বন্যাপ্লাবিত মানুষের পাশে ‘এক দল চপার পাইলট’
Share on:
২৩ আগস্ট, ২০২৪। সকাল ৮টা। বন্যাপ্লাবিত ফেনীর আকাশে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিশেষায়িত ইউনিট ‘আর্মি এভিয়েশন গ্রুপ’-এর হেলিকপ্টার বেল ৪০৭। ফেনী শহর পেরিয়ে হেলিকপ্টারটি উত্তরদিকে পরশুরাম-ফুলগাজীর দিকে যায়। ফেনীতে এ যেন নুহের প্লাবন।
নিচের দিকে তাকিয়ে অলিভ গ্রিন ওভারঅল পরা পাইলট মেজর মো. আমান উল্লাহ আল জুমান বিস্মিত হলেন। পরিস্থিতি জানিয়ে হেডফোনে কুমিল্লা গ্রাউন্ডকে বার্তা দিলেন। ‘আই অ্যাম ফ্লাইং অন দ্য সি’– ‘আমি সমুদ্রের ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছি।’ হঠাৎ আসা হেলিকপ্টারের শব্দে ফুলগাজীর পানিবন্দি বিপন্ন মানুষ আশার আলো দেখতে পেল।
চপারটি (সামরিক বাহিনীতে কথ্য ভাষায় হেলিকপ্টারকে চপার বলা হয়) পানিতে নিমজ্জিত ফুলগাজী পাইলট স্কুল মাঠে ল্যান্ড করে। শুরু হলো হেলিকপ্টারের মাধ্যমে দ্রুততার সঙ্গে বন্যার্ত মানুষের উদ্ধার ও ত্রাণ বিতরণ অভিযান। পরে এই মিশনে যুক্ত হয় বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর বিশাল হেলিকপ্টার বহর, বিজিবি, র্যাব ও কয়েকটি প্রাইভেট এভিয়েশন কোম্পানির হেলিকপ্টার। এ রেসকিউ মিশন পরিচালিত হয় কুমিল্লা ও নোয়াখালীতেও (প্রায় ৩০০ সর্টি বা দল)।
উজানে ভারতের ত্রিপুরা থেকে নেমে আসা ঢল ও কয়েক দিনের প্রবল বর্ষণে ১৯-২০ আগস্ট দেশের ১২টি জেলায় আকস্মিক বন্যা দেখা দেয়। এতে পানিবন্দি হয়ে ক্ষতির মুখে পড়ে প্রায় ৬০ লাখ মানুষ। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা হয় ফেনী জেলার। সেখানে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ২১ আগস্ট ফেনীতে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়।
নৌবাহিনী ফেনী জেলায় নৌযান ব্যবহার করে অসংখ্য বন্যার্তকে সেবা দেয়। আকাশপথে বন্যাদুর্গত এলাকা পর্যবেক্ষণসহ ত্রাণ সহায়তা পৌঁছাতে কাজ করে বিমানবাহিনী। প্রশাসনসহ পুলিশ, বিজিবি, কোস্টগার্ড, র্যাব, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী এবং ফায়ার সার্ভিস ব্যাপকভাবে কাজ করে।
এই বিপদের দিনে তাদের বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ছাত্রসহ স্বেচ্ছাসেবী ও সাধারণ মানুষ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে গণত্রাণ কার্যক্রমে মানুষের ঢল নেমেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে। বন্যা ঐক্যবদ্ধ করেছে সমগ্র জাতিকে। এই ঐক্য ধরে রাখতেই হবে।
ফেনীতে জলমগ্ন স্থলভাগে উদ্ধার কার্যক্রমে বিভিন্ন ধরনের নৌকা অসাধারণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষত সেনাবাহিনীর ডিভিশন ইঞ্জিনিয়ার্স ব্যাটালিয়নের অসংখ্য স্পিডবোট (ট্রাইসার্ক বোট), নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের বিভিন্ন ধরনের নৌকা এবং চট্টগ্রাম থেকে আসা কর্ণফুলীর শত শত সাম্পান পানিবন্দি মানুষের কাছে হয়ে ওঠে ‘রিভার অ্যাঞ্জেল’ বা ‘নদী থেকে উঠে আসা দেবদূত’।
দুর্যোগকালীন উদ্ধার অভিযান বা রেসকিউ মিশনে হেলিকপ্টার খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই মিশনে তরুণ সামরিক পাইলটরা যে পেশাগত দক্ষতা, সাহস ও মানুষের প্রতি মমতা দেখিয়েছেন, তা উদাহরণ হয়ে থাকবে।
১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ‘অ্যালুয়েট-৩’ হেলিকপ্টারটি অসাধারণ ভূমিকা রেখেছিল। ১৯৭৪ সাল থেকে বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।
বন্যাপ্লাবিত ফেনী জেলায় কোনো কোনো প্রত্যন্ত অঞ্চলে হেলিকপ্টারই ছিল একমাত্র ভরসা। ২২ আগস্ট বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টার বন্যাকবলিত এলাকায় পর্যবেক্ষণ (রেকি) মিশন পরিচালনা করে। ২৩ আগস্ট সকাল থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ‘আর্মি এভিয়েশন গ্রুপ’ কার্যক্রম শুরু করে। এদিন আর্মি এভিয়েশনের পাইলট মেজর মো. আমান উল্লাহ আল জুমান এবং কো-পাইলট মেজর সোহরাব হোসেন সবুজ বেল ৪০৭ জিএক্সআই হেলিকপ্টার নিয়ে ‘ফাস্ট রেসপন্ডার’ হিসেবে ফুলগাজী উপজেলায় পৌঁছেন। পাইলটরা জানতে পারেন, অনেক অসহায় মানুষের মধ্যে সুমি আকতার নামে একজন অন্তঃসত্ত্বা অত্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় রয়েছেন। ওই নারীকে জরুরি ভিত্তিতে উদ্ধার করে তারা হেলিকপ্টারে কুমিল্লা সেনানিবাসে নিয়ে আসেন। ওই দিনই কুমিল্লা সিএমএইচে তিনি এক পুত্র সন্তান জন্ম দেন। শিশুটির নাম রাখা হয় ওমর ফারুক। দুই তরুণ পাইলট পরে নবজাতক ওমর ফারুককে দেখতে গিয়েছিলেন। সুমি আকতার স্বপ্ন দেখেন, তাঁর সন্তান ওমর ফারুক একদিন সেনাবাহিনীতে যোগদান করবে।
এবারের মিশনে চপার পাইলটরা অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করেছেন: পানির ওপর হোভারিং করা অবস্থায় উদ্ধার, নিমজ্জিত মাঠে ল্যান্ডিং, ছোট আকৃতির ছাদে অবতরণ, সংকীর্ণ স্থানে ল্যান্ডিং, বাসকেট ফেলে উদ্ধার (হোয়েস্ট অপারেশন) কার্যক্রম ইত্যাদি। হেলিকপ্টার থেকে ত্রাণসামগ্রী এয়ার ড্রপ করা হয়েছে নিরাপদ কৌশলে। এবার আর্মি এভিয়েশন গ্রুপ (১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত) প্রথমবারের মতো অনেক হেলিকপ্টার ব্যবহার করে উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতা পরিচালনা করেছে। উল্লেখ্য, আর্মি এভিয়েশনের তিনটি হেলিকপ্টার কঙ্গো মিশনেও নিয়োজিত। এ ছাড়াও প্রথমবারের মতো বেশ কয়েকটি প্রাইভেট এভিয়েশন কোম্পানির হেলিকপ্টার ত্রাণ তৎপরতায় অংশ নেয়, যা অত্যন্ত প্রশংসনীয় উদ্যোগ।
এবারের বন্যায় দুর্গতদের উদ্ধারকাজে সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনীর অনেক সদস্য অসাধারণ উদাহরণ তৈরি করেছেন। মানুষের মন জয় করেছেন। কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার বন্যার্তদের উদ্ধারে সেনাবাহিনীর নবীন অফিসার লেফটেন্যান্ট মো. বায়েজিদ বোস্তামী তেমনই এক অনুপ্রেরণাময় উদাহরণ। ২২ আগস্ট বুড়িচং উপজেলায় বন্যার্তদের উদ্ধারকার্যে নিয়োজিত হয়ে লে. বায়েজিদ ২৯ আগস্ট পর্যন্ত ৩৫০ জনকে উদ্ধার করেন।
ফটিকছড়ির ভুজপুর এলাকায় হাঁটু গেড়ে সিঁড়ি বানিয়ে নারীদের ট্রাকে উঠতে সাহায্য করেছেন আর্টিলারি বাহিনীর লে. করপোরাল কাজী সুমন। কোনো কোনো স্থানে লে. কর্নেল, কর্নেল পদবির কর্মকর্তারাও ত্রাণসামগ্রী কাঁধে বহন করেছেন। এসব ‘মানবিক গল্প’ গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। ভয়াবহ বন্যায় সামরিক বাহিনীর মানবিক কার্যক্রমে জনগণের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে।
এবার ফেনীর বিভিন্ন বিষয় ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম অবস্থানের কারণে ফেনীর কৌশলগত গুরুত্ব ও এর দুর্বলতা (ভালনারাবিলিটি)। সীমান্তের খুব কাছে অবস্থিত অঞ্চল বাংলাদেশের একটি ‘সফট বেলি’। এ অঞ্চলের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।
পানি নেমে যাওয়ার পর বন্যার বীভৎস ক্ষত বেরিয়ে এসেছে। লাখ লাখ মানুষ সর্বস্ব হারিয়েছে, বিশেষত কৃষকরা। তবে বাংলাদেশের মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। আশা করি, আগামী কয়েক মাসেই ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ আবার উঠে দাঁড়াবে। তবে বর্তমান পুনর্বাসন পর্বে সরকার ও বেসরকারি উদ্যোগগুলোকে ব্যাপকভাবে তাদের পাশে থাকতে হবে। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘মানুষ বড়ো কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও’। এ ক্ষেত্রে কোনো দপ্তরের দায়িত্বহীন আচরণ বা ঢিলেঢালা ভাব গ্রহণযোগ্য হবে না। নতুন সরকারকে বন্যা-পরবর্তী পুনর্বাসন কাজে সফল হতেই হবে।
গোমতী, ফেনী, মুহুরী নদীর তীরে আবার ফুটবে অপরূপ কাশফুল-শেফালি। ‘ভাটির বাঘ’খ্যাত ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী ও কৃষক অন্তঃপ্রাণ শমসের গাজীর স্মৃতিধন্য ফেনী-নোয়াখালীর লড়াকু মানুষ আবার জেগে উঠবে। বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানো সশস্ত্র বাহিনীর সাহসী পাইলটসহ সব বাস্তব নায়ককে অভিবাদন।