সম্পাদকীয় প্রকাশনার সময়: বৃহস্পতিবার ১৫, অগাস্ট ২০২৪

ব্যক্তি নিরাপত্তার স্বার্থে ‘টেলিফোনে আড়িপাতা’ নজরদারি বন্ধ করা হোক

Share on:

ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা লঙ্ঘন করা কেবল গর্হিত কাজ নয়, অসাংবিধানিকও বটে। তবে জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে আড়ি পেতে টেলিফোন ও ইন্টারনেটনির্ভর যোগাযোগমাধ্যম থেকে তথ্য ও সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করার প্রচলন এবং আইনি ভিত্তিও আছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে।


পৃথিবীব্যাপী গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় আড়িপাতার কাজটি করা হয়। আর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোয় এর অপব্যবহার রোধে জবাবদিহির বিশেষ ব্যবস্থাও রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে দীর্ঘকাল ধরে এ কাজ করা হচ্ছিল সদ্য ক্ষমতাচ্যুত সরকারের স্বৈরশাসন চর্চার হাতিয়ার হিসেবে। আর এমন সংবিধান পরিপন্থী ও গর্হিত কাজটি করে চলেছে জাতীয় টেলিযোগাযোগ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র (এনটিএমসি)। বণিক বার্তার সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। ব্যক্তিস্বার্থে সংস্থাটির এ কাজ শিগগিরই বন্ধ করা জরুরি।

প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, মোবাইল ফোনের ভয়েস ও এসএমএস, ল্যান্ডফোন ভয়েস এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আড়ি পাততে পারে এনটিএমসি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, টুইটার (বর্তমানে এক্স), টেলিগ্রাম, ভাইবার, ইমো, স্কাইপি ইত্যাদি অ্যাপে আড়িপাতার সক্ষমতা আছে সংস্থাটির। এমনকি অনলাইন যোগাযোগমাধ্যম ওয়েবসাইট ব্লগ, ই-মেইলেও আড়িপাতার সক্ষমতা রয়েছে। এছাড়া সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কেন্দ্র করে ১৭ জুলাই থেকে ইন্টারনেট বন্ধের নির্দেশনাগুলো মূলত এনটিএমসি থেকেই দেয়া হয়েছে। এটি পরিচালিত হয় সরকারের বিশেষ একটি গোয়েন্দা সংস্থার অধীনে। ভিক্যাল মাউন্টেড ডাটা ইন্টারসেপ্টর, ভিক্যাল মাউন্টেড মোবাইল ইন্টারসেপ্টর, পেগাসাস স্পাইওয়্যারের মতো নজরদারি যন্ত্র ব্যবহার করে এনটিএমসি। সম্প্রতি এনএসও গ্রুপের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে যে তাদের পেগাসাস সফটওয়্যার পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে একনায়কতান্ত্রিক সরকারের কাছে বিক্রি করা হয়েছে এবং তারা এটির অপব্যবহার করেছে। নজরদারি বাড়ানোর জন্য গণ-অভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হওয়া আওয়ামী লীগ সরকার ব্যয় করেছে কোটি কোটি টাকা।

এনটিএমসির সক্ষমতার অপপ্রয়োগ রোধ করে মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া জনজীবনের ঝুঁকি আরো বেড়ে যাবে। এরই মধ্যে সর্বশেষ সরকারের ‘অতিসংবেদনশীল সার্ভার’ থেকে নাগরিকদের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য অনলাইন প্লাটফর্মে অপরাধী চক্রের কাছে বিক্রি করার কথা জানা গেছে। দুই পুলিশ কর্মকর্তা এনটিএমসির সার্ভারে প্রবেশ করে সংবেদনশীল তথ্য যোগাযোগের অনলাইন প্লাটফর্ম টেলিগ্রাম চ্যানেলভিত্তিক একটি গ্যাংয়ের কাছে বিক্রি করেন। কেননা নাগরিকদের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও এনটিএমসির কাছে সংরক্ষিত থাকে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজনৈতিক প্রয়োজনে সেসব তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশে ফোনে আড়িপাতাকে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এ মানবাধিকারকে আইনের মাধ্যমে লঙ্ঘন করা হয়েছে। ২০০৬ সালের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ এবং সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩-এর মাধ্যমে আড়িপাতাকে বৈধতা দেয়া হয়েছে। এনটিএমসি আইনগত বৈধতা নিয়েই এটি করে। সুতরাং সংস্থাটির গোপন নজরদারির কাজ বন্ধ করতে সবার আগে আইনে সংশোধনী আনতে হবে।

উন্নত দেশগুলোয় কারোর বিরুদ্ধে অভিযোগ সাপেক্ষে আদালত থেকে অনুমোদন নিয়ে আড়িপাতার নিয়ম আছে। কিন্তু আমাদের দেশে সেটি ব্যতিক্রমভাবে করা হচ্ছে। ব্যক্তিস্বার্থে অবৈধভাবে আড়িপাতাকে আইনি বৈধতা দেয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে কর্তৃত্ববাদী সরকার উৎখাতের পর নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হয়েছে। লক্ষ্য দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করা। কিন্তু ব্যক্তিগত গোপনীয়তা এবং বাকস্বাধীনতা নিয়ে যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে গত সরকারের আমলে, তা দূর করতে না পারলে কখনই নাগরিকরা প্রকৃত গণতন্ত্রের স্বাদ পাবে না।

গোপন নজরদারি করার সব ধরনের সক্ষমতা স্বাভাবিকভাবেই গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর থাকে। কিন্তু তা বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থে সরকার টিকিয়ে রাখতে ব্যবহার করা হলে গণতান্ত্রিক চর্চা ব্যাহত হবে। জাতীয় নিরাপত্তার জন্য নজরদারি জোরদার করা যেতেই পারে কিন্তু রাজনৈতিকভাবে ভিন্নমত দমনের জন্য ব্যবহৃত হওয়া কাঙ্ক্ষিত নয়।

এনটিএমসি যেন আর কোনো কর্তৃত্ববাদী সরকারের শাসন কায়েম ও দমন-পীড়নের হাতিয়ার না হয় সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও নীতিমালা প্রণয়ন করে যেতে হবে। একই সঙ্গে আড়িপাতা ছাড়া সংস্থাটির অন্য কোনো কাজ রয়েছে কিনা সেটিও যাচাই করা উচিত। যদি প্রয়োজন না থাকে তাহলে এটিকে রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে ব্যবহারের নিমিত্তে বেসামরিক কর্তৃপক্ষের অধীনে নিয়ে আসতে হবে; কোনো গোয়েন্দা সংস্থার অধীনে রাখা সমীচীন নয়। সর্বোপরি প্রয়োজন সংস্থাটির জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।

এনটিএমসি হলো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের অধীন একটি অধিদপ্তর। ২০০৮ সালে সরকারি উদ্যোগ ও বেসরকারি অর্থায়নে একটি গোয়েন্দা সংস্থার অফিসে ছোট পরিসরে ‘জাতীয় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র’ বা ‘ন্যাশনাল মনিটরিং সেন্টার’ (এনএমসি) নামে সংস্থাটি যাত্রা করে। ২০১৩ সালের ৩১ জানুয়ারি এর নাম পরিবর্তন করে ‘ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি)’ বা জাতীয় টেলিযোগাযোগ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র রাখা হয়। ২০১৪ সালে স্বতন্ত্র হিসেবে কার্যক্রম শুরু করে। সম্প্রতি সরকার ক্ষমতাচ্যুত হলে এনটিএমসি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় এর তৎকালীন মহাপরিচালককে। এরই মধ্যে নতুন মহাপরিচালকও নিয়োগ দেয়া হয়েছে। সন্ত্রাস ও গুরুতর অপরাধ দমনের বাইরে যেন আড়িপাতা প্রযুক্তির ব্যবহার না হয়, সে বিষয়ে নতুন মহাপরিচালককে দায়িত্বশীল হতে হবে। আর বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনে ফোনে আড়িপাতার অপরাধ প্রমাণিত হলে অনধিক দুই বছর কারাদণ্ড এবং অনধিক ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড দেয়ার বিধান আছে। ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘনের কোনো প্রমাণ পাওয়া গেলে এ বিধানের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে সংশ্লিষ্টদের। আর জাতীয় স্বার্থে আড়ি পাতা হলে সেটিও একটি কাঠামোর মধ্যে করা উচিত, বেআইনিভাবে নয়।

দৈনিক বণিকবার্তা