বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সংস্কারে উদ্যোগ নিন
Share on:
বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ স্থগিত ঘোষণা করে ১৮ আগস্ট এক আদেশে বলা হয়, এ আইনের অধীনে সকল প্রকার নেগোসিয়েশন, প্রকল্প বাছাই বা প্রক্রিয়াকরণ এবং ক্রয় প্রক্রিয়াকরণ কার্যক্রম আপাতত বন্ধ থাকবে।
তবে এ আইনের অধীন ইতোমধ্যে সম্পাদিত চুক্তির আওতায় গৃহীত সব কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। অন্তর্বর্তী সরকারের এই সময়োপযোগী উদ্যোগ সাধুবাদযোগ্য। একই সঙ্গে এ প্রকল্পের অধীনে সম্পাদিত কার্যক্রম চলমান না রেখে বন্ধ অথবা এসব প্রকল্প পুনর্মূল্যায়নপূর্বক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা জরুরি। কারণ এ আইনের অধীনে সম্পাদিত চুক্তিগুলো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ভিত্তিতে হয়নি।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত যে কোনো দেশের জাতীয় অর্থনীতির প্রধানতম লাইফ লাইন। বলা হয়, কোনো দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত যতটুকু টেকসই, সেই দেশের অর্থনীতি ততটুকু টেকসই। বিগত সরকারের শাসনামলে এ খাতই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল। তবে দৃশ্যমান, বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হলেও খাতটি সংকটাপন্ন রয়ে গেছে।
সংকটের মূলে রয়েছে সরকারের জ্বালানি খাত উন্নয়নের দর্শন বা নীতিগত অবস্থান। এ অবস্থানের পরিষ্কার প্রতিফলন ঘটে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার কর্তৃক বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ পাস করার মধ্য দিয়ে। প্রথমে দুই বছরের জন্য করা হলেও পরে আইনটির মেয়াদ দফায় দফায় বাড়ানো হয়। সর্বশেষ ২০২১ সালে আরও পাঁচ বছরের জন্য আইনটির মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৬ পর্যন্ত করা হয়। এটিকে বলা হয় বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ‘দায়মুক্তি আইন’। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির বাইরে অন্যান্য খাতেও দায়মুক্তি নেওয়ার ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছিল আইনটি।
যেমন ছোট্ট অথচ শক্তিশালী এই আইনের ৩ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে যাই থাকুক না কেন, এই আইনের বিধানাবলি প্রাধান্য পাবে।’ এই ধারার বলে গণক্রয় আইনের কার্যকারিতা উপেক্ষা করা হয়েছে।
এই আইনে যেমন সরকারি সব প্রতিষ্ঠানকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির জন্য যে কোনো প্রস্তাব গ্রহণের ক্ষমতা দেওয়া হয়, তেমনই সীমিত সংখ্যক বা একক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ই-মেইল বা অন্য কোনো মাধ্যমে প্রকল্প গ্রহণের সুযোগ রাখা হয়েছে।
আইনটির ৯, ১০ ও ১৪ ধারার মাধ্যমে দায়মুক্তি দিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেমন ধারা ৯ অনুযায়ী, ‘এই আইনের অধীন কৃত বা কৃত বলিয়া বিবেচিত কোনো কার্য, গৃহীত কোনো ব্যবস্থা, প্রদত্ত কোনো আদেশ বা নির্দেশের বৈধতা সম্পর্কে কোনো আদালতের নিকট প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।’
ধারা ১০ অনুযায়ী, ‘এই আইন বা তদধীন প্রণীত বিধি, সাধারণ বা বিশেষ আদেশের অধীন দায়িত্ব পালনকালে সরল বিশ্বাসে কৃত বা কৃত বলিয়া বিবেচিত কোনো কার্যের জন্য কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলা বা অন্য কোনো প্রকার আইনগত কার্যধারা গ্রহণ করা যাইবে না।’
১৪ ধারায় বলা হয়েছে, ‘এ আইনের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও, এই আইনের অধীন কৃত কাজকর্ম বা গৃহীত ব্যবস্থা এমনভাবে অব্যাহত থাকিবে ও পরিচালিত হইবে যেন এই আইনের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয় নাই।’
২০১০ সালের ৬ সেপ্টেম্বর আইনটি মন্ত্রিসভা বৈঠকে অনুমোদন দেওয়া হয় এবং ২৬ সেপ্টেম্বর আইনটি জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হয়। ২০১০ সালের ৩ অক্টোবর আইনটি কণ্ঠভোটে পাস হয়। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আইনটিকে সামরিক আইনের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন আইনবিদ শাহ্দীন মালিক। তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি আইনটিকে জনস্বার্থবিরোধী বলে আখ্যায়িত করে।
২০২৩ সালে বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদনেও আইনটিকে বিদ্যুৎ খাতের অপচুক্তি ও লুটেরা মডেল বলে আখ্যায়িত করা হয়। পরে অবশ্য আইএমইডি প্রতিবাদ করে এবং প্রতিবেদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বহিষ্কার ও ওএসডি করা হয়।
এ আইনের ফলে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও প্রতিযোগিতার সব পথ বন্ধ হয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত পরিচালিত হতে থাকে গোষ্ঠীগত স্বার্থ রক্ষার ভিত্তিতে। আইন পাসের পর বিদ্যুৎ খাতের প্রায় সব চুক্তিই বিনা দরপত্রে সম্পাদিত হয়। ব্যতিক্রম হিসেবে দুটি চুক্তি দরপত্রের মাধ্যমে হলেও তা সমাঝোতার ভিত্তিতেই চূড়ান্ত এবং অতিরিক্ত মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল।
আইনটির ঘোষিত উদ্দেশ্য বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট দূরীভূত করা; বাস্তবে খাতটি অনিরাপদ হয়ে পড়ে। আইনটির আওতায় অনিয়ম ও অসংগতির মাধ্যমে অপ্রয়োজনীয় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে পরিবেশের ঝুঁকি এবং বিপুল পরিমাণ কৃষিজমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে জীবন-জীবিকার সংকট বাড়ানো হয়েছে। একদিকে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করে উল্টো হয়রানি, অন্যদিকে জ্বালানি আমদানিতে মূসক ছাড় দিয়ে উদ্যোক্তাদের বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। দফায় দফায় রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের মেয়াদ, বিদ্যুতের আমদানি ও দাম বাড়ানো হয়েছে। এতে মূল্যস্ফীতির চাপ ক্রমেই বেড়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত নিয়ে যথেচ্ছাচার ও লাগামহীন দুর্নীতি চলেছে এবং জড়িতদের নিয়ে সংবাদমাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও তেমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বলা বাহুল্য, দায়মুক্তি আইনটি প্রণীত হয়েছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে। এ আইনের আওতায় সব অনিয়ম ও দুর্নীতির ‘দেখভাল’ করেছেন ওই মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী নসরুল
হামিদ বিপু।
বিপজ্জনক আইনটি আপাতত স্থগিত করার খবরটি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। কিন্তু আইনটি অতিসত্বর বিলোপই করা দরকার। পাশাপাশি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠায় কোনো ছাড় দেওয়া চলবে না। আমরা নতুন পাত্রে পুরোনো পানীয় চাই না।
একই সঙ্গে পরিবেশ, জলবায়ু ও বৈশ্বিক প্রবণতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জ্বালানিকে টেকসই খাত হিসেবে গড়ে তোলার জন্য খুব দ্রুতই কিছু উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। এর মধ্যে রয়েছে– বাংলাদেশ জ্বালানি নিয়ন্ত্রণ আইন (বিইআরসি) সময়োপযোগী ও শক্তিশালী করা; জাতীয় জ্বালানি নীতিমালা প্রণয়ন; জ্বালানি পণ্যের মূল্য বিশেষত তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয় ও ভোক্তাস্বার্থ বিবেচনা করে পুনর্নির্ধারণ; নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে অগ্রাধিকার।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। আশা করি, উপদেষ্টা পরিষদ মানুষের প্রত্যাশার গুরুত্ব উপলব্ধি করে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাতটির যথাযথ সংস্কারে দেরি করবেন না।