বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নেয়া জরুরি
Share on:
দুই বছর ধরেই দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিদ্যমান। গত এক বছরে দেশে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতিও অনেক বেড়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে দেশের মধ্যম ও নিম্ন আয়ের মানুষ অত্যন্ত কষ্টে জীবনযাপন করছে। কেননা পণ্যের দাম বাড়লেও সেই অনুপাতে আয় বাড়ছে না।
সরকারি বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, বিগত বছরগুলোয় ফসল উৎপাদন বেড়েছে। তার পরও পণ্যের দাম সবসময় ঊর্ধ্বমুখী থেকেছে। এর মূল কারণ বিগত সরকারের সময়ে বাজার সিন্ডিকেট, সড়কে চাঁদাবাজি, অবৈধ মজুদদারি, দালাল ও মধ্যস্বত্বভোগীদের আধিপত্য বিদ্যমান ছিল। বাজারে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকায় মাঠ পর্যায় থেকে বাজার পর্যন্ত প্রতিটি স্তরেই তাদের প্রভাব ছিল। এ কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্য সবসময় ঊর্ধ্বমুখী ছিল। বাজারের সিন্ডিকেট না ভেঙে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা অভিযান পরিচালনা করলেও বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। আবার দেশের আমদানির নিয়ন্ত্রণও গুটিকয়েক ব্যক্তি বা কোম্পানির কাছে। ফলে বাজার ব্যবস্থাপনা সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি ছিল।
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে ভারতে পালিয়ে যান। দেশের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাজারের সিন্ডিকেট ভেঙে পড়েছে। ফলে রাজধানীর বাজারে বিভিন্ন পণ্যের দাম কমতে শুরু করেছে। শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। আশা করি, এ সরকার বাজার ব্যবস্থাপনায় নজর দেবে। বাজার তদারকি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে। এর মাধ্যমে পণ্যের দাম মধ্যম ও নিম্ন আয়ের মানুষের ক্রয়সীমার আওতায় আসবে এবং ভোগান্তি কমে মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরে আসবে।
এছাড়া সড়কে চাঁদাবাজি, পরিবহন ব্যবস্থাপনা ও সিন্ডিকেটের মাধ্যমে যারাই বাজারে অস্থিতিশীলতা তৈরি করবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। অবৈধ মজুদদারি, দালাল ও মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব কমাতে বাজারে অবাধ প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি করা দরকার।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বার্ষিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশে দাঁড়ায়, যা ২০১১-১২ অর্থবছরের পর সর্বোচ্চ। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শুরুর মাস অর্থাৎ জুলাইয়ে তা কিছুটা কমে ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশে দাঁড়ায়, জুনে ছিল ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। ১২ মাসের মধ্যে সাত মাসই খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরে ছিল। গত বছরের আগস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশে উঠেছিল, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সর্বোচ্চ।
যখনই দেশে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ে তখনই ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে খোলাবাজারে চাল-আটাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রি করা হয়। মূলত দেশের সাধারণ বা দরিদ্র মানুষের উদ্দেশ্যেই বিক্রি করা হয়। কিন্তু সাধারণ বা দরিদ্র মানুষ সেই পণ্য পাচ্ছে কিনা তা নিরপেক্ষ বা তৃতীয় কোনো প্রতিষ্ঠান দিয়ে নিরীক্ষা প্রয়োজন। কেননা খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে সবচেয়ে বেশি খাদ্যনিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকা মানুষের কাছে এসব পণ্য সঠিকভাবে পৌঁছছে কিনা সে বিষয়ে তদারকি প্রয়োজন।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) ‘বাংলাদেশ বাজার তদারকি প্রতিবেদন এপ্রিল ২০২৪’ প্রকাশ করেছে গত সপ্তাহে। প্রতিবেদন অনুসারে, চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত এক বছরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৫ দশমিক ৬ শতাংশ বেড়েছে। আর মাসিক ভিত্তিতে গত এপ্রিলে এটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ২২ শতাংশে।
আমরা মনে করি, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চালের বাজার আরো কঠোর তদারকির আওতায় আনবে। কারণ ভাত আমাদের প্রধান খাদ্য। তাই বাজারে যেকোনো ধরনের কারসাজি অনেকটা জাতীয় নিরাপত্তার জন্যই হুমকিস্বরূপ। তাই তা প্রতিরোধ করতে হবে কঠোরভাবে। সেই সঙ্গে চালের পর্যাপ্ত মজুদও নিশ্চিত করতে হবে। বস্তুত বাজারে পণ্যমূল্য নির্ভর করে চাহিদা ও জোগানের ওপর। জোগান কমে গেলে অথবা চাহিদা বেড়ে গেলে পণ্যের দাম বাড়ে, যা চালসহ অত্যাবশ্যকীয় সব পণ্যের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
কৃষিতে উৎপাদন বেড়েছে। উৎপাদন থেকে ভোক্তা পর্যন্ত পণ্যের দামের যে বিশাল ব্যবধান তা কমিয়ে আনা দরকার। এ বিশাল ব্যবধানে প্রভাব রয়েছে দালাল ও মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণীর। এ শ্রেণীর প্রভাব কমিয়ে আনা দরকার। পাশাপাশি প্রয়োজন কৃষিভিত্তিক তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটানো। দেশের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে সেটি কৃষির মাধ্যমেই ঘটাতে হবে। কৃষির উন্নয়নের পরিকল্পনা এমনভাবে হওয়া উচিত, যার ফলে কৃষক থেকে ভোক্তা পর্যন্ত সবাই যেন সুফল পায়। এক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।
বর্তমানে দেশে পণ্য আমদানিতে হাতে গোনা কয়েকটি কোম্পানি বা ব্যক্তির নিবন্ধন রয়েছে। ফলে এ কয়েকটি কোম্পানি বা ব্যক্তির কাছে পণ্য আমদানি নিয়ন্ত্রিত। তাদের কাছেই বাজার জিম্মি। তাদের প্রভাব কমাতে ছোট-বড় সব ধরনের কোম্পানিকে আমদানি নিবন্ধনের সুযোগ দিতে হবে। আমদানিকারকের সংখ্যা বাড়িয়ে বাজারে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি করা দরকার। কোনো ধরনের প্রভাব ও প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই যেন ছোট-বড় সব আমদানিকারক পণ্য আমদানি ও বিপণন করতে পারে, সেটিও নিশ্চিত করতে হবে। কেননা আমদানিকারকের সংখ্যা বাড়লে আমদানির পরিমাণ বাড়বে এবং বাজারে পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক থাকবে। পণ্যের দামও স্বাভাবিক থাকবে বলে আশা করা যায়।
বাজার সিন্ডিকেটের সঙ্গে কেউ জড়িত হলে তার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ দরকার। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলংকা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে দ্রুত সাফল্য দেখিয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য শ্রীলংকা দৃষ্টান্ত হতে পারে। শ্রীলংকা ভয়াবহ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটে পড়ে ২০২২ সালে। সে সময় মূল্যস্ফীতি ঠেকে প্রায় ৬০ শতাংশে। রিজার্ভ সংকটে বন্ধ হয়ে যায় জ্বালানি তেলের মতো অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি। আমদানি দায় আর বিদেশী ঋণ পরিশোধের ব্যর্থতায় নিজেদের দেউলিয়াও ঘোষণা করে শ্রীলংকা সরকার। কিন্তু ইতিহাসের সবচেয়ে নাজুক সে পরিস্থিতি দ্রুতই কাটিয়ে উঠছে দেশটি। মূল্যস্ফীতির হার কমতে কমতে গত জুনে নেমে আসে ১ দশমিক ৭ শতাংশে। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, মে মাসে এ হার ছিল ১ শতাংশের নিচে। শ্রীলংকার রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে বাজার সিন্ডিকেট ভেঙে গিয়েছিল ও দুর্নীতি কমেছে। ফলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণসহ দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে।
বাজার ব্যবস্থাপনায় অনিয়মের সঙ্গে যারাই জড়িত থাকবে, তাদের শনাক্ত করে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে কোনো স্বজনপ্রীতির আশ্রয় নেয়া যাবে না। সরকারিভাবে বিভিন্ন পণ্যের মজুদ বাড়াতে হবে। বাজারে পণ্য সরবরাহে সংকট হলেই সরকারি মজুদ থেকে পণ্য সরবরাহ করতে হবে। এর মাধ্যমে বাজারে চাহিদা ও জোগানে ভারসাম্য নিশ্চিত হবে। আর সরকারের গুদামে পণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ থাকলে কৃত্রিম মজুদকারীরাও পণ্য মজুদে বিরত থাকতে বাধ্য হবে।
বাজার ব্যবস্থাপনায় যেসব সরকারি দপ্তর রয়েছে তাদের সম্মিলিতভাবে বাজার তদারকিতে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এ বিষয়ে সঠিক পদক্ষেপ নেবে—সেটাই প্রত্যাশা।