী হচ্ছে? নিম্নমানের শিক্ষা আর স্বাস্থ্যসেবা পেতে মানুষকে নিজের পকেট থেকে বেশি টাকা খরচ করতে হচ্ছে। ধরুন হঠাৎ করে কোনো স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিল, যেমন ডেঙ্গু জ্বর। এতে একটা গরিব পরিবার হয় আরো গরিব হয়ে যাচ্ছে, নয়তো ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ছে। শুধু তা-ই নয়, দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব আরো মারাত্মক। কম শিক্ষা আর খারাপ স্বাস্থ্য মানুষকে ভালো চাকরি পাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করছে। ফলে তারা নিজেদের ও সমাজের উন্নতিতে তেমন অবদান রাখতে পারছে না। এতে করে দেশের অর্থনীতিও সেই মানবসম্পদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, যা দারিদ্র্য কাটিয়ে ওঠার পর টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য খুবই জরুরি।
আমাদের বর্তমান অর্থনৈতিক মডেলটা ব্যর্থ হয়েছে, কারণ এটা দীর্ঘমেয়াদি, সার্বিক উন্নয়নের বদলে অল্প সময়ের লাভকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এর ফলে কী হচ্ছে? একটি ক্ষুদ্র সুবিধাভোগী গোষ্ঠী অর্থনৈতিক সুবিধার বেশির ভাগটাই হাতিয়ে নিচ্ছে। অন্যদিকে শিক্ষা আর স্বাস্থ্যে যে বিনিয়োগ করা উচিত ছিল সেটা হচ্ছে না। আর আমরা এমন একটা কৌশলের ওপর নির্ভর করছি যা টিকবে না—সেটা হলো কম মজুরি দিয়ে প্রতিযোগিতা করা।
মজার ব্যাপার হলো, বাংলাদেশ যে অবকাঠামোনির্ভর উন্নয়নের ওপর এত জোর দিচ্ছে, সেটা আসলে সমস্যাটাকে আরো বাড়িয়ে তুলছে। দেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নতির জন্য অবকাঠামো নিঃসন্দেহে প্রয়োজনীয়। কিন্তু প্রকল্পগুলো যেভাবে নির্বাচন, অর্থায়ন, পরিচালনা এবং বাস্তবায়ন করা হয়েছে, তাতে এগুলোর কার্যকারিতা অনেক কমে যাচ্ছে। গত ১৫ বছরে যত মেগা প্রকল্প হয়েছে সেগুলো দেশের বিদেশী ঋণের বোঝা বাড়িয়েছে। একই সময়ে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি খরচ বেড়েছে। এতে মধ্যবিত্তরা টালমাটাল হয়ে পড়েছে আর গরিবরা ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধির চাপে পিষ্ট হচ্ছে।
এ ত্রুটিগুলো বিবেচনা করলে আমাদের অর্থনৈতিক চিন্তাধারায় একটি মৌলিক পরিবর্তনের প্রয়োজন দেখা যায়। নতুন চিন্তাভাবনায় শুধু সম্পদ বাড়ানো নয়, সেটা ঠিকমতো ভাগ করে দেয়াটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ হওয়া উচিত। নীতিমালা এমন হওয়া দরকার যাতে বৈষম্য কমে আর সুফল সবার কাছে পৌঁছায়। এর মানে হলো, ব্যর্থ ‘নিচে-ঝরা’ (ট্রিকল-ডাউন) মডেল ছেড়ে ‘নিচ থেকে-ওপরে’ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিকে যাওয়া, যাতে বেশির ভাগ মানুষই সরাসরি উপকৃত হন। এ নতুন ভাবনার কেন্দ্রে থাকবে মানুষের দক্ষতা বাড়ানোয় বেশি বিনিয়োগ। বাংলাদেশে এখন শিক্ষা আর স্বাস্থ্যে যে টাকা খরচ হচ্ছে, তা খুবই কম। তাই এসব খাতে সরকারি খরচ অনেক বাড়ানো জরুরি।
বাংলাদেশের জন্য নতুন অর্থনৈতিক নীতি খুঁজতে গিয়ে আমাদের কিছু মৌলিক কিন্তু সাহসী প্রশ্ন নিয়ে শুরু করতে হবে। ধরুন আমরা এতদিন রাজধানীকেন্দ্রিক উন্নয়নের পথে হেঁটেছি যার ফলে সব সম্পদ আর সুযোগ-সুবিধা ঢাকাতেই জমা হয়েছে। এর ফলে কী হয়েছে? অসম প্রবৃদ্ধি আর শহরমুখী জনসংখ্যার চাপ। তাহলে কি এখন সময় এসেছে অর্থনৈতিক কার্যক্রমের বিকেন্দ্রীকরণের? আমাদের তুলনামূলক সুবিধা কি শুধু কম মজুরির শিল্পেই, নাকি অন্য কোথাও সম্ভাবনা আছে? কীভাবে আমরা প্রতি ১০ বছরে লোকের আয় দ্বিগুণ করতে পারি? এ উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য অর্জনের জন্য কী কী কৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে?
এ মৌলিক প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা আর দৃঢ় প্রতিজ্ঞা লাগবে। বিকেন্দ্রীকরণের কথা উঠছে, কারণ আমাদের বর্তমান অর্থনৈতিক মডেল একটা বড় অসাম্য তৈরি করেছে, যা সংশোধন করা দরকার। চীনের দিকে তাকান। তারা কীভাবে ৮০ কোটি মানুষকে দারিদ্র্য থেকে বের করে এনেছে? ছোট ছোট শহরকে উন্নত করে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক কেন্দ্র বানিয়ে আর রাজধানীর বাইরেও অবকাঠামো ও মানুষের দক্ষতা বাড়াতে বিনিয়োগ করে। এ পদ্ধতি শুধু অর্থনৈতিক সুযোগই ছড়িয়ে দেয় না, বরং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নিজস্ব শক্তি ও সম্পদকেও কাজে লাগায়।
হয়তো বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো এর উর্বর মাটি। এটা প্রকৃতির এমন একটা দান যা অন্য কোনো দেশ আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে না। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এ অমূল্য সম্পদটাকে আমরা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারছি না। এর সম্ভাবনাকে সর্বোচ্চ ব্যবহার করার বদলে বেশির ভাগ জমিতে হয় কম ফলনের ধান চাষ হচ্ছে, নয়তো গ্রামে বাড়িঘর আর ব্যবসায়িক ভবন বানিয়ে নষ্ট করা হচ্ছে। আমাদের দেশের যে উর্বর জমি দিন দিন কমে যাচ্ছে, সেখানে বেশি ফলনের ধান আর দামি ফসল চাষ করা, যেমন বিশেষ ধরনের ফসল বা কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে তোলা, এসব নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। এভাবে আমরা আমাদের এ প্রাকৃতিক সম্পদকে আরো ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারব।
এ লেখায় আমরা দুটো মূল বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছি। প্রথমত, পুরনো অর্থনৈতিক মডেলে ফিরে গেলে দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোও ফিরে আসবে। দ্বিতীয়ত, উন্নতির একটা নতুন পথ খুঁজতে গিয়ে কৃষিভিত্তিক উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দেয়া হয়তো একটা বেশি টেকসই ও ন্যায়সংগত সমাধান দিতে পারে। এ পদ্ধতি স্বাভাবিকভাবেই বিকেন্দ্রীভূত, অর্থনৈতিক কাজকর্ম আরো ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করে, আর কৃষিতে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সুবিধাকে কাজে লাগায়।