মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: শুক্রবার ৯, অগাস্ট ২০২৪

বিবেক বিক্রির যতকথা

Share on:

ছোট বেলা থেকে ইসলামী আবহে বড় না হলেও কীভাবে যেন আমার মধ্যে “সদা সত্য কথা বলিব” এই নীতিবাক্য মানার প্রবণতা তৈরি হয়ে গেছে। অধিকাংশ সময় সত্য বলতে বলতে এখন এমন হয়ে গেছে যে আমি পাশে থাকলে অনেকে ভয় পায় যে মুখ ফসকে কখন কোন সত্য না বলে ফেলি !


সত্য বলা তো কোনও অন্যায় না; কিন্তু সত্যটাকে সুন্দর করে উপস্থাপন করার কৌশলটা রপ্ত করতে না পারার কারণে কখনও কখনও কারও কারও বিরাগভাজন হয়ে যাই। কেউ কেউ মাঝে মাঝে আমাকে ভুলও বোঝেন। কখন যে কারও কারও কাছে ঠোট কাঁটা হিসেবেও সুপরিচিত না কুপরিচিত হয়ে উঠেছি তাও ঠিক জানি না।

বাস্তব জীবনের মতো মাঝে মাঝে সোশ্যাল মিডিয়াতেও ঠোট কাঁটা হয়ে উঠি। বাংলাদেশে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করার আগে গত সপ্তাহে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রেক্ষিতে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র আবু সাঈদের মৃত্যুর পর অস্ত্রের সামনে তার বুক উঁচিয়ে ধরা ছবিটা ফেসবুকে শেয়ার করে লিখেছিলাম “জাগো বাহে, কোনঠে সবাই”। এসব দেখে আমার স্বামী আমাকে বলেছিল, “তোমাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে, তোমার চাকরি চলে যাবে।”

তার কথায় মৃদু প্রতিবাদ করে বলেছিলাম, “এটুকুতেই যদি চাকরি চলে যায় তো যাক, পুলিশ ধরে নিয়ে যায় তো যাক!”

পরে মনে মনে ভেবেছিলাম সত্যিই যদি চাকরি চলে যায়! সত্যি যদি পুলিশ ধরে নিয়ে যায়! কী হবে??? থাক তাহলে আর কোনও পোস্ট দিব না। এই নিয়ে কোন কথাও বলব না।

আমার মতো হয়তো অনেকেই চুপ হয়ে যায় এরকম চাকরি যাওয়ার ভয়ে, জেলে যাবার ভয়ে বা জান যাবার ভয়ে। আমার মতোই হয়তো অনেকে বিবেক বিক্রি করে দেয় নিজের জান ও রুটি-রুজির বিনিময়ে। আমার মতো এরকম আরও অনেক বিবেকবেচা মানুষ এই বাংলায় আছে বলেই আজ এই জমিনে বারবার জুলুমের শিকার হয় অসহায় মানুষেরা। মাথার উপর জেঁকে বসে জুলুম ও অন্যায়ের রাজত্ব।

বাংলাদেশের জনপ্রিয় এক প্রতিষ্ঠানের কথা জানি। দেশে কারফিউ শুরুর একদিন আগে যেই প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজমেন্ট থেকে কড়া নির্দেশ এসেছিল, ‘বর্তমানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নিয়ে যে কঠিন পরিস্থিতি বিরাজ করছে সেই বিষয় নিয়ে যেন সেই প্রতিষ্ঠানের কোনও কর্মী কোনও আন্দোলনে শরিক না হয়, কেউ যেন এই বিষয়ে কোনও কথা না বলে। মুখে কুলুপ এটে থাকার পাশাপাশি এই বিষয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে যেন কেউ ভিডিও বা ছবি শেয়ার না করে। এমনকি সরকারের বিবেচনায় বিতর্কিত কোনো পোস্টে লাইক, কমেন্টও যেন না করে !’

যে প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা একসময় দেশে বিরাজমান যে কোনও কঠিন অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল। আজ সেই একই প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের এমন নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে ! আর সবচেয়ে বড় বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, সবাই নীরবে তা মেনেও নিচ্ছে! রুটি-রুজি হারানোর ভয়ে কীভাবে অন্যায়ের সাথে আপোসহীন একদল কর্মী গোষ্ঠী অন্যায় ও জুলুম দেখেও নীরব থাকছে। নীরব থাকার প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা অনবরত চলছে তাদের মাঝে। ঐ প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মী এই কষ্ট বুকে নিয়ে জনপ্রিয় এক কবিতার কয়েক লাইন ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলেন,

“চোখ বিক্রি করে আমি এই শহরে এসেছি।

চারদিকে তাই কাউকে দেখি না।

পথের মধ্যে একজন বলেছিল,

কান দুটোও রেখে যাও, রেখে এলাম।

এখন আমি আর ভাল-মন্দ কিচ্ছু শুনি না।

তবে মাঝে মাঝে খুব খারাপ লাগে এই শহরে।

একজনকে বললাম, এই খারাপ লাগার কারণ কী?

তিনি বললেন বোকা ছেলে সব বিক্রি করেছ,

কিন্তু বিবেকটা বিক্রি না করলে তো এমন হবেইৃ

এরপর এই শহরে আমি একজন ভাল ক্রেতা খুঁজে বেড়াচ্ছি।

কয়েকজন পেয়ে বললাম,

একটা বিবেক ছিল, খুব কম দামে বেঁচতে চাই। নেবেন ভাই?

তারা বললেন, মাথা খারাপ!

আমরা মাত্রই নিজেদের বিবেক বেঁচে দিয়ে এলাম।”

তাহলে কি তারাও আমার মতো বিবেক বিক্রি করে দিয়েছে? বিবেক বিক্রেতা আসলে কারা? তাদের পরিচয় কী? চোখের সামনে ঘটে যাওয়া শত জুলুম নির্যাতন দেখেও যারা নীরব থাকতে পারে তারাই কি বিবেক বিক্রেতা?

২০১৮ সালে ৯ জুলাই দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত তৈমূর আলম খন্দকার রচিত আর্টিকেল “বিবেক বিক্রেতাদের নিকট জাতি অসহায়” এ বিবেক বিক্রেতাদের সংজ্ঞা দিয়ে তিনি বলেছেন, “যে ব্যক্তি সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো বলতে না পারে সে ব্যক্তিই বিবেক বিক্রেতা। এ বিবেক বিক্রেতাদের নিকট জাতি আজ অসহায়। বিবেক বিক্রেতারা প্রলোভনের কারণে বিবেককে বির্সজন দিয়ে মিথ্যাকে গ্রহণ করে।”

আর্টিকেলে তিনি আরও উল্লেখ করেন, “পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে যে, ছাত্রলীগ নেতা পুলিশকে পিটিয়েছে। তখন পুলিশ নির্বাক, কারণ যে পিটিয়েছে সে সরকারি দলের লোক বা তার অভিভাবক সরকারি দলের কর্মকর্তা। অথচ কোনও ঘটনাই ঘটে নাই এমন কাল্পনিক ঘটনা সাজিয়ে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের অহরহ গ্রেফতার করা হচ্ছে।”

২০১৮ সালের ঘটনার চেয়েও বর্তমানে দেশে ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্ররা রাস্তায় নামে। কোটা সংস্কার হতে না হতেই পুলিশ নির্বিচারে তাদের গুলী করে হত্যা করতে থাকে। অথচ জাতি বহু দিন থেকে নীরব ! কেউ কিছু বলে না। মাত্র দুই একদিন হল- কোনও কোনও জায়গায় সাধারণ জনগণ, শিক্ষক সমাজ ও শিল্পী কর্মীরা রাস্তায় নেমেছে ছাত্রদেরকে সংহতি জানিয়ে। কিন্তু তথাকথিত বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজের ন্যায় কোটি কোটি জনতা আজও নীরব। মাঝে মাঝে মনে হয় আমাদের মতো বিবেকবিক্রিত লোকদের জন্যই কি কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “বল, অন্ধ ও চক্ষুষ্মান কি সমান?” [ সূরা আর রাদ-১৬]

আমাদেরকেই কি আল্লাহ তায়ালা নিকৃষ্টতম জীব বলে আক্ষেপ করে কুরআনে বলেছেন, “আল্লাহর কাছে নিকৃষ্টতম জীব সেই বধির ও মূক যারা কিছুই উপলব্ধি করে না।” [সূরা আনফাল-২২]

আমরা সাধারণ বধির, মূক ও অন্ধ বিবেকহীন মানুষেরা নীরব থাকলেও দেশের লেখক, সমাজবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা কেন মুখে কুলুপ এটে আছেন আমি তা বুঝতে পারি না। মানবাধিকার কর্মীরা আজ কোথায়? একজন পতিতার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও অধিকার আদায়ে যে বুদ্ধিজীবী ও মানবাধিকার কর্মীরা সরব, পথের উপর ধাবমান বাসের নিচে চাপা পড়া একটা কুকুরের মৃত্যুতে যে শ্রেণী সোচ্চার হয়ে উঠে; তারা কেন আজ শত শত মানুষের মৃত্যুতেও কিছু বলছে না? তারাও কি বিবেক বিক্রি করে দিয়েছে আমার মতো ?

২০১৭ সালের ১০ এপ্রিল প্রথম আলোতে প্রকাশিত মহিউদ্দিন আহমেদের আর্টিকেল “বিবেক বিক্রি ও বুদ্ধিজীবীদের নীরবতা” অধ্যাপক আহমদ শরীফের “বঞ্চনামুক্ত সমাজচিন্তা” শিরনামের একটি আর্টিকেলের উদ্ধৃতি দেন। এই আর্টিকেলে অধ্যাপক আহমদ শরীফ বলেন, “আমাদের জন্যই রাষ্ট্র ও সরকার, শাসক-প্রশাসক তৈরি হয়েছে। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের ও জীবিকার সর্বপ্রকার চাহিদা মেটানোই হচ্ছে রাষ্ট্রের, সরকারের, শাসক-প্রশাসকের সব শাখার প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব-কর্তব্য। কাজেই দেশবাসী হিসেবে নাগরিকের অধিকার প্রয়োগ আমজনতার পক্ষে কথা বলার, দাবি করার ও দাবি আদায়ে প্রয়াসী হওয়ার, প্রয়োজনে সরকারের অপকর্মের প্রতিকার চাওয়ার, প্রতিবাদ করার, প্রতিরোধে ক্ষোভ-ক্রোধ নিয়ে লড়াকু হয়ে রাস্তায় নামার, প্রচলিত অর্থে দ্রোহী হওয়ার আর কাগুজে বিবৃতির, মেঠো বক্তৃতার ও সড়কি মিছিলের আয়োজনে মেতে ওঠার দায়িত্ব-কর্তব্য বর্তায় স্বার্থে ও পরার্থে সমভাবে সচেতন শিক্ষিত শহুরে বুদ্ধিজীবী নামের বিভিন্ন পেশার লোকদের ওপর।”

অধ্যাপক আহমদ শরীফের এই লেখার প্রেক্ষিতে মহিউদ্দিন আহমদ তার “বিবেক বিক্রি এবং বুদ্ধিজীবীদের নীরবতা” আর্টিকেলে উল্লেখ করেন, “রাষ্ট্র বা সরকার যখন দায়িত্ব পালন করে না, অথবা নিবর্তনমূলক একটি ব্যবস্থাকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়, তখন সামনে থেকে শহুরে শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীরা নেতৃত্ব দেবেন, এমনটাই তিনি আশা করেছিলেন। শুধু আশা নয়, তিনি নিজেই উদ্যোগী ছিলেন এ ব্যাপারে। এমন একটি ঘটনা ঘটেছিল ৪৩ বছর আগে। তখন নতুন দেশ। গণতন্ত্রের জন্য জনমনে প্রবল উন্মাদনা। কেননা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের এক পর্যায়ে এ দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিলেন। সেই গণতন্ত্র যদি ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায়, তাহলে হতাশা যেমন আসে, তেমনি প্রতিবাদী কণ্ঠও উচ্চারিত হয় স্বাভাবিক নিয়মে। ১৯৭৪ সালের অবস্থাটা ছিল এমনই। সবে সরকার ‘বিশেষ ক্ষমতা আইন’ পাস করেছে। যত্রতত্র নাগরিক অধিকার খর্ব করা হচ্ছে। মানুষকে বিনা বিচারে আটকে রাখা হচ্ছে এবং কেউ কেউ গুম হয়ে যাচ্ছেন।”

এই সময়ে মুক্তিযোদ্ধা কবি আল মাহমুদও সরব ছিলেন অধ্যাপক আহমদ শরীফদের সাথে। তাইতো সেই সময় তাকে জেলে যেতেও হয়েছিল প্রতবাদী কণ্ঠস্বরের কারণে সোনালী কাবিনের জনপ্রিয় এই কবিকে। আল মাহমুদ তার সোনালী কাবিনে লিখেছিলেন,

“কোনো সামন্তের নামে কোনদিন রচিনি শোলোক

শোষকের খাড়া ঝোলে এই নগ্ন মস্তকের ’পরে।

পূর্বপুরুষেরা কবে ছিলো কোন সম্রাটের দাস

বিবেক বিক্রয় করে বানাতেন বাক্যের খোঁয়াড়,

সেই অপবাদে আজও ফুঁসে ওঠে বঙ্গের বাতাস।”

আহমদ শরীফের আরেকটি প্রবন্ধ ‘পুরাণ-ইতিহাসের আলোকে আমাদের অবস্থা ও অবস্থান’ এ উদ্ধৃত একটি কথার মাধ্যমে শেষ করতে চাই,

“দেশটা কি শুধু পেশাদার রাজনীতিকদের? পরবর্তী প্রজন্মের লোকেরা যখন ইতিহাসের পৃষ্ঠায় বুদ্ধিজীবীদের এই নিরবতা নিষ্ক্রিয়তার বয়ান পড়বে, তখন কি আমাদের ১৯৫৭-৭০ সালের কিংবা ১৮৫৭ সালের নীরব নিষ্ক্রিয় ব্রিটিশ পদলেহী অনুগ্রহজীবীদের মতো ঘৃণা করবে না?

দৈনিক সংগ্রাম