ব্যাংকিং খাত উপশমে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে
Share on:
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষিতে দেশ এখন নতুন যুগে প্রবেশ করেছে। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ১৭ সদস্যের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে।
এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গণ রায়ের ভিত্তিতে গঠিত একটি নতুন সরকারের কাছে দায়িত্ব অর্পণ করা। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের অর্থনীতিতে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে তা নিরাময়ের জন্য এই সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্যোগ নিতে পারেন। বিশেষ করে দেশের ব্যাংকিং খাতে যে সমস্যা বিরাজ করছে তা উপশমের জন্য এখনই উদ্যোগ নিতে হবে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারর অর্থ উপদেষ্টার দায়িত্ব লাভ করেছেন। তিনি যেহেতু বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন তাই ব্যাংকিং খাতের সমস্যা এবং সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে ভালোভাবেই অবহিত আছেন। তার পক্ষে সংস্কার উদ্যোগ গ্রহণ করা তুলনামূলকভাবে সহজ হবে। অর্থনীতিসহ বিভিন্ন খাতে সংস্কার কার্যক্রম শুরুর ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সুবিধা হচ্ছে তারা কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ নন। কাজেই তারা চাইলে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে যে কোনো সংস্কার কার্যক্রম শুরু এবং বাস্তবায়ন করতে পারবেন। ব্যাংকিং খাত বর্তমানে যে অবস্থার মধ্যে পরিচালিত হচ্ছে তা কোনোভাবেই কারো কাম্য হতে পারে না।
ব্যাংকিং খাতকে একটি দেশের অর্থনীতির ‘লাইফ লাইন’ বলা হয়। কোনো দেশের অর্থনীতি কখনোই সঠিকভাবে বিকশিত হতে পারে না যদি দেশটির ব্যাংকিং খাত স্বচ্ছ ধারায় পরিচালিত না হয়। বিশেষ করে উন্নয়নশীল এবং স্বল্পোন্নত দেশের অর্থনীতিতে ব্যাংকিং খাতের কোনো বিকল্প নেই। এসব দেশের উদ্যোক্তা এবং ব্যবসায়ীগণ সব সময়ই পুঁজি সঙ্কটে থাকে। তাই তারা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান যেমন শিল্প-কারখানা স্থাপন এবং ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ব্যাংকের দ্বারস্থ হয়ে থাকেন। ব্যাংকিং খাত যদি তাদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করতে পারে তাহলে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড দ্রুত বিকশিত হতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাত সঠিকভাবে চলছে না। যে কারণে উদ্যোক্তা এবং ব্যবসায়ীগণ এই খাত থেকে কাক্সিক্ষত সহযোগিতা পাচ্ছেন না। বরং ব্যাংকিং খাত এখন একটি বিশেষ মহলের সম্পদ আত্মসাৎ এবং পুঁজি পাচারের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে গত কয়েক বছরে দেশের ব্যাংকিং খাতকে পরিকল্পিতভাবে নিমজ্জিত করা হয়েছে। আ হ ম মোস্তাফা কামাল গত সরকারের অর্থমন্ত্রী ছিলেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনিই একমাত্র অর্থমন্ত্রী যিনি সরাসরি একজন শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি ব্যাংকিং খাত সম্পর্কে যেসব নীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করেছেন তার অধিকাংশই ছিল একটি বিশেষ মহলের স্বার্থ রক্ষায় নিবেদিত। বিশ^ব্যাংক, ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ড সহ (আইএমএফ) বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার পরামর্শ এবং সহযোগিতায় ব্যাংকিং খাতের জন্য যেসব আইনি কাঠামো তৈরি এবং বাস্তবায়ন করা হচ্ছিল তা ছিল আন্তর্জাতিক মানের। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এসব আইনের অনেকগুলোই সংস্কারের নামে দুর্বল করে ফেলা হয়েছে। যেসব আইনি সংস্কার সাধন করা হয়েছে তা মূলত ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি এবং ‘দুষ্টু গ্রাহকদের স্বার্থ সুরক্ষা দিয়েছে মাত্র। তাই সংস্কারকৃত এসব আইন পরিবর্তন করে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা দরকার। প্রয়োজনে আগের চেয়েও কঠিন আইন প্রণয়ন করতে হবে। এমন কোনো আইনি সংস্কার মেনে নেয়া যাবে না যা ব্যাংকিং খাতকে দুর্বল করে ফেলে।
ব্যাংকিং খাতের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে প্রদত্ত ঋণের কিস্তি নির্ধারিত সময়ে আদায় করার ব্যর্থতা। ফলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল দায়িত্ব গ্রহণের পর বলেছিলেন, আজ থেকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক টাকাও বাড়বে না। তার এই বক্তব্যে অনেকেই আশান্বিত হয়েছিলেন। কিন্তু দেখা গেলে তার আমলে খেলাপি ঋণের কিস্তি আদায়ের পরিবর্তে নানা আইনি মারপ্যাঁচে খেলাপি ঋণকে আড়াল করে রাখা হলো। আওয়ামী লীগ যখন ২০০৯ সালে সরকার গঠন করে তখন ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকার মতো। বর্তমানে তা ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। অবশ্য এটা ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র নয়। অনেকের মতে, আইনি মারপ্যাঁচে লুকিয়ে রাখা খেলাপি ঋণ যোগ করলে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকা।
প্রথমেই উল্লেখ করা যেতে পারে খেলাপি ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণের বিষয়টি। ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণের অর্থ হচ্ছে কোনো ঋণ হিসাব থেকে পাওনা কিস্তি আদায়ের সময় বর্ধিতকরণ বা কমানো। আমাদের দেশে কিস্তি পরিশোধের সময় সীমা সাধারণত কমানো হয় না। তাই ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণ বলতে কার্যত আমরা বুঝি ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময় বর্ধিতকরণ। কোনো ঋণ হিসাব থেকে কিস্তি আদায়ের সময় সীমা বাড়ানো হলে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সেই ঋণ হিসাবকে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না। বাংলাদেশ ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণের বিষয়টি প্রথম দৃষ্টিতে আসে ১৯৯১ সালে। সেই সময় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল(বিএনপি) নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হবার পর ২০ মে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে ১৭১ জন বৃহৎ ঋণ খেলাপির তালিকা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ করা হয়। এই তালিকায় স্থান প্রাপ্তদের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংকগুলোর পাওনা খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল সর্বনিম্ন দেড় কোটি টাকা। এই তালিকা প্রকাশের পর চারিদিকে হৈচৈ পড়ে যায়। বিশ^ব্যাংক বাংলাদেশের অনুকূলে একটি ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করেছিল। সেই ঋণ ছাড়করণের জন্য ঋণ খেলাপিদের তালিকা শর্ত দেয়া হয়েছিল। মূলত সে কারণেই সরকার এই তালিকা প্রকাশ করেছিল। বলা হয়েছিল, পরবর্তীতে এ ধরনের ঋণ খেলাপিদের আরো তালিকা প্রকাশ করা হবে। কিন্তু সেই তালিকা আর প্রকাশিত হয়নি। ১৭১ জন বৃহৎ ঋণ খেলাপির তালিকা প্রকাশিত হলে তালিকায় স্থানপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ খুবই অসন্তুষ্ট হয়। তারা নানা ভাবে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। সেই সময় প্রথমবারের মতো খেলাপি ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণের উদ্যোগ নেয়া হয়। মোট পাওনা ঋণের ১০ শতাংশ এককালীন ব্যাংকের অনুকূলে নগদে ডাউন পেমেন্ট হিসেবে জমা দিয়ে ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণের সুযোগ দেয়া হয়। প্রথমবার ১০ শতাংশ, দ্বিতীয়বার ২০ শতাংশ এবং তৃতীয়বার ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণের জন্য ৩০ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিতে হতো। কিন্তু একটি ঋণ হিসাব সর্বোচ্চ কতবার পুনঃতফসিলিকরণ করা যাবে আইনে তার কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশনা ছিল না। তবে ধরে নেয়া হতো তিনবারের বেশি কোনো ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণ করা যাবে না। যেহেতু তিন বার ডাউন পেমেন্ট জমা দেবার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু কোনো কোনো প্রভাবশালী উদ্যোক্তা এবং ঋণ গ্রহীতা আইনের এই অস্পষ্টতাকে কাজে লাগিয়ে ৩০ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে তিনবারের বেশি ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণ করেছে। এমনকি নারায়ণগঞ্জের একজন উদ্যোক্তা ১২ বার তার প্রতিষ্ঠানের ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণ করেছিলেন বলে তথ্য পাওয়া গিয়েছিল।
পরবর্তীতে প্রতিটি সরকার আমলে ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণের এই সুবিধার অপব্যবহার করা হয়েছে। সর্বশেষ আ হ ম মোস্তফা কামাল অর্থমন্ত্রী থাকাকালে মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে এক বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ১০ বছরের জন্য খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলিকরণের সুবিধা দেয়া হয়। ৩৮ হাজার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এই সুবিধা নিয়েছেন। নির্ধারিত সময় অর্থাৎ ১০ বছর পর এই প্রকল্পগুলো থেকে যখন ঋণের কিস্তি আদায় হবে না তখনই ব্যাংকগুলো বুঝতে পারবে তাদের কতটা হয়েছে। ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ যদি আদায় করতে হয় তাহলে জরুরি ভিত্তিতে ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণ সুবিধা বাতিল করে ঋণের কিস্তি আদায়ের ব্যবস্থা করতে হবে। আর কোনো ঋণ হিসাবই একবারের বেশি পুনঃতফসিলিকরণ করতে দেয়া যাবে না। আর যেসব ব্যক্তি জাতীয় অথবা স্থানীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন তাদের নির্বাচনের নির্ধারিত তারিখের অন্তত এক বছর আগে থেকে ঋণমুক্ত থাকার শর্ত দিতে হবে। দেখা যায়, অনেকেই আছেন যারা ব্যাংকে ঋণ খেলাপি। নির্বাচনের আগে সামান্য কিছু ডাউন পেমেন্ট দিয়ে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেন। নির্বাচিত হলে তার নিকট থেকে আর কিস্তি আদায় করা সম্ভব হয়না আর নির্বাচনের হেরে গেলে তিনি আর ব্যাংকমুখো হন না। ভাবখানা এই যেনো নির্বাচনে তার পরাজয়ের জন্য ব্যাংকই দায়ী। যে মানুষটি ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করে খেলাপি হন তার জন্য নির্বাচনে প্রতিনিধিত্ব করার কোনো সুযোগ রাখা উচিত নয়।
ঋণ হিসাব অবলোপন নীতিমালা সম্প্রতি একাধিকবার সহজীকরণ করা হয়েছে। ঋণ হিসাব অবলোপন শব্দটি উচ্চারিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই অনেকের মনে এমন একটি ধারণার সৃষ্টি হয় যে, ব্যাংক হয়তো সংশ্লিষ্ট ঋণ হিসাবের কাছে পাওনা ঋণের দাবি ত্যাগ করেছে। আসলে বিষয়টি তা নয়। ঋণ হিসাব অবলোপনের অর্থ হচ্ছে সংশ্লিষ্ট ঋণ হিসাবের কাছে পাওনা ঋণাঙ্ক আলাদা একটি এ্যাকাউন্টে সংরক্ষণ করা। মূলত ব্যাংকের ঋণের মূল লেজারকে ক্লিন দেখানোর জন্যই এটা করা হয়। অবলোপনকৃত ঋণ হিসাব থেকে পাওনা আদায়ের চেষ্টা অব্যাহত রাখা হয়। কোনো কিস্তি আদায় হলে তা সরাসরি ব্যাংকের মুনাফা খাতে চলে যায়। আগে কোনো ঋণ হিসাব মন্দমানে শ্রেণিকৃত হবার পর ৫ বছর অতিক্রান্ত হলে শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ এবং উপযুক্ত আদালতে মামলা দায়েরের পর তা অবলোপন করা যেতো। কিন্তু আইনি সংস্কারের মাধ্যমে এখন কোনো ঋণ হিসাব মন্দমানে শ্রেণিকৃত হবার পর ২ বছর অতিক্রান্ত হলেই তা অবলোপন করা যাচ্ছে। এ জন্য শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণের বিধান প্রত্যাহার করা হয়েছে। ঋণাঙ্কের পরিমাণ যদি ৫ লাখ টাকার কম হয় তাহলে উপযুক্ত আদালতে মামলা দায়ের করতে হবে না। এর ফলে ঋণ হিসাব অবলোপনের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
সম্প্রতি এক আত্মঘাতী আইনি সংস্কার করা হয়েছে। আগে নিয়ম ছিল, কোনো শিল্পগোষ্ঠীর যদি একাধিক শিল্প প্রতিষ্ঠান থাকে এবং তাদের মধ্যে যে কোনো একটি প্রকল্প ঋণ খেলাপি হয়ে যায় তাহলে অবশিষ্ট শিল্পগুলোর অনুকূলে কোনো ঋণ মঞ্জুর করা হতো না। এতে উদ্যোক্তাগণ ব্যাংক ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে এক ধরনের চাপের মধ্যে থাকতো। তারা চেষ্টা করতো কিভাবে গোষ্ঠীর সবগুলো শিল্পকে ঋণ খেলাপি মুক্ত রাখা যায়। কিছু দিন আগে আইন পরিবর্তন করা হয়েছে। এখন কোনো শিল্পগোষ্ঠীর একটি প্রতিষ্ঠান ঋণ খেলাপি হয়ে পড়লেও অবশিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংক ঋণ পাবার ক্ষেত্রে যোগ্য বলে বিবেচিত হবে। কোনো শিল্পগোষ্ঠীর যদি ৫টি শিল্প প্রতিষ্ঠান থাকে এবং তার মধ্যে ৪টি শিল্প ঋণ খেলাপি হয় তাহলেও পঞ্চম শিল্পটির অনুকূলে ব্যাংক ঋণ পেতে কোনো অসুবিধা হবে না।
২০১৫ সালে সারা দেশব্যাপী রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা শুরু হয়। এই আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এমন অজুহাত তুলে একটি চিহ্নিত মহল বাংলাদেশ ব্যাংকের উপর চাপ সৃষ্টি করে ৫০০ কোটি টাকা ও তদূর্ধ্ব অঙ্কের খেলাপি ঋণ সহজ শর্তে পুনর্গঠন করিয়ে নেয়। ঋণ হিসাব পুনর্গঠন এর পুনঃতফসিলিকরণ চারিত্রিক দিক থেকে অনেকটাই একই রকম। সেই সময় দেশের শীর্ষস্থানীয় ১১ টি শিল্পগোষ্ঠী তাদের কাছে পাওনা ১৫ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নিয়মিত করে নেয়। পরবর্তীতে এদের অনেকগুলোই ঋণ হিসাব পুনগঠনের শর্ত পরিপালনে ব্যর্থ হয়েছে। প্রশ্ন হলো, এমন একটি সুবিধা কোনো দেয়া হলো? আর যদি এ ধরনের সুবিধা দেয়া হয় তাহলে তা সবার জন্য অবারিত করা উচিত ছিল। কারণ ৫০০ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তেমনি যার কাছে ৩০০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আছে তিনিও তো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাহলে আইনটি কি সবার জন্য প্রয়োগ করা উচিত ছিল না।
বাংলাদেশ ব্যাংক উদ্যোক্তাদের চাপের মুখে ব্যাংক ঋণের সুদের সর্বোচ্চ হার ৯ শতাংশ এবং আমানতের উপর প্রদেয় সুদের হার রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের ক্ষেত্রে সাড়ে ৫ শতাংশ ও ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকের বেলায় ৬ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। পরবর্তীতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যাংক রেট বারবার বৃদ্ধি করা হয়। ব্যাংক রেট (সিডিউল ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে স্বল্পকালীন সময়ের জন্য ঋণ বা ধার গ্রহণের সময় যে সুদ প্রদান করে) ৫ শতাংশ থেকে সাড়ে ৮ শতাংশে বৃদ্ধি করা হলেও ব্যাংক ঋণের সুদের হার (সিডিউল ব্যাংক উদ্যোক্তাদের ঋণদানের ক্ষেত্রে যে সুদ চার্জ করে) ৯ শতাংশে সীমাবদ্ধ রাখে। ফলে ব্যাংক ঋণ গ্রহণ তুলনামূলকভাবে সস্তা হয়ে দাঁড়ায়। এক শ্রেণির প্রভাবশালী মানুষ ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করে। সেই ঋণের অর্থ কোন না কোনোভাবে বাজারে চলে আসে। ফলে মুদ্রার যোগান কমিয়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।
দেশের ব্যাংকিং খাত সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে না। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে প্রতিটি ব্যাংকে অভ্যন্তরীণ সুশাসনের প্রচণ্ড অভাব পরিলক্ষিত হয়। আর ব্যাংকিং খাতে এক ধরনের দ্বৈত নিয়ন্ত্রণ চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রধানত ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকের উপর যেভাবে তার কর্তৃত্ব প্রয়োগ করতে পারে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের ক্ষেত্রে তা পারে না। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের উপর কর্তৃত্ব করে অর্থমন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ বা বরখাস্তকরণ এবং পরিচালনা বোর্ড গঠনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো ভূমিকা পালন করতে পারে না। এটা সম্পূর্ণ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কর্তৃত্বাধীন। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংককে আরো ক্ষমতায়িত করে ব্যাংকিং খাতের উপর একক কর্তৃত্ব প্রদান করা যেতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকে এমন ব্যক্তিদের গভর্নর এবং পরিচালনা বোর্ডে নিয়োগ দেয়া যেতে পারে যারা সরসরি কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি অনুগত নন। এছাড়া কোনো আমলাকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ না দেয়াই ভালো। কারণ আমলারা অধিকাংশ সময়ই স্বাধীনভাবে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্বেক এক গভর্নর, যিনি এক সময় আমলা ছিলেন তিনি উদ্যোক্তাদের আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে গিয়ে ব্যাংক ঋণের সুদের সর্বোচ্চ হার ৯ শতাংশ এবং আমানতের উপর প্রদেয় সুদের ৬ শতাংশ নির্ধারণের অঙ্গীকার করেছিলেন। এটা নজীরবিহীন একটি ঘটনা।
বাংলাদেশ ব্যাংককে সত্যিকারার্থে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা প্রয়োজন। এমন একজন ব্যক্তিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে যিনি সব রাজনৈতিক প্রভাবের ঊর্ধ্বে উঠে জাতির স্বার্থে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা রাখেন। সরকারের কোনো মন্ত্রী বা অন্য কারো প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে অর্থনীতি বিধ্বংসী কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন না। ব্যাংকিং সেক্টরে আরো সমস্যা আছে যেগুলো প্রশমনের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।