বিচারের বাণী যেন নিভৃতে না কাঁদে
Share on:
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আলটিমেটামের মুখে শনিবার পদত্যাগ করিয়াছেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান।
ইহার পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলনকারীদেরই দাবির প্রতি সাড়া দিয়া রাষ্ট্রপতি হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদকে রবিবার নূতন প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ পাঠ করাইয়াছেন। আমরা জানি, শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে শনিবার আপিল বিভাগের ছয়জন বিচারপতিও পদত্যাগ করিয়াছেন। তাহাদের স্থলে নূতন সাত বিচারপতি আপিল বিভাগে নিয়োগ পাইতে যাইতেছেন বলিয়া সংবাদমাধ্যমে খবর আসিয়াছে।
সংবিধান অনুযায়ী, প্রধান বিচারপতিই বাংলাদেশের বিচার বিভাগের অভিভাবক এবং আপিল বিভাগ হইল দেশের সর্বোচ্চ আদালত। অতএব, সকল কিছু মিলাইয়া বলা যায়, বাংলাদেশের বিচার বিভাগ নূতন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে এক নূতন যুগে প্রবেশ করিতে যাইতেছে। আমরা নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতিকে শুভেচ্ছা জানাই এবং শীঘ্রই আপিল বিভাগে যে বিচারপতিগণ স্থান পাইতে চলিয়াছেন, তাহাদেরও প্রতি আমাদের অগ্রিম শুভেচ্ছা।
দেশের বিচারাঙ্গনে এই নূতন যুগের সূচনা এমন এক সময়ে ঘটিতেছে, যখন বিচার বিভাগ বিশেষত সর্বোচ্চ আদালতকে ন্যায়বিচারপ্রত্যাশী দেশের মানুষ শেষ ভরসাস্থল বলিয়া মনে করিলেও, দুর্ভাগ্যবশত বাস্তবতা অনেকাংশেই তেমন নহে। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই আসে বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কথা, যাহা কার্যত বিচারহীনতার নামান্তর। এমনিতেই বৈধ-অবৈধ নানা কারণে এখানে বিচার প্রক্রিয়া ব্যয়বহুল, যেখানে দরিদ্রদের প্রবেশাধিকার নাই বলিলেই চলে। যাহারা ধারদেনা বা জীবনের শেষ সম্বল জমিজিরাত বিক্রয় করিয়া আদালতের শরণাপন্ন হন, তাহাদেরও অনেকে বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে এক পর্যায়ে হতাশ হইয়া পড়েন। আর এই দীর্ঘসূত্রতার জন্য প্রধানত বিচারক ও অন্যান্য জনবল সংকটের পাশাপাশি ঔপনিবেশিক আমলের আইনবিধি তদন্ত এবং বিচার প্রক্রিয়ার কারণে সৃষ্ট মামলাজট দায়ী হইলেও, রায় প্রকাশে অহেতুক বিলম্বও কম দায়ী নহে। গত বৎসর পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল ৪৩ লক্ষ, যেখানে অধস্তন আদালতগুলির অংশ ৩৭ লক্ষাধিক এবং সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন মামলা প্রায় ৬ লক্ষ। অন্যদিকে, বিশেষত উচ্চ আদালতে রায় প্রকাশে দীর্ঘ সময় লাগিবার বিষয় ইতোমধ্যে নাগরিক সমাজেও অন্যতম আলোচনার বিষয় হইয়া উঠিয়াছে।
নিম্ন আদালত তো বটেই, উচ্চ আদালতেও অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা দীর্ঘদিন যাবৎ বাসা বাঁধিয়া আছে– এই অভিযোগ বিভিন্ন সময়ে এমনকি শীর্ষস্থানীয় বহু বিচারপতি স্বীকার করিয়াছেন। দুঃখজনক হইল, ইতোপূর্বে একাধিক প্রধান বিচারপতি এই সমস্যা নিরসনে অঙ্গীকার করিলেও পরিস্থিতির তেমন ইতরবিশেষ ঘটে নাই। এই অবস্থায় কতবার যে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদিয়াছে, উহার কোনো হিসাব নাই। আদালতের আরেকটি গুরুতর সমস্যা হইল, বিচার বিভাগে ক্ষমতাসীন দলের খবরদারি। সাম্প্রতিক সময়ে নিম্ন আদালতে বিচারক নিয়োগের প্রক্রিয়াটি অনেক স্বচ্ছভাবে হইলেও বিচারকদের ওপর নির্বাহী বিভাগের খবরদারি আদৌ বন্ধ হয় নাই। বিচারপতি নিয়োগে সংবিধান নির্দেশিত কোনো আইন না থাকায় উচ্চ আদালতে এ কার্যটি যে বরাবরই ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছা-অনিচ্ছানির্ভর ছিল, তাহা অস্বীকারের কোনো সুযোগ নাই। আর এমন পরিস্থিতি যে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার পথে অন্যতম অন্তরায়, তাহা ভুক্তভোগীরা তো জানেনই, সাধারণ মানুষেরও অজানা নহে।
আমরা মনে করি, দুই দশকের অধিককাল উচ্চ আদালতে বিচারকার্য পরিচালনার সহিত যুক্ত থাকায় নূতন প্রধান বিচারপতির নিকট এ সমস্যাবলির কোনোটাই অপরিচিত নহে; বরং বিদ্যমান ব্যবস্থার ভিতরের মানুষ হিসাবে আমাদের অপেক্ষা তিনি এইগুলি সম্পর্কে অধিক জ্ঞাত। তাই এই আকাঙ্ক্ষা অসংগত নহে, উল্লিখিত সমস্যাবলি নিরসনে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে তিনি বিশেষত উচ্চ আদালতের নিকট বিচারপ্রার্থীদের প্রত্যাশা পূরণে উদ্যোগী হইবেন।