বন্যার্ত এলাকার শিশুরা দিন দিন একা হয়ে যাচ্ছে!
Share on:
মসজিদের ভেতর থেকে পানি নেমে গেছে। সিঁড়িতেও এখন আর পানি নেই। পেতে দেওয়া ইটের ওপর দিয়ে হেঁটে এলে থেমে থাকা বানের পচা পনিতে পা এখন আর ভেজে না। এক্কাদোক্কা খেলার ঢঙে ইটের ওপর পা ফেলে আট বছরের সুমন এসে বসে মসজিদের সিঁড়িতে।
ফজরের নামাজ পড়ে মুসল্লিরা চলে গেছেন যে যাঁর কাজে। সুমন একা একা বসে থাকে এই সিঁড়িতে। তার বাড়ির উঠানে পানি। সেই পানিতে সাপ নড়েচড়ে।
সুমনের মা দুই দিন ধরে হাসপাতালে আছে তার ‘গ্যাদা’ বোনকে নিয়ে। বোনের ডায়রিয়া হয়েছে। তারও হয়েছিল। বাবা গেছেন মায়ের কাছে। তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র সুমনের স্কুল থেকে পানি নেমে গেলেও কবে স্কুল খুলবে, সে জানে না। শুকনা জায়গার খোঁজে মসজিদের সিঁড়িতে আসার আগে সুমন স্কুলে গিয়েছিল। সব সুনসান; দু-একজন চেনাজানা মানুষের সঙ্গে দেখা হলেও সহপাঠী কারও দেখা মেলেনি। কারা যেন ঢাকা থেকে চিড়ামুড়ি নিয়ে এসেছে। তাকেও সেধেছিল। তার আর চিড়া খেতে মন চায় না।
এক হাত দিয়ে খসখসে আরেক হাত চুলকাতে চুলকাতে কথা চালিয়ে যায় সুমন। মাঝেমধ্যে পায়ের আঙুলগুলো ফাঁক করে ফাঙ্গাসে আক্রান্ত আঙুলে বাতাস লাগায়। সুমনের ধারণা, স্কুল খুলে দিলে তার বন্ধু–সহপাঠীরা একটা নিশ্বাস নেওয়ার জায়গা পেত। বই–খাতা সব পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে, তারপরও সে স্কুলে ফিরতে চায়। ‘বই নেই তো স্কুলে গিয়ে কী হবে?’ আমার প্রশ্নটা সুমনের কাছে বড় অদ্ভুত লাগে। সে উল্টো আমাকে প্রশ্ন করে, ‘স্কুলে কি শুধু পড়া হয়?’ সুমন বলতে থাকে, অনেক কিছু হয়। বন্ধুরা আসে, স্যাররা আসে। খেলা হয়, গান হয়।
‘গান হয়? তাহলে একটা গান শুনাও’—আমার আবদারের উত্তরে সুমন বলে, ‘তাইলে তো আমাদের খাড়াইতে হবে।’ বুঝতে অসুবিধা হয় না সে কোন গানের কথা বলছে। নিজেই বলে কত দিন ‘সোনার বাংলা’ গাওয়া হয় না!
সুমন তার শৈশব মিস করছে। পড়াশোনা, খেলাধুলা, বন্ধুদের সঙ্গে গল্পগুজব—কিছুই এখন নেই তার জগতে। বাড়িতে তার ফিরতে মন চায় না। ময়না নামে তার একটা বিড়াল ছিল, সেটারও কোনো খোঁজ নেই পয়লা দিন (বন্যা শুরুর দিন) থেকে। নানির দেওয়া একটা বকরি পুষত সে। নাম দিয়েছিল ‘টাইগার’। সেটা বিক্রি করতে হয় সুমনের প্রথম ডায়রিয়া হলে। ময়না নেই, টাইগার নেই, বই–খাতা নেই, স্কুল নেই, বন্ধু–সহপাঠীরাও বেপাত্তা; সে এখন কোথায় যাবে?
বোনের অসুখ না হলেও বাড়িতে সুমন তার মা–বাবাকে পেত না। বানের পানি কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের বড়রা বাড়িঘর মেরামত, ত্রাণসামগ্রী সংগ্রহ, পুনর্বাসনসহ অন্যান্য কাজে মন দেয়। এই সময় শিশুদের প্রতি নজর রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। শিশুদের সুরক্ষা শিক্ষা মনে হয় বিলাসিতা। শিশুরা ক্রমে একা হয়ে যেতে থাকে আর সুমনের মতো নিজের একটা জায়গা খুঁজতে থাকে। দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ, ঘরে পানিবন্দী হয়ে থাকা, খেলাধুলা করতে না পারা কিংবা পরিবার থেকে দূরে থাকার কারণে তারা এক বিষণ্ন মানসিক পরিস্থিতির প্যাঁচে পড়ে যায়।
এ বন্যা অনেক ক্ষতের জন্ম দিয়েছে, কিন্তু শিশুদের মনেও যে বড় ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে, তার খবর কি আমরা জানি? সে ক্ষত দূর করতে হলে যত দ্রুত সম্ভব তাদের শৈশব ফিরিয়ে দিতে হবে। একাকী শুকনা সিঁড়ি থেকে তাকে তার স্কুলে খেলার মাঠে সঙ্গীদের কাছে নিয়ে যেতে হবে।
পরিস্থিতির প্যাঁচে পড়ে অনেক শিশুর স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। অতীতের অভিজ্ঞতা সাক্ষ্য দেয়, দুর্যোগ–পরবর্তী সময়ে আমাদের সাড়াদান বা পুনর্বাসন পদক্ষেপগুলোয় শিশুদের চাহিদাগুলো আমলে না নেওয়ার কারণে স্কুল থেকে ঝরে পড়া, শিশুশ্রম, শিশু পাচার এবং মেয়েশিশুদের ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই যেকোনো দুর্যোগ–পরবর্তী ত্রাণ বা পুনর্বাসনের চূড়ান্ত লক্ষ্য হতে হবে—
১. সব শিশুর নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফেরত যাওয়া, ২. নতুন করে কোনো শিশু যেন শিশুশ্রমে জড়িয়ে না পড়ে, তা নিশ্চিত করা, ৩. কোনো মেয়েশিশু যেন বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে না পড়ে তা নিশ্চিত করা, ৪. শিশু যেন বাস্তুচ্যুত না হয় বা পাচার হওয়ার ঝুঁকিতে না থাকে, তা নিশ্চিত করা।
ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিষ্কার, টিউবওয়েলগুলো চালু করা, আঙিনা পরিষ্কার, ঢোকার রাস্তা ঠিক করা ইত্যাদি কাজের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন ৪ (পিইডিপি ৪)–এর অধীন বিস্তারিত প্রক্রিয়া এবং বরাদ্দ দেওয়া আছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ টাকা ছাড়ের ফ্যাঁকড়া আমাদের সবার জানা। তাই চাতকের মতো তাকিয়ে থাকলে শিশুরা চলে যাবে লেখাপড়া ছেড়ে। স্থানীয় উদ্যোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো চালু করা এখন এক নম্বর অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।
বই যে নেই!
বই ও লেখাপড়ার সামগ্রী উপদ্রুত এলাকায় সবার আগে নষ্ট হয়েছে। পত্রিকায় দেখলাম, একজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক বলছেন, ‘বইপত্রের জন্য শিক্ষা উপদেষ্টা বরাবর চিঠি দেওয়া হয়েছে।’ এর চেয়ে হাস্যকর কথা আর কী হতে পারে!
প্রচলিত ব্যবস্থা অনুযায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর চাহিদা হিসেবে বছরের শুরুতে বই পাঠানো হয়। সব বই বিতরণ হয় না। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি—এমন জেলা–উপজেলা থেকে এসব উদ্বৃত্ত বই সংগ্রহ করে বিতরণ করা জন্য শিক্ষা কর্মকর্তাই যথেষ্ট।
বিকল্প স্কুল
বন্যা–শরণার্থীরা চলে না যাওয়ায় বা অন্য কোনো কারণে যদি স্কুলের ইমারতে শিক্ষার্থীদের আনা সম্ভব না হয়, তাহলে অস্থায়ী বিদ্যালয় বা শিশুবান্ধব কেন্দ্রের ব্যবস্থা করতে হবে, তবে শিশুবান্ধব কেন্দ্র গঠন ও পরিচালনায় স্কুলকে সম্পৃক্ত করতে হবে; তাদের খেলাধুলা ও বিনোদনের সুযোগ দিতে হবে।
সুমনরা কি ক্ষুধার্ত
ভেজা মসজিদের শুকনা সিঁড়িতে বসে থাকা সুমনকে ক্ষুধার্ত মনে হয়নি। কিন্তু তার খসখসে হাত–পা, পায়ের আঙুলের ভাঁজে ফাঙ্গাস ও জিবে ঘা দেখে মনে হয়েছে, তার শরীরে পুষ্টির ঘাটতি শুরু হয়েছে। ভিটামিন সি নেই তার খাদ্যতালিকায়। স্কুলে বা শিশুবান্ধব কেন্দ্রে প্রতিটি শিশুকে একটি কলা, একটি ডিম, একটি পেয়ারা বা আমড়া অথবা এক টুকরা জাম্বুরার ব্যবস্থা করা যায়। এসব ফল দুর্গত এলাকায় পাওয়া যাচ্ছে এবং মৌসুমের ফল হিসেবে সস্তাও বটে। একটা হিসাবে দেখা যায়, আধা কেজির একটা ব্ল্যাক ফরেস্ট কেকের দাম দিয়ে তিন মাস একটি শিশুর পুষ্টির চাহিদা মেটানো সম্ভব।
শিশুকে মা–বাবার কাছে ফিরিয়ে আনুন
অনেকেই শিশু ও কিশোরীদের বন্যামুক্ত এলাকায় স্বজনদের তত্ত্বাবধানে রেখেছেন। পরিবার থেকে দূরে শিশু-কিশোরেরা নানা ধরনের যৌন নির্যাতনের শিকার হতে পারে। তাদের দ্রুত পরিবারে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে হবে।
শিশুদের ছবি ব্যবহারে সংযত হতে হবে
অনেক ক্ষেত্রে চাঞ্চল্যকর সংবাদ বা মনোযোগ আকর্ষণের জন্য শিশুদের ছবি ও ভিডিও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অসতর্কভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, শিশুদের ছবি ও ভিডিও ব্যবহার করা থেকে পুরোপুরি বিরত থাকতে পারলে সবচেয়ে ভালো হয়। অনেকেই ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ ব্যবহার করে শিশুদের কৃত্রিম অসহায়ত্বের ছবি ব্যবহারের দিকে ঝুঁকেছেন। এসব প্রচেষ্টা শিশুদের প্রকৃত নাজুকতা ও চাহিদার প্রতিনিধিত্ব করে না; বরং গুলিয়ে ফেলে বাস্তবতা আর রং–তামাশাকে। তহবিল সংগ্রহে এসব প্রচারণা কাজে এলেও আখেরে শিশুদের কল্যাণ হয় না।
এ বন্যা অনেক ক্ষতের জন্ম দিয়েছে, কিন্তু শিশুদের মনেও যে বড় ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে, তার খবর কি আমরা জানি? সে ক্ষত দূর করতে হলে যত দ্রুত সম্ভব তাদের শৈশব ফিরিয়ে দিতে হবে। একাকী শুকনা সিঁড়ি থেকে তাকে তার স্কুলে খেলার মাঠে সঙ্গীদের কাছে নিয়ে যেতে হবে।