বৈদেশিক শ্রমবাজার বিকাশে উদ্যোগ নিন
Share on:
বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি বৈদেশিক শ্রমবাজার থেকে প্রাপ্ত রেমিট্যান্স ও তৈরি পোশাক খাতের রফতানি আয়। এ দুই আয়ের উত্থান-পতনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। তাই এ দুই খাতকে বলা যায় বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণভোমরা।
অস্তিত্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত হলেও বৈদেশিক এ শ্রমবাজার ঘিরে রয়েছে ব্যাপক নৈরাজ্য। বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় এ শ্রমবাজার সরকারিভাবে পরিচালনার চেষ্টা হলেও মূলত শ্রমবাজারে সফলতা আসে প্রাইভেট সেক্টরের হাত ধরেই। মুক্তবাজারের রীতি অনুযায়ীই মুনাফা অর্জনের প্রণোদনায় ব্যক্তি খাতের ব্যবসায়ীরা প্রতিনিয়ত সন্ধান করে চলছেন বিদেশে নতুন শ্রমবাজার এবং আকৃষ্ট করছেন লাখ লাখ চাকরিপ্রত্যাশীকে। কিন্তু প্রাইভেট সেক্টরের এ স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় দুঃখজনকভাবে সরকারি রেগুলেটরি প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কলাকৌশলে সৃষ্টি হয় সিন্ডিকেট, ব্যাহত হয় প্রতিযোগিতা যা ক্ষতি করে পুরো সেক্টরকেই।
বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের ১৭৬টি দেশে কাজের জন্য মানুষ যায়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে ১১ দশমিক ৯৬ লাখ শ্রমিক কাজের উদ্দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যমতে, ২০২২-২৩ সালে ১১ দশমিক ৩৭ লাখ শ্রমিক কাজের উদ্দেশ্যে বিদেশ যান। ২০২৪ অর্থবছরে প্রায় ৪৪ শতাংশ অভিবাসী কর্মীর গন্তব্য ছিল সৌদি আরব এবং ২২ শতাংশের গন্তব্য ছিল মালয়েশিয়ায়। ২০২৪ অর্থবছরের শেষ দিন ৩০ জুনের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ ২৪ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে।
বাংলাদেশী শ্রমিকদের সবচেয়ে বড় গন্তব্য মধ্যপ্রাচ্য ও পূর্ব এশিয়া। বাংলাদেশী শ্রমিকরা মূলত কাজ করেন নির্মাণ শ্রমিক, কৃষি শ্রমিক, বৃক্ষরোপণ, কারখানা, পরিচ্ছন্নতা কর্মী ও সেবা খাতের রেস্টুরেন্ট, কফিশপ, হোটেল, ছোট দোকান ইত্যাদিতে সাধারণ কর্মী হিসেবে। এসব শ্রমিকের মধ্যে দক্ষ শ্রমিকের সংখ্যা খুবই কম ও বাংলাদেশে যে মানদণ্ডে দক্ষতা নিরূপণ করা হয় তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বৈশ্বিক মানদণ্ডে টেকে না।
বর্তমান অবস্থায় বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজার বিস্তৃত করতে প্রয়োজন কিছু কাঠামোগত সংস্কার।
১) প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সংস্কার সাধন: প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রবাসীদের কল্যাণ সাধনের জন্য কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় বাংলাদেশী শ্রমিকের বিদেশযাত্রায় পদে পদে অযৌক্তিক বাধার সৃষ্টি করে। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন জনশক্তি অধিদপ্তরের প্রধান কাজ হলো বিদেশী শ্রমিকদের ক্লিয়ারেন্স প্রদান। দুঃখজনক হলেও সত্য, এই ক্লিয়ারেন্স এতটাই অস্বচ্ছ ও দীর্ঘসূত্রতার জন্ম দেয় যে এটি একজন শ্রমিকের বিদেশযাত্রার সময়কে নষ্ট করে ফেলে। বাংলাদেশের শ্রমবাজারের বিভিন্ন সিন্ডিকেটও সৃষ্টি হয় এই ক্লিয়ারেন্সের নামে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, গত বছর মালয়শিয়ার শ্রমবাজারে যে ১০০ লাইসেন্সের সিন্ডিকেট তৈরি হয় তা কার্যকর হয় মূলত এই ক্লিয়ারেন্সের মাধ্যমে। কারণ মালয়েশিয়ার প্রায় পাঁচ লাখ শ্রমিকের জন্য মন্ত্রণালয় কেবল এ ১০০ লাইসেন্সকেই ক্লিয়ারেন্স দিয়েছে।
২) বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসের সংস্কার সাধন: বাংলাদেশী শ্রমিকপ্রধান দেশগুলোর বিদেশে বাংলাদেশী দূতাবাসের একটি বড় কাজের অংশ সেখানে অবস্থানরত শ্রমিকদের নাগরিক সুবিধা প্রদানের ব্যবস্থা করা। তাছাড়া আরেকটি কাজ হলো বিদেশে কোনো কোম্পানি বাংলাদেশী শ্রমিকদের জন্য চাহিদাপত্র পাঠালে তা যাচাইপূর্বক সত্যায়িত করা। আপাতদৃষ্টিতে এ কাজকে প্রশংসনীয় ও বাংলাদেশী শ্রমিকবান্ধব মনে হলেও এ সত্যায়নকে ঘিরে চলে মিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হাইকমিশন থেকে প্রতিনিধি কোম্পানি ভিজিট করে না। এ সত্যায়নপ্রাপ্তির প্রধান উপায় শ্রমিকের সংখ্যানুপাতে অর্থ প্রদান ও প্রভাবশালীদের চাপ। তাছাড়া এ সত্যায়ন জন্ম দেয় দীর্ঘসূত্রতার যা বাংলাদেশী শ্রমিককে বঞ্চিত করে তার প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায়। সবচেয়ে বড় বিষয়, একটি কাজের সত্যায়ন হওয়ার পর হাইকমিশন থেকে ই-মেইল আসে বিএমইটিতে যে ই-মেইল ম্যানুয়াল উপায়ে চেক করে ভিসাসহ পাসপোর্ট জমা করে ক্লিয়ারেন্স প্রদান করা হয়। আমাদের পার্শ্ববর্তী নেপাল, ভারত, পাকিস্তান কিংবা শ্রীলংকা আমাদের চেয়ে অনেক সহজ প্রক্রিয়ায় এ বিষয়গুলো সেটল করে, যার কারণে তারা শ্রমিক পাঠানোয় আমাদের চেয়ে এগিয়ে থাকে।
৩) শিক্ষার সঙ্গে শ্রমবাজারের সমন্বয় সাধন: আমাদের লাখ লাখ বেকার যুবক কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের লিবারাল আর্টসের ডিগ্রি নিয়ে প্রত্যাশা করে বিদেশে ভালো চাকরি পাবেন। অথচ যেকোনো শ্রমবাজারেই টেকনিক্যালি দক্ষ লোকদের চাহিদাই সবচেয়ে বেশি। সুন্দর জীবনদর্শনের জন্য অবশ্যই লিবারাল আর্টসের গুরুত্ব আছে কিন্তু শ্রমবাজারে দরকার প্রকৌশলগত দক্ষ জনশক্তি। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে এমন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে যাতে বিশালসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে বাজারের চাহিদা উপযোগী করে সৃষ্টি করা যায়।
৪) বাংলাদেশী শ্রমিকদের ইতিবাচক ব্র্যান্ডিং: বিদেশে বাংলাদেশী শ্রমিকদের একটি কমন ব্র্যান্ডিং হলো বাংলাদেশী শ্রমিকদের দিয়ে সস্তায় অনেক পরিশ্রমের কাজ করিয়ে নেয়া যায়। বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশী শ্রমিকের জন্য এই ব্র্যান্ডিং একটি নেতিবাচক ঘটনা। এর কারণে বাংলাদেশী দক্ষ শ্রমিকও ভালো বেতনে ভালো কাজ পান না। একই সঙ্গে বাংলাদেশী শ্রমিককে উপযুক্ত পারিশ্রমিকও দেয়া হয় না। বাংলাদেশী শ্রমিকদের দক্ষতাভিত্তিক ব্র্যান্ডিং করা গেলে আমাদের দরকষাকষির ক্ষমতা বাড়বে ও বর্তমানের চেয়ে বেশি বেতনে কাজ করতে পারবেন তারা। এতে প্রবাসীদের আয় বাড়বে যা তাদের জীবনমান যেমন বাড়াবে তেমনি বাড়বে রেমিট্যান্স আয়।
৫) শ্রমিক প্রেরণে প্রতিযোগিতা নিশ্চিতকরণ: বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর জন্য বাংলাদেশে মন্ত্রণালয় কর্তৃক লাইসেন্সকৃত প্রায় ২ হাজার ৮০০ এজেন্সি রয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এজেন্সিগুলো স্বাধীনভাবে বিদেশে শ্রমিক পাঠাতে পারে না। কারণ প্রতিটি দেশের জন্যই বিভিন্ন উপায়ে প্রতিযোগিতার পথ রোধ করে রাখা হয়েছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরবে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক অনুমোদিত হলেই শ্রমিক পাঠানো যায় না। ঢাকার সৌদি দূতাবাস থেকে নিতে হয় আবেদন আইডি ও পাসওয়ার্ড, যা কিছুদিন আগেও লাইসেন্সপ্রতি ২৫ হাজার মার্কিন ডলারে নিতে হয়েছে। তাছাড়া সিঙ্গাপুরের শ্রমবাজারে রয়েছে নয়টি ট্রেনিং সেন্টার যাদের সার্টিফিকেট ছাড়া সিঙ্গাপুরে শ্রমিক পাঠানো যায় না এবং দক্ষতার এই সার্টিফিকেট বিক্রি হয় অবিশ্বাস্য উচ্চ মূল্যে যা কখনো কখনো ৫-৬ লাখ টাকাও ছাড়িয়ে যায়। মালয়েশিয়ার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা বন্ধ করা হয়েছে বাংলাদেশের কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর মাধ্যমে, যারা ২০১৭ সালে ১০টি লাইসেন্সের সিন্ডিকেট করে ও ২০২২ সালে ১০০ লাইসেন্সের সিন্ডিকেট করে কর্মীপ্রতি দেড় লাখ টাকা অতিরিক্ত হাতিয়ে নেয়। সম্প্রতি লিবিয়ায় শ্রমবাজার চালু হওয়ার কথা থাকলেও সিন্ডিকেট সৃষ্টির জন্য কিছু এজেন্সির তৎপরতার কারণে বাজারটি চালু হওয়াই এখন প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
৬) শ্রমিক প্রেরণে অংশীজনদের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও বিদ্বেষ কমানো: জনশক্তি রফতানি খাতের অংশীজনদের মধ্যে রয়েছে পারস্পরিক আস্থার সংকট। এ খাতের মালিক ও শ্রমিকের মধ্যে রয়েছে একাধিক এজেন্সি ও সরকারি সংস্থার বিস্তৃত নেটওয়ার্ক। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এ নেটওয়ার্কের প্রয়োজনীয়তা এড়ানো না গেলেও এটির কারণে বিপত্তি তৈরি হয়। বিপুল সংখ্যক শ্রমিকের ক্যাশ লেনদেনের কারণে দুর্নীতির পরিমাণও বেশি এবং সংগত কারণেই অনাস্থা তৈরি হয়। সমাজেও রয়েছে এ খাতের অংশীজনদের প্রতি ব্যাপক বিদ্বেষ। এ কারণে স্বাভাবিকভাবেই এক অস্থির অবস্থার মধ্য দিয়ে পুরো সেক্টরের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। একটি স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এ সেক্টরের অংশীজনদের মধ্যে বিদ্বেষ কমাতে পারলে আরো বেশিসংখ্যক শ্রমিক অল্প খরচে বিদেশ যেতে পারবেন।
৭) নতুন দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সরকারি উদ্যোগ: নতুন দেশে কর্মসংস্থান তৈরি টেকসই বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সবচেয়ে কার্যকর উপায়। বাংলাদেশের অনেক যুবক বিভিন্ন অবৈধ উপায়ে ইউরোপে পাড়ি জমাতে গিয়ে যাত্রাপথে জীবন হারান। অথচ ২০২২ সালে ইউরোপের রোমানিয়া বাংলাদেশে অস্থায়ী ভিসা সেন্টার খুললে সেখানে ক্ষমতাসীন রাজনীতিতে যুক্ত কিছু ব্যবসায়ী রোমানিয়ান কর্মকর্তাদের জিম্মি করে ফেলেন। এ অবস্থায় রোমানিয়া বাংলাদেশে তাদের ভিসা কার্যক্রম স্থগিত করে ও অফিস গুটিয়ে চলে যায়। যেখানে বাংলাদেশ সরকারের ঘোষিত নীতি শ্রমবাজারের বহুমাত্রিকীকরণ সেখানে বাংলাদেশ সরকার ইউরোপের ভিসা সেন্টারের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়। তাছাড়া পূর্ব ইউরোপের বেশির ভাগ দেশের বাংলাদেশে দূতাবাস না থাকায় বাংলাদেশী শ্রমিকদের চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশী শ্রমিকরা সেখানে যেতে পারছেন না।
৮) অভিবাসন খরচ নিয়ে সরকারের দ্বৈধতা: সরকার বিএমইটিতে প্রতিটি দেশে অভিবাসন ব্যয়ের সর্বোচ্চ খরচের ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, সরকারের প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকই ব্যয়ের দুই গুণ ঋণ দেয় বিদেশ গমনের জন্য। তার মানে মানুষ যে সরকারি খরচের চেয়ে বেশি টাকা খরচ করে বিদেশ যায় তা সরকার জানে এবং এর জন্য সহজ শর্তে ফাইন্যান্সও করে। সরকারের এ ধরনের প্রচ্ছন্ন দ্বৈধতার কারণে অভিবাসন ব্যয় বাড়ে।
বাংলাদেশে এখন কর্মক্ষম জনশক্তি যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। এ জনশক্তিকে এখন কাজে লাগাতে না পারলে ভবিষ্যতে কর্মক্ষম জনশক্তির সংকট হবে। তখন চাইলেও অর্থনৈতিক উন্নয়নে তাদের কাজে পাওয়া যাবে না, বয়স্ক লোকের সংখ্যা বেড়ে যাবে। তাই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ধরে রাখতে হলে জরুরি ভিত্তিতে বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর দৃশ্যমান সব বাধা দূর করতে হবে। সংস্কারের ক্ষেত্রে উল্লিখিত পয়েন্টগুলো গুরুত্বসহকারে নেয়া যায়।