মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: রবিবার ৮, সেপ্টেম্বর ২০২৪

বিবেকের কণ্ঠস্বর একজন ‘ড. আকবর আলি খান’

Share on:

ড. আকবর আলি খানকে চেনেন না, আমজনতার মধ্যেও এমন মানুষ সম্ভবত কম আছে। বৈচিত্র্যময় ক্যারিয়ারসমৃদ্ধ আমলা ছিলেন বলে নয়; তিনি পাদপ্রদীপের আলো কাড়েন মূলত আমলা থেকে অবসর গ্রহণের পর। বিশেষত ২০০৬ সালে রাজনীতি যখন আসন্ন নির্বাচন নিয়ে উত্তাল, মূলত তখনই একটা সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনপ্রত্যাশী মানুষের কাছে পৌঁছে যান তিনি।


সবাই জানেন, তবুও সংক্ষেপে বলি- তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে বিদায়ী বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের নানা বিতর্কিত কাণ্ডের পর ‘শেষ চিকিৎসা’ হিসেবে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ নিজেই বাড়তি দায়িত্ব হিসেবে প্রধান উপদেষ্টা হয়ে বসেন। সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টাদের একজন ছিলেন আকবর আলি খান। দলীয় আজ্ঞাবাহী রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে শুধু জনমনেই প্রবল শঙ্কা জাগেনি, ভেতর থেকে আকবর আলি খান ও আরও ৩ উপদেষ্টা–হাসান মশহুদ চৌধূরী, সুলতানা কামাল ও সি এম শফি সামি বুঝতে পারেন ওই হতাশাজনক বাস্তবতা। তাই একযোগে পদত্যাগ করেন চারজন। পরবর্তী সময়ে অন্যদের আলোচনায় বেরিয়ে আসে মূলত আকবর আলি খানই সেই যৌথ পদত্যাগে নেতৃত্ব দেন।

মজার ব্যাপার হলো, আকবর আলি খান নাকি ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে তাঁর সহপাঠী হিসেবে বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার প্রস্তাবক্রমে। আবার পদত্যাগের মাধ্যমে হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেওয়ার পর তাঁর বিরুদ্ধে বিএনপিই অভিযোগ তোলে, সেই সময় সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনকারী ‘আওয়ামী লীগের লোক’ ছিলেন আকবর আলি খান। ইতিহাস সাক্ষী, নির্বাচিত হয়ে ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর আওয়ামী লীগ তাঁর কাছ থেকেই সবচেয়ে ক্ষুরধার সমালোচনার সম্মুখীন হয়। বাছবিচারহীন সমালোচনা নয়, তথ্যযুক্তিসমৃদ্ধ সমালোচনা। যেমন, সে সময় উন্নয়নের সম্ভাবনায় কেউ আস্থা রাখতে পারছিলেন না; দুর্নীতি, অনিয়মের মধ্যেও উন্নয়ন সম্ভব কিনা। আকবর আলি খান বললেন, এ হলো বাংলাদেশ প্যারাডক্স; জনগণের অমিত সম্ভাবনার উন্মোচন। আবার ২০১৪ ও ২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের তীব্র সমালোচকদের মধ্যে তিনিই ছিলেন শীর্ষ। বহুবার বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, গণতন্ত্র ও সুশাসন না থাকলে যেমন উন্নয়ন টেকসই হয় না, তেমনি সেক্যুলারিজমও অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।

১৯৪৪ সালে আজকের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে জন্মগ্রহণকারী আকবর আলি খান ছাত্রজীবনে যেমন মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন, তেমনি কর্মজীবনেও সাহস, সততা ও দক্ষতার অনন্য নজির রেখেছেন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে তৎকালীন হবিগঞ্জ মহকুমার প্রশাসক হিসেবে ভেবেছেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এসে পড়লে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বাঁচবেন কী খেয়ে? সরকারি আদেশ ছাড়াই তৎক্ষণাৎ সব কর্মচারীকে তিন মাসের আগাম বেতন দিয়ে দেন। শুধু কী তাই? ২৬ মার্চের গণহত্যার পর নিজ দায়িত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য তহবিল তৈরি করতে ব্যাংকের ভল্ট থেকে প্রায় ৩ কোটি টাকা ট্রাকে করে আগরতলায় পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্যের জোগানে গুদামঘর খুলে দেন। নিজেও যোগ দেন মুজিবনগর সরকারে। কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিত থাকায় পাকিস্তানি জান্তা তাঁকে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছিল।

রাষ্ট্রসাধনা ও সামাজিক উন্নতি ভাবনা তাঁকে এতটাই গ্রাস করেছিল যে, ৫২ বছর বয়সে লেখক বনে যান তিনি। অর্থনীতি, ইতিহাস, সমাজবিদ্যা, সাহিত্য–কী নিয়ে লেখেননি তিনি? তাঁর প্রকাশিত মোট গ্রন্থের সংখ্যা ১৭। প্রয়োজনে হাস্যরসমিশ্রিত, বরাবর তথ্য ও যুক্তিতে সমৃদ্ধ, এসব বই পাঠকমহলে এখনও ব্যাপক জনপ্রিয়।

এসবের মধ্য দিয়ে আকবর আলি খান হয়ে উঠেছিলেন বিবেকের কণ্ঠস্বর। আজ তাঁর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী, ২০২২ সালের এ দিনে দীর্ঘ রোগভোগের পর মারা যান তিনি। তাঁর প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা।

দৈনিক সমকাল