বিবিএসের কাঠামোগত সংস্কার আবশ্যক
Share on:
জাতীয় পরিসংখ্যান প্রকাশকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। প্রতিষ্ঠানটি সামষ্টিক অর্থনীতির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সূচকের অবস্থান প্রকাশ করে থাকে। কিন্তু তাদের প্রকাশিত পরিসংখ্যান নিয়ে জনমনে রয়েছে নানা সংশয়, অবিশ্বাস।
বিবিএস ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা কেন্দ্র (বিআইডিএস) পরিচালিত এক জরিপের তথ্যের ভিত্তিতে বণিক বার্তা জানাচ্ছে, এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি ব্যবহারকারী বিবিএসের তথ্যকে নির্ভরযোগ্য মনে করেন না। সবচেয়ে বেশি অবিশ্বাস মূল্যস্ফীতি পরিসংখ্যান নিয়ে। এ অবস্থায় সামষ্টিক অর্থনীতির সঠিক পরিসংখ্যান তৈরিতে বিবিএসের কাঠামোগত সংস্কার আবশ্যক।
বিবিএসের প্রকাশিত তথ্য-উপাত্ত নিয়ে দীর্ঘকাল ধরেই নানা প্রশ্ন উঠছে। এর কারণ পরিসংখ্যানের সঙ্গে বাস্তবতার মিল পাওয়া যায় কদাচিৎ। যেমন চলতি মাসে প্রকাশিত মূল্যস্ফীতি প্রতিবেদনে দেশে আগস্টে মূল্যস্ফীতির হার দেখানো হয়েছে ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ। এর আগে জুলাইয়ে দেখানো হয়েছিল ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। এর মধ্যে আবার এক মাসের ব্যবধানে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ৩ শতাংশীয় পয়েন্টেরও বেশি কমে যাওয়ার তথ্য দেয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদসহ সংশ্লিষ্টরা। দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ভয়াবহ বন্যার পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পরও আগস্টে মূল্যস্ফীতি কমে যাওয়ার বিষয়টি তাদের কাছে অস্বাভাবিক ঠেকে। এর আগেও বাস্তবতার নিরিখে বিবিএসের প্রকাশিত মূল্যস্ফীতির প্রতিবেদন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন পর্যবেক্ষকরা।
কেবল মূল্যস্ফীতি নয়, অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচক জিডিপি প্রবৃদ্ধির তথ্যেও রয়েছে অসংগতি। এভাবে একের পর এক সরকারি সংস্থার প্রশ্নবিদ্ধ পরিসংখ্যানের কারণে ব্যাহত হয়েছে সঠিক নীতি গ্রহণ। এতে সংকটে থাকা অর্থনীতি পুনরুদ্ধার দিন দিন আরো কঠিন হয়ে উঠেছে।
বিবিএসের পরিসংখ্যানের এ বেহাল দশার পেছনে দায়ী প্রধানত গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োজিত অদক্ষ ব্যক্তি এবং পরিসংখ্যানের রাজনৈতিকীকরণ। বণিক বার্তার এক প্রতিবেদনে জানা যায়, দেশে বানোয়াট পরিসংখ্যান বানানোর কাজটি করা হতো সাবেক এক পরিকল্পনামন্ত্রীর নেতৃত্বে। তিনিই ছিলেন কৃত্রিম পরিসংখ্যানের প্রধান পরিকল্পনাকারী। ২০১৪ সালে পরিকল্পনামন্ত্রী হিসেবে তিনি দায়িত্ব নেয়ার পর পরিসংখ্যান বিভ্রাট আরো প্রকট হয়। মূল্যস্ফীতিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে পাঁচ-ছয়জনের একটি সিন্ডিকেট। সেই সময় থেকে অভিযোগ উঠতে থাকে অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের তথ্য ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানোর। এর প্রভাবে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গেও বাড়তে থাকে পরিসংখ্যানগত ব্যবধান। এ প্রবণতা আওয়ামী লীগ সরকারের পরবর্তী মেয়াদগুলোয়ও অব্যাহত ছিল। অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকদের মতে, সংস্থাটিকে ব্যবহার করে জনসংখ্যা, জিডিপির আকার-প্রবৃদ্ধি থেকে শুরু করে অর্থনীতির প্রতিটি খাতেই ভুল ও প্রশ্নবিদ্ধ পরিসংখ্যান তৈরি ও উপস্থাপন করা হয়েছে।
যদিও বিবিএসের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে পরিসংখ্যান আইন, ২০১৩ প্রণয়ন করা হয়েছিল। জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে একই বছর বাস্তবভিত্তিক জাতীয় পরিসংখ্যান উন্নয়ন কৌশলপত্র (এনএসডিএস) প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। দুঃখজনকভাবে এসব উদ্যোগ সত্ত্বেও পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের পরিসংখ্যানের মান ক্রমে কমতে থাকে। ২০১৪ সালে বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত স্ট্যাটিস্টিক্যাল ক্যাপাসিটি ইন্ডিকেটরে বাংলাদেশের সার্বিক স্কোর ছিল ১০০-এর মধ্যে ৮০ আর পদ্ধতিগত স্কোর ৭০। কিন্তু এর পর থেকে দুটি স্কোরই ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে। ২০১৮ সালে সার্বিক স্কোর দ্রুত কমে ৬২-তে নেমে যায়। ২০২০ সালে নেমে আসে ৬০-এ, যেখানে দক্ষিণ এশিয়ার গড় স্কোর ছিল ৬৯। সে সময় মেথডোলজি বা পদ্ধতিগত সূচকে সবচেয়ে বড় পতনের মুখে পড়ে বাংলাদেশ। এ সূচকে ২০১৪ সালের ৭০ স্কোর থেকে ২০২০ সালে অর্ধেকের বেশি কমে ৩০-এ নেমে আসে। অর্থাৎ বিবিএসের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে। সঠিক পরিসংখ্যান পেতে হলে তাই বিবিএসের প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার প্রয়োজন। এর জন্য কাঠামোগত প্রতিবন্ধকতাগুলো খতিয়ে দেখতে হবে এবং স্বাধীন কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেও বিবিএসের পরিসংখ্যান যাচাই-বাছাই করা উচিত।
বিশ্লেষকদের মতে, সংস্থাটির পরিসংখ্যান প্রকাশে দক্ষতা ও পেশাদারত্বের অভাব রয়েছে। এখানে পেশায় দক্ষ লোকের অভাব রয়েছে। পরিসংখ্যানে ব্যক্তি নিয়োগ না করে সেখানে নিয়োজন পেয়েছে প্রশাসন ক্যাডারের লোকবল। তাছাড়া মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকায় সংস্থাটির জরিপের ফলাফল রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকতে পারেনি। আবার সংজ্ঞাগত পরিবর্তনের ফলে আগের জরিপের সঙ্গে নতুন জরিপের তথ্য অনেক সময় তুলনাও করা যায় না। এসব কারণে বিবিএসের পরিসংখ্যানের প্রতি বড় ধরনের অনাস্থা তৈরি হয়েছে। এসব অসংগতি দূর করতে প্রয়োজনে একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করতে হবে, যারা প্রতিনিয়ত বিবিএসের কার্যক্রমের ওপর নজর রাখবে। এ কমিশনে দক্ষ পরিসংখ্যানবিদদের আনতে হবে যারা পরিসংখ্যান প্রণয়নের পুরো প্রক্রিয়া তদারকি করবে এবং প্রয়োজনীয় ইনপুট দেবে।
সময়োচিত ও নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান সংগ্রহ, সংকলন এবং প্রকাশনা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে পরিসংখ্যান ব্যুরোকে শক্তিশালী করতে হবে। এর মূল উদ্দেশ্য হবে সঠিক, নির্ভরযোগ্য, আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন পরিসংখ্যান প্রণয়ন। এ লক্ষ্য পূরণে বিবিএস পরিচালিত প্রধান প্রধান জরিপসহ অন্যান্য পরিসংখ্যানগত কার্যক্রমের পরিচালনা পদ্ধতিকে যুগোপযোগী করা জরুরি। দ্রুততম সময়ে তথ্য সংগ্রহ, সংকলন, প্রক্রিয়াকরণ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে যথাসময়ে তথ্য বা রিপোর্ট প্রকাশ নিশ্চিত করতে হবে। কেননা দীর্ঘ বিরতি দিয়ে বিবিএসের জরিপ পরিচালনা ও ফলাফল প্রকাশের মাধ্যমে কারচুপি করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। বিবিএসে কর্মরত সব ধরনের জনবলকে পর্যাপ্ত দক্ষ করতে দেশে-বিদেশে নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
বিবিএসকে সংস্কারের মাধ্যমে পরিসংখ্যানের মান উন্নত করতে হবে। কোনো বিষয়ে পরিসংখ্যান বা সুষ্ঠু তথ্য ব্যবস্থাপনা থাকলে সরকারের জন্য ওই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়াও সহজ হয়। সঠিক পরিসংখ্যান জাতীয় অর্থনীতির লক্ষ্য নির্ধারণ, নীতি প্রণয়ন থেকে শুরু করে সার্বিক পরিস্থিতিকে সহজ করে তুলতে পারে। একই সঙ্গে তথ্যের যথার্থতা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য-বিনিয়োগেও সহায়ক হয়। বলা বাহুল্য, দীর্ঘদিন ধরে ভুল তথ্যের ভিত্তিতে নীতিনির্ধারণের কারণেই দেশের অর্থনীতির অবস্থা বর্তমানে ভঙ্গুর। এ অবস্থা থেকে শিগগিরই পরিত্রাণ প্রয়োজন। নয়তো সামষ্টিক অর্থনীতিতে আরো চ্যালেঞ্জ যুক্ত হবে নিকট ভবিষ্যতে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। বিবিএসকে দায়িত্বশীল হতে হবে সঠিক পরিসংখ্যান প্রণয়নে। বর্তমান সরকারেরও মনোযোগ দিতে হবে যাতে বিবিএস সঠিক তথ্য প্রকাশ করে। যে ক্রান্তিকালে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে, ভুল পরিসংখ্যান তাদের দায়িত্ব পরিচালনা আরো জটিল করে তুলতে পারে। তাই জরুরি ভিত্তিতে জাতীয় পরিসংখ্যান প্রণয়নকারী সংস্থার আমূল সংস্কার প্রয়োজন।