বন্যার ভয়াবহতা থামছে না কেন?
Share on:
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে সাম্প্রতিক বন্যায় ১২ জেলায় প্রায় ৬০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। আবহাওয়া দপ্তর থেকে অনুমান করা হয়েছিল, বৃষ্টিপাত কমলে দুই-তিন দিনের মধ্যে বন্যার পানি নেমে যাবে। কিন্তু দুই সপ্তাহ পরও পানি নেমে যায়নি।
আশঙ্কা করা হচ্ছে, জলাবদ্ধতা দীর্ঘায়িত হবে, ক্ষয়ক্ষতি বাড়বে; বাড়বে মানুষের দুর্ভোগ। প্রলম্বিত বন্যায় ত্রাণ বিতরণও কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, বন্যায় রাস্তাগুলো ডুবে গিয়ে গাড়ি চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। আবার নৌকা দিয়েও সবখানে যাওয়া যাচ্ছে না জলপথের গভীরতার অভাবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, এবারের বন্যা এতটা দীর্ঘস্থায়ী কেন? কেন পানি নামছে না? মূল কারণ ‘উন্নয়ন’। বলা চলে, আমরা আক্ষরিক অর্থে ‘উন্নয়নের জোয়ারে’ ভাসছি। উন্নয়নের নামে, দেখানোর জন্য আমরা যা করছি, তার মূল উপাদান হলো সড়ক অবকাঠামো; পাশাপাশি কিছু রেলপথ, শিল্প ও নগর অবকাঠামো। এসব করতে গিয়ে পরিবেশ, প্রতিবেশ, ভূত-ভবিষ্যৎ, হাওর, প্লাবনভূমি, জলা-জঙ্গল কিছুরই পরোয়া করা হয়নি। সর্বত্রই দেখা গেছে ‘আধুনিক প্রযুক্তি’ আর প্রকৌশলকেন্দ্রিক সমাধানের জয়জয়কার। উন্নয়নের মহৌষধ বলে কথা!
বাস্তবতা হলো, আমাদের দেশটা একটা নদী অববাহিকা অঞ্চল। দেশের বেশির ভাগ এলাকা প্লাবনভূমি– হয় নিচু জমিতে বর্ষাকালে কিছু সময়ের জন্য পানি জমে থাকে, নয়তো তার ওপর দিয়ে গড়িয়ে আরও ভাটিতে সমুদ্রের দিকে চলে যায়। এসবের মাঝখান দিয়ে তৈরি করা হয়েছে অসংখ্য রাস্তা; প্রায়ই আড়াআড়ি এবং পানি চলাচলের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না রেখেই। এর পাশাপাশি বন্যা নিয়ন্ত্রণের নামে তৈরি হয়েছে বাঁধ ও জলপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত করার অন্যান্য কাঠামো। যেমন জলকপাট বা স্লুইসগেট। এর ফলাফল হলো যখন উজান থেকে পানি আসে তখন তা এসব রাস্তা, বাঁধ বা প্রতিবন্ধকে বাধা পায় এবং তার পেছনে জমা হয়। এ জন্য একবার বেশি পানি জমা হলে তা সরতেও সময় বেশি লাগে। কারণ জলপ্রবাহের ব্যবস্থা নেই।
আমরা আসলে জালের মতো প্রতিবন্ধক দিয়ে আঞ্চলিক ‘পুকুর’ তৈরি করেছি, যা পানির অভাবে শুকনো থাকে। কিন্তু পানি এলেই ভরে যায়, আর মাঝখানে যা কিছু আছে সব ডুবিয়ে দেয়। এর আরেকটি প্রভাব হলো পানির সঙ্গে পলি এসে প্রতিবন্ধকের এক পাশে জমা হয়ে সেখানকার গভীরতা কমিয়ে দেয়। এতে সেখানকার পানি ধারণ ক্ষমতা কমে গিয়ে অল্প পানিতেই ডুবে যায়। আমাদের বিলগুলোর বেশির ভাগই এখন পলি জমে গভীরতা হারিয়েছে অথবা একেবারেই ভরাট করে ফেলা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে কৃষি বা মৎস্য চাষের জন্য সেগুলোর জলপ্রবাহ প্রতিহত বা পরিবর্তন করা হয়েছে। ফলে সেগুলো আর আগের মতো জল ধারণ করতে পারে না। প্রাকৃতিক ও খননকৃত খাল বেশির ভাগই দখল ও ভরাট হয়ে গেছে।
এসব ‘উন্নয়ন’ তো ছিলই; সাম্প্রতিক সময়ে যোগ হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় প্রকৌশলগত সমাধান। যেসব অবকাঠামো তৈরি করা হচ্ছে, সমুদ্রতলের উচ্চতা বাড়ার আশঙ্কায় সেগুলো স্বাভাবিক উচ্চতার চেয়ে ৮০ সেন্টিমিটার বা এক মিটার বেশি উঁচু করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ফলে আমরা আরও গভীর ‘পুকুর’ তৈরি করছি, যেখানে পানি আরও বেশি সময় জমে থাকছে। যদি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ে, অতিবৃষ্টি হয়, বরফ গলা পানির ঢল বন্যা সৃষ্টি করে; এসব রাস্তা কোনো কাজেই আসবে না বরং বন্যার ভয়াবহতা বাড়িয়ে দেবে।
এবারের বন্যার দুর্গতি এড়ানোর উপায় নেই। কিন্তু ভবিষ্যতে কি কিছু করার আছে? সমাধান আমাদের চোখের সামনেই। ঐতিহাসিকভাবে এ দেশের প্লাবনভূমি অঞ্চলে বাড়িঘর তৈরি হতো আশপাশের চেয়ে উঁচু জায়গায়। এতে বন্যার পানি লোকালয়ে ঢুকতে পারত না; আশপাশের নিচু অঞ্চলে জমে থাকত; নৌকায় যাতায়াত চলত। যেমনটা হাওর অঞ্চলে সচরাচর দেখা যায়।
আরও একটি অনুসরণযোগ্য বিষয় আছে। যদিও এখন বাঁধ; উঁচু রাস্তার কারণে বন্যা ও তাতে মানুষের দুর্ভোগ হচ্ছে; তবুও হাওরের অনেক অঞ্চলে পাকা রাস্তা করা হয়েছে আশপাশের জমির সমান উচ্চতায়। শুকনো মৌসুমে যখন পানি থাকে না তখন তাতে গাড়ি চলে, মানুষ সড়কপথে যাতায়াত করে আর বর্ষায় তা ডুবে যায়। তার ওপর দিয়ে অবাধে জল প্রবাহিত হয়, তখন নৌকা চলে। সেখানে রাস্তায় পানি উঠে যোগাযোগ বন্ধ হওয়া বা নৌকার অভাব বা নৌপথে যেতে না পারার সংকট পোহাতে হয় না।
আমাদের বন্যা সমস্যার যৌক্তিক সমাধান হলো পানিপ্রবাহের প্রতিবন্ধকতা দূর করা, সড়কপথের নির্ভরতা কমিয়ে নৌপথের ব্যবহার বাড়ানো, বিশেষ করে নিচু অঞ্চলে। খালগুলো পুনরুদ্ধার করতে পারলে জলপ্রবাহের যেমন সুবিধা হবে তেমন নৌপথেরও বিস্তৃতি ঘটবে।
আর যে কোনো ‘উন্নয়ন প্রকল্প’ নেওয়ার আগে পরিবেশ ও প্রতিবেশগত বিষয়গুলো আরও ভালোভাবে বিবেচনা করা অত্যাবশ্যক। তবে এসবের সাফল্যের জন্য আরও কিছু জিনিস অপরিহার্য। সেগুলো হলো সুশাসন, জবাবদিহি, স্থানীয় মানুষ ও তাদের ঐতিহ্যবাহী চর্চাকে গুরুত্ব দেওয়া, অভিজ্ঞতা, বিশেষত ভুল থেকে শেখা, অর্জিত জ্ঞান, অভিজ্ঞতা সংরক্ষণ এবং তার বিতরণ।
আমাদের দেশের চারদিকে যেহেতু আন্তর্জাতিক নদী, আর আমরা ভাটিতে, তাই বিশেষ করে।
প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে আমাদের বন্যা পূর্বাভাস সংক্রান্ত তথ্য আদান-প্রদান যেমন বাড়াতে হবে, তেমনই ভারত যেন যৌথ নদীর ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে চলে সে জন্য দ্বিপক্ষীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দৃঢ় অবস্থানে থেকে জোরালো কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে।