সম্পাদকীয় প্রকাশনার সময়: সোমবার ১২, অগাস্ট ২০২৪

বাজার সংস্কারে শক্তিশালী সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে

Share on:

আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৫ বছরের শাসনামলে বাজার ব্যবস্থাপনায় শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে। দেশের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়তে শুরু করে। দুই বছর ধরেই দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজমান। গত এক বছরে দেশে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতিও ১০ শতাংশের ওপরে।


পণ্যের দাম বাড়লেও মানুষের আয় বাড়েনি। ফলে উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে দেশের মধ্য ও নিম্ন আয়ের মানুষ অত্যন্ত কষ্টে জীবনযাপন করছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। এখন বাজার সিন্ডিকেটকে ভেঙে ফেলার দিকে নজর দিতে হবে। মহাসড়কে চাঁদাবাজিও বন্ধ করতে হবে। দ্রব্যমূল্যের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে আনতে হবে।

সরকার পতনের পর তিনদিন কার্যত দেশ সরকারবিহীন ছিল। দেশজুড়ে নৈরাজ্য তৈরি হয়। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হয়েছে। আমরা লক্ষ করছি, অস্থিরতার সুযোগে দেশের বিভিন্ন স্থানে বাজারে নিয়ন্ত্রণ নিতে আরো একটি গোষ্ঠী সক্রিয় হচ্ছে, যা উদ্বেগজনক। দেশে বর্তমানে যে অস্থিরতা চলছে, সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে যেন আর কেউ বাজারের নিয়ন্ত্রণ না নিতে পারে সে বিষয়ে সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ কাম্য। কেননা পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে বেশি কষ্টে থাকে সাধারণ মানুষ।

সরকারি বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, বিগত বছরগুলোয় ফসলের উৎপাদন বেড়েছে। তার পরও পণ্যের দাম সবসময় ঊর্ধ্বমুখী থেকেছে। এর মূল কারণ বিগত সরকারের সময়ে বাজার সিন্ডিকেট, সড়কে চাঁদাবাজি, অবৈধ মজুদদারি, দালাল ও মধ্যস্বত্বভোগীদের আধিপত্য। বাজারে বিগত সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকায় মাঠ পর্যায় থেকে বাজার পর্যন্ত প্রতিটি স্তরেই তাদের প্রভাব ছিল। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা বাজারে অভিযান পরিচালনা করলেও বাজারের পণ্যের দাম কমেনি। আবার দেশের আমদানির নিয়ন্ত্রণও গুটিকয়েক ব্যক্তি বা কোম্পানির কাছে জিম্মি ছিল।

গতকাল রোববার প্রকাশিত বণিক বার্তার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দিনাজপুরের হিলিতে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। সরবরাহ কম থাকায় এ অঞ্চলে মসলাপণ্যটির বাজারদর ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে বলে দাবি ব্যবসায়ীদের।

এ বন্দর দিয়ে পেঁয়াজ আমদানি অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে ইন্দোর ও নাসিক জাতের পেঁয়াজ আমদানি হচ্ছে। এর পরও দুদিনের ব্যবধানে বন্দরে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ১৫-১৮ টাকা। বর্তমানে হিলিতে প্রতি কেজি আমদানীকৃত পেঁয়াজ ৯৫-১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, দুদিন আগেও যা ছিল ৮০-৮২ টাকা। এছাড়া গত শনিবার হিলির বাজারে একদিনের ব্যবধানে প্রতি কেজি দেশী পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ১০ টাকা। বর্তমানে অঞ্চলটিতে মসলাপণ্যটি কেজিপ্রতি ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এর আগে প্রতি কেজি দেশী পেঁয়াজের দাম ছিল ১১০ টাকা।

আশা করি, বর্তমান সরকার বাজার ব্যবস্থাপনায় নজর দেবেন। পণ্যটির দাম কেন বাড়ছে তার কারণ অনুসন্ধান করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।

বাজারে পণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে থাকলে সবচেয়ে স্বস্তিতে থাকবে দেশের মধ্যম ও নিম্ন আয়ের মানুষ। সড়কে চাঁদাবাজি, পরিবহন ব্যবস্থাপনা ও সিন্ডিকেটের মাধ্যমে যারাই বাজারে অস্থিতিশীলতা তৈরি করবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। বাজারে অবাধ প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি করে অবৈধ মজুদদারি, দালাল ও মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব কমানো প্রয়োজন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বার্ষিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশে দাঁড়ায়, যা ২০১১-১২ অর্থবছরের পর সর্বোচ্চ। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শুরুর মাসে অর্থাৎ জুলাইয়ে তা কিছুটা কমে ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশে দাঁড়ায়, জুনে ছিল ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। গত ১২ মাসের মধ্যে সাত মাসই খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরে ছিল। গত বছরের আগস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশে উঠেছিল, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সর্বোচ্চ।

যখনই দেশে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ে তখনই ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে খোলাবাজারে চাল-আটাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রি করা হয়। মূলত দেশের সাধারণ বা দরিদ্র মানুষের উদ্দেশেই তা বিক্রি করা হয়। কিন্তু সাধারণ বা দরিদ্র মানুষ সেই পণ্য পাচ্ছে কিনা তা নিরপেক্ষ বা তৃতীয় কোনো প্রতিষ্ঠান দিয়ে নিরীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন।

আমরা মনে করি, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাজার আরো কঠোর তদারকির আওতায় আনবে। বাজারে যেকোনো ধরনের কারসাজি অনেকটা জাতীয় নিরাপত্তার জন্যই হুমকিস্বরূপ। তাই তা প্রতিরোধ করতে হবে কঠোরভাবে। সেই সঙ্গে চালসহ বিভিন্ন পণ্যের পর্যাপ্ত মজুদও নিশ্চিত করতে হবে। বস্তুত বাজারে পণ্যমূল্য নির্ভর করে চাহিদা ও জোগানের ওপর। জোগান কমে গেলে অথবা চাহিদা বেড়ে গেলে পণ্যের দাম বাড়ে, যা চালসহ অত্যাবশ্যকীয় সব পণ্যের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কারসাজিতে বাজারে যেসব পণ্যের জোগান কমে যায়, তখন সরকারের গুদাম থেকে সেসব পণ্যের সরবরাহ বাড়াতে হবে।

কৃষিতে উৎপাদন বেড়েছে। উৎপাদন থেকে ভোক্তা পর্যন্ত পণ্যের দামের যে বিশাল ব্যবধান তা কমিয়ে আনা দরকার। এ বিশাল ব্যবধানে প্রভাব রয়েছে দালাল ও মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণীর। এ শ্রেণীর প্রভাব কমিয়ে আনা দরকার। পাশাপাশি কৃষিভিত্তিক তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটাতে হবে। দেশের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে সেটি কৃষির মাধ্যমেই ঘটাতে হবে। কৃষির উন্নয়নের পরিকল্পনা এমনভাবে হওয়া উচিত, যার ফলে কৃষক থেকে ভোক্তা পর্যন্ত সবাই যেন সুফল পায়। এক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।

বর্তমানে দেশে পণ্য আমদানিতে হাতে গোনা কয়েকটি কোম্পানি বা ব্যক্তির নিবন্ধন রয়েছে। ফলে এ কয়েকটি কোম্পানি বা ব্যক্তির কাছে পণ্য আমদানি নিয়ন্ত্রিত। তাদের কাছেই বাজার জিম্মি। তাদের প্রভাব কমাতে ছোট-বড় সব ধরনের কোম্পানিকে আমদানি নিবন্ধনের সুযোগ দিতে হবে। আমদানিকারকের সংখ্যা বাড়িয়ে বাজারে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি করা জরুরি।

আর কোনো ধরনের প্রভাব ও প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই যেন ছোট-বড় সব আমদানিকারক পণ্য আমদানি ও বিপণন করতে পারেন তা নিশ্চিত করতে হবে। আমদানিকারকের সংখ্যা বাড়লে আমদানির পরিমাণ বাড়বে। বাজারে পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক থাকবে। পণ্যের দামও কম থাকবে বলে আশা করা যায়।

বাজার সিন্ডিকেটের সঙ্গে কেউ জড়িত হলে তার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ দরকার। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলংকা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে দ্রুত সাফল্য দেখিয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য শ্রীলংকা দৃষ্টান্ত হতে পারে। শ্রীলংকা ভয়াবহ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটে পড়ে ২০২২ সালে। সে সময় মূল্যস্ফীতি ঠেকে প্রায় ৬০ শতাংশে। রিজার্ভ সংকটে বন্ধ হয়ে যায় জ্বালানি তেলের মতো অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি। আমদানি দায় আর বিদেশী ঋণ পরিশোধের ব্যর্থতায় নিজেদের দেউলিয়াও ঘোষণা করে শ্রীলংকা সরকার। কিন্তু ইতিহাসের সবচেয়ে নাজুক সে পরিস্থিতি দ্রুতই কাটিয়ে উঠছে শ্রীলংকা। মূল্যস্ফীতির হার কমতে কমতে গত জুনে নেমে আসে ১ দশমিক ৭ শতাংশে। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, মে মাসে এ হার ছিল ১ শতাংশের নিচে। শ্রীলংকার রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে বাজার সিন্ডিকেট ভেঙে গিয়েছিল ও দুর্নীতি কমেছে। ফলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণসহ দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে।

বাজার ব্যবস্থাপনায় যারাই কারসাজির সঙ্গে জড়িত থাকবে, তাদের শনাক্ত করে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে কোনো স্বজনপ্রীতির আশ্রয় নেয়া যাবে না। সরকারিভাবে বিভিন্ন পণ্যের মজুদ বাড়াতে হবে। বাজারে পণ্য সরবরাহে সংকট হলেই সরকারি মজুদ থেকে পণ্য সরবরাহ করতে হবে। এর মাধ্যমে বাজারে চাহিদা ও জোগানে সমতা নিশ্চিত হবে।

সরকারকে সম্মিলিতভাবে বাজার তদারকিতে জোরালো পদক্ষেপ নেয়া দরকার। সরকার পতনে দেশে যে অস্থিরতা চলছে সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আবার কোনো গোষ্ঠী যেন বাজারে প্রভাব বিস্তার করতে না পারে সেদিকে এখনই নজর দিতে হবে সরকারকে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এ বিষয়ে সঠিক পদক্ষেপ নেবে—সেটাই প্রত্যাশা।

দৈনিক বণিক বার্তা